
সংস্কার কমিশনের অধিকাংশ সুপারিশে একমত বিএনপি
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে তৃতীয় দফায় বৈঠক করেছে বিএনপি। এ সময় সংস্কার কমিশনের অধিকাংশ সুপারিশের সঙ্গে একমত হয়েছে দলটি। মঙ্গলবার দুপুরে জাতীয় সংসদ ভবনের এলডি হলে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বাড়ানোর পক্ষে মত দেয় বিএনপি। পর পর দুই মেয়াদের বেশি কেউ প্রধানমন্ত্রী পদে থাকতে পারবেন না।
তবে বিরতি দিয়ে হলেও ২ বারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ চেয়েছে দলটি। বৈঠক শেষে এক প্রশ্নের জবাবে বিএনপি প্রতিনিধি দলের প্রধান দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আমরা ঐকমত্য কমিশনকে জানিয়েছি দলের প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী একই ব্যক্তি হবেন কি নাÑএ সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক দলের কাছে থাকা উচিত। দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্টের প্রস্তাবেও আমরা একমত।
বিএনপি বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী জানিয়ে সালাহউদ্দিন বলেন, ভবিষ্যতে বিতর্কিত কোনো ব্যক্তি যাতে প্রধান বিচারপতি না হতে পারেন, সেজন্য আমরা আপিল বিভাগের সবচেয়ে সিনিয়র তিন বিচারপতির মধ্য থেকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছি। আর রাষ্ট্রপতির অভিশংসন প্রক্রিয়ায় জাতীয় সংসদের উভয় কক্ষের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের ভোটের বিষয়ে বিএনপি একমত পোষণ করেছে। ন্যায়পাল নিয়োগের বিষয়েও একমত হয়েছে বিএনপি। সংবিধান অনুযায়ী বিচার বিভাগের প্রতিটি কার্যক্রম যেন আইনসম্মত ও সাংবিধানিক হয়, সে বিষয়ে সতর্ক থাকার ওপর গুরুত্বারোপ করেছি আমরা।
সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার ভারসাম্য ৪৮(৩) এর পর সংবিধানে নতুন বিধান যুক্ত করে কি কি ক্ষমতা দেওয়া হবে তা আলাদা করে উল্লেখ করার পরামর্শ দেওয়াও হয়েছে। সংসদ নেতার দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রীর হাতে থাকা সর্বোত্তম বলেও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। আর স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহার করা যাবে না- এ বিষয়ের সঙ্গে বিএনপি একমত হয়েছে।
সালাউদ্দিন বলেন, কোনো স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে এমপিরা থাকতে পারবে না। এ ছাড়া সংবিধান সংশোধনীর সব ক্ষেত্রে গণভোটের দরকার নেই। তবে নির্দিষ্ট আর্টিকেল নিয়ে গণভোটের ব্যবস্থা করতে চাইলে সেটা পরবর্তী সংসদে আলোচনা করে তা করা যেতে পারে।
সালাউদ্দিন বলেন, সুপ্রিম কোর্টের বিকেন্দ্রীকরণ সংবিধানের মূল কাঠামোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তবে কমিশনের সার্কিট বেঞ্চ স্থাপনের সুপারিশের সঙ্গে একমত বিএনপি। অ্যাটর্নি সার্ভিসের বিষয়ে নীতিগতভাবে একমত বিএনপি। তবে সংবিধান নয়, আইনের মাধ্যমে তা করতে হবে।
সালাউদ্দিন বলেন, আমরা বলেছি জুডিসিয়ারির সম্পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে চাইলে আপিল বিভাগ থেকে অন্তত দুই থেকে তিনজনের অপশন রাখা উচিত। আমরা বলেছি, প্রধানমন্ত্রীর কর্তৃত্ব থাকুক তবে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বাড়ানোর পক্ষে বিএনপি। একজন ব্যক্তির টানা ২ বারের বেশি প্রধানমন্ত্রীর পদে থাকতে পারার বিষয়ে নিজেদের দ্বিমত অবস্থান থেকে সরে এসে আমরা বলেছি ২ বারের পর একবার বিরতি দিয়ে আবার সেই ব্যক্তিকে প্রধানমন্ত্রী করা যেতে পারে।
সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, মন্ত্রিসভায় প্রধানমন্ত্রীর কর্তৃত্ব বাতিলের কথা বলেছে কমিশন। আমরা বলেছি, কর্তৃত্ব থাকা উচিত। তবে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বাড়ানোর পক্ষে বিএনপি। আমরা চাই, কিছু ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর বাইরেও রাষ্ট্রপতি সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। তাতে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য থাকবে।
আর প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ পাঁচ বছরই থাকা উচিত।
আইনসভা দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট রাখার পক্ষে নিজেদের অবস্থান জানিয়ে সালাহউদ্দিন বলেন, নি¤œকক্ষের ৪০০ আসনের মধ্যে প্রত্যক্ষ ভোটে ১০০ আসনে এমপি নির্বাচিত হবে নারী। ২ জন ডেপুটি স্পিকার থাকবেন বিরোধী দল থেকে। সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি পদেও থাকবে বিরোধী দলের অগ্রাধিকার। সংসদ সদস্যরা কোনো স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কোনো পদে থাকতে পারবেন না বলে মত দিয়েছি।
সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, সংস্কার প্রস্তাবগুলোর আলোচনা জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে বৃহত্তর সমঝোতা হবে বলে আমরা প্রত্যাশা করছি। আমরা বিচার বিভাগ, নির্বাচন ব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, দুর্নীতি দমন কমিশনের সংস্কার রিপোর্টগুলো নিয়ে আলোচনা করেছি। যে সমস্ত সিদ্ধান্ত জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে গৃহীত হবে, একটা বৃহত্তর কনসেনসাস আমরা সৃষ্টি করতে পারব, সেটা জাতীয় জীবনে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। সুতরাং একটু সময় বেশি নিলেও বিস্তারিত আলাপ করেছি আমরা।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি আলী রীয়াজ জানান, বিএনপির সঙ্গে আলোচনায় অনেক বিষয়ে ঐকমত্য তৈরি হয়েছে। কিছু বিষয়ে ভিন্নতা থাকলেও সেসব সংস্কারের বিষয়ে বিএনপি অত্যন্ত আন্তরিকভাবে আলোচনা করেছে।
বিএনপির প্রতিনিধি দলে সালাহউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে আরও ছিলেন চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ইসমাইল জবিউল্লাহ, সাবেক সংস্থাপন সচিব আবু মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পক্ষে সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে কমিশনের সদস্যদের মধ্যে ছিলেন ড. বদিউল আলম মজুমদার, ড. ইফতেখারুজ্জামান, সফর রাজ হোসেন ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার। তিনি বলেন, প্রতিদিন আলোচনার বিষয়গুলো প্রধান উপদেষ্টাকে অবহিত করা হচ্ছে। তিনি দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন এবং তার দিকনির্দেশনা মেনেই বৈঠক করা হচ্ছে।
সংবিধান সংস্কার কমিশন, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন ও দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলোর ওপর ৩৯টি রাজনৈতিক দলের মতামত জানতে চায় ঐকমত্য কমিশন। ৩৪টি দল তাদের মতামত তুলে ধরে, যাদের সঙ্গে এখন আলাদা করে বৈঠক করছে কমিশন।
উল্লেখ্য, এর আগে ১৭ এপ্রিল প্রথম দফা এবং ২০ এপ্রিল দ্বিতীয় দফায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠক করেছে বিএনপি।