ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৩ এপ্রিল ২০২৫, ৯ বৈশাখ ১৪৩২

দোহায় আর্থনা শীর্ষ সম্মেলনের উদ্বোধনীতে ড. ইউনূস

আশার বাতিঘর হতে চাই

জনকণ্ঠ রিপোর্ট

প্রকাশিত: ২২:৪৯, ২২ এপ্রিল ২০২৫

আশার বাতিঘর হতে চাই

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস কাতারের দোহায় ম্যান্ডারিন ওরিয়েন্টাল হোটেলে আর্থনা সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিশ্ববাসীর উদ্দেশে বলেছেন, বাংলাদেশ এখন এমন এক অবস্থায় দাঁড়িয়ে, যেখানে একটি নতুন সামাজিক চুক্তি করার সুযোগ এসেছে। এটি এমন এক চুক্তি যেখানে রাষ্ট্র ও জনগণ, বিশেষ করে যুবসমাজ, অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যবস্থা, ঐতিহ্য, ন্যায়বিচার, মর্যাদা এবং সুযোগের ভিত্তিতে একটি ভবিষ্যৎ একত্রে গড়ে তুলবে। আমরা পৃথিবীর জন্য আশার এক বাতিঘর হিসেবে দাঁড়াতে চাই।
মঙ্গলবার কাতারের দোহায় ‘আর্থনা শীর্ষ সম্মেলন ২০২৫’ এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তব্যে প্রধান উপদেষ্টা আরও বলেন, ‘আমাদের বন্ধু ও অংশীদারদের আহ্বান জানাই অন্তর্ভুক্তিমূলক সামাজিক চুক্তি পুনর্লিখনের জন্য, পাশাপাশি সামাজিক ব্যবসা, আর্থিক অন্তর্ভুক্তি এবং মাইক্রোফাইন্যান্সের ভূমিকা অন্বেষণ করতে, যা প্রান্তিক জনগণের জন্য টেকসই উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক সুযোগ সৃষ্টিতে সহায়ক।’
কাতারের রাজধানী দোহায় মঙ্গলবার থেকে শুরু হওয়া দু’দিনব্যাপী আর্থনা শীর্ষ সম্মেলনের প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘আমাদের উত্তরাধিকার গড়ে তোলা : স্থায়িত্ব, উদ্ভাবন ও ঐতিহ্যবাহী জ্ঞান’। এই শীর্ষ সম্মেলন এমন একটি প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করছে, যেখানে ঐতিহ্যবাহী জ্ঞান ও উদ্ভাবনী পন্থাগুলো আধুনিক টেকসই উন্নয়নে কীভাবে অবদান রাখতে পারে, তা অনুসন্ধান করা হয় যা একটি আরও সহনশীল ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ভবিষ্যৎ গঠনে সহায়তা করবে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, এটি এমন এক সামাজিক চুক্তি যেখানে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি ও প্রান্তিক জনগণের ক্ষমতায়ন মৌলিক বিষয় হিসেবে বিবেচিত হবে। তিনি তাঁর বক্তব্যে একটি সহনশীল, সমৃদ্ধ এবং টেকসই ভবিষ্যতের স্বপ্নের কথা উল্লেখ করে বলেন, তবে এখন এমন নানা হুমকি রয়েছে যা আমাদের উন্নয়নকে বিপথে ঠেলে দিতে পারে।
তিনি বলেন, ‘আমরা এমন এক সময় পার করছি, যেখানে বহুপাক্ষিকতা হুমকির মুখে, জলবায়ু পরিবর্তন দ্রুততর হচ্ছে, ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়ছে এবং মানবিক সংকট গভীরতর হচ্ছে। নতুন নতুন নীতিমালা, প্রযুক্তি এবং শাসন পদ্ধতি আমাদের পৃথিবীকে দ্রুত রূপান্তরিত করছে, যা অতীতের অনেক অনুমানকে অচল করে দিচ্ছে।’
এমন প্রেক্ষাপটে সহযোগিতা বাড়ানোর ওপর জোর দিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘এখন আঞ্চলিক ও  বৈশ্বিক সহযোগিতার পুনরুজ্জীবনের প্রয়োজন আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি। আসুন আমরা সাহসী হই। একটি এমন পৃথিবী গড়ি, যেখানে কেউ এতটা দরিদ্র না হয় যে সে স্বপ্ন দেখতে না পারে, এবং কোনো স্বপ্ন এত বড় না হয় যে তা অর্জন করা যায় না।’
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘ভবিষ্যৎ এমন কিছু নয় যা আমরা উত্তরাধিকার হিসেবে পাই। এটি এমন কিছু যা আমরা  তৈরি করি। এবং আমাদের প্রত্যেকেরই এতে একটি করে ভূমিকা রয়েছে। সামনে যে চ্যালেঞ্জগুলো রয়েছে তা নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমাদের উদ্ভাবন, সহমর্মিতা এবং সম্মিলিত কর্মকাণ্ডের সক্ষমতাও ব্যাপক।’
অধ্যাপক ড. ইউনূস বলেন, কাতার যেভাবে আর্থনা শীর্ষ সম্মেলনের উদ্যোগ নিয়েছে, তা দেখাচ্ছে কীভাবে একটি দেশ উদ্ভাবন, ঐতিহ্য ও অংশীদারিত্বের মাধ্যমে জলবায়ু সংকট, সামাজিক  বৈষম্য এবং কর্মসংস্থানের ভবিষ্যৎ মোকাবিলা করতে পারে। তাঁর মূল বক্তব্যে সামাজিক ব্যবসা, আর্থিক অন্তর্ভুক্তি এবং মাইক্রোফাইন্যান্সের মাধ্যমে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য টেকসই উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক সুযোগ  তৈরির ওপর গুরুত্ব দেন।
