
ছবি: সংগৃহীত
চিরচেনা সেই মুখগুলো—মঞ্চের আলোয় অভ্যস্ত, প্রটোকলে ঘেরা—আজ পরেছেন হাতকড়া। আর তাদের মুখে নেই অহংকারের ছায়া, বরং লেগে আছে জবাবদিহির চাপা ক্লান্তি। ক্ষমতার চূড়ায় থাকা সাবেক মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও সংসদ সদস্যরা—যাদের কথায় উঠতো বসতো পুরো প্রশাসন, আজ তারা হাজির হয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায়। অভিযোগ: মানবতাবিরোধী অপরাধে সংশ্লিষ্টতা। আর জাতি তাকিয়ে আছে—এই বিচারে আদৌ