প্রধান উপদেষ্টা কাতার ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন শেখ মোজা বিনতে নাসের এবং ভাইস চেয়ারপারসন ও সিইও শেখ হিন্দ বিনতে হামাদ আল থানিকে সময়োপযোগী ও চমৎকার এই শীর্ষ সম্মেলন আয়োজনের জন্য ধন্যবাদ জানান।
ফিলিস্তিন-রোহিঙ্গা ইস্যু বিশ্বের উপেক্ষা করা ঠিক নয় ॥ প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আজকের সংকটপ্রবণ বিশ্বে যুদ্ধ ও সংঘাত  মানুষের অধিকার খর্ব করে এবং অর্থনীতিকে ব্যাহত করে। শান্তি ও স্থিতিশীলতা যেকোনো অর্থবহ ও টেকসই উন্নয়নের মৌলিক পূর্বশর্ত। ফিলিস্তিন থেকে শুরু করে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা পর্যন্ত যে মানবিক সংকট দেখা দিয়েছে, তা বিশ্বের উপেক্ষা করা উচিত নয়।
তিনি বলেন, বিচারহীনতা এবং মানবাধিকারের প্রতি নির্লজ্জ অবজ্ঞা বিশ্বের যেকোনো জায়গায় উন্নয়নের জন্য হুমকি। ফিলিস্তিনে চলমান দুর্দশা কেবল একটি অঞ্চলকে নয়, পুরো মানবতাকে উদ্বিগ্ন করে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘যদিও আমরা সবার জন্য একটি স্থিতিস্থাপক, সমৃদ্ধ এবং টেকসই ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখি, তবে বিভিন্ন হুমকি রয়েছে যা আমাদের ভবিষ্যতের উন্নয়নকে লাইনচ্যুত করতে পারে। আমরা গভীর অনিশ্চয়তার সময়ে বাস করছি, যেখানে বহুপাক্ষিকতা মারাত্মক হুমকির মুখে, জলবায়ু পরিবর্তন ত্বরান্বিত হচ্ছে, ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়ছে এবং মানবিক সংকট গভীর হচ্ছে। উদীয়মান নিয়ম, প্রযুক্তি এবং শাসন মডেলগুলো আমাদের বিশ্বকে দ্রুত নতুন আকার দিচ্ছে, অতীতের অনেক অনুমানকে অপ্রচলিত করে তুলছে। আঞ্চলিক ও  বৈশ্বিক সহযোগিতার নবায়নযোগ্যতার তাগিদ কখনো এতটা ছিল না।’
সরকারপ্রধান বলেন, ‘মিয়ানমারের দীর্ঘস্থায়ী সংকট আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বছরের পর বছর ধরে বাংলাদেশ ১২ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে যার কারণে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত উল্লেখযোগ্য ক্ষতি হয়েছে। সংহতির নিদর্শন হিসেবে সম্প্রতি রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেছেন জাতিসংঘ মহাসচিব।  বৈশ্বিক প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকলেও রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর নিরাপদ, টেকসই ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে বিশ্বনেতাদের অবশ্যই একত্রিত হতে হবে।’
প্রধান উপদেষ্টাকে স্বাগত জানাল কাতার ॥ প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে মঙ্গলবার আর্থনা শীর্ষ সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কাতারের মন্ত্রী এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ স্বাগত জানিয়েছেন। প্রধান উপদেষ্টা অনুষ্ঠানে উপস্থিত বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ‘আর্থনা শীর্ষ সম্মেলন’-এ যোগ দিতে এখন চারদিনের সফরে কাতার রয়েছেন।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে জানানো হয়, সোমবার (দোহার সময়) রাত ৯টা ৪০ মিনিটে অধ্যাপক ড. ইউনূস বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে হামাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছলে তাঁকে স্বাগত জানান কাতারে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মো. নজরুল ইসলাম। এর আগে, তিনি সোমবার সন্ধ্যা (ঢাকা সময়) ৭টায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে রওনা হন।
সংবর্ধনায় বাংলাদেশের চার নারী ক্রীড়াবিদ ॥ বাংলাদেশের চার নারী ক্রীড়াবিদ আর্থনা শীর্ষ সম্মেলনের আগে মঙ্গলবার ম্যান্দারিন ওরিয়েন্টাল হোটেলে কাতার ফাউন্ডেশনের নেতৃত্বের সঙ্গে স্বাগত সংবর্ধনায় যোগ দিয়েছেন।
ইতিহাসে প্রথমবারের মতো, কাতার সফররত প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সফরসঙ্গী হয়েছেন চারজন জাতীয় নারী ক্রীড়াবিদ। 
এই চার ক্রীড়াবিদ হলেন- ফুটবলার আফিদা খন্দকার ও শাহেদা আখতার রিপা এবং ক্রিকেটার সুমাইয়া আখতার ও শারমিন সুলতানা। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে কাতার ফাউন্ডেশন এই চার নারী ক্রীড়াবিদকেও আমন্ত্রণ জানিয়েছে।

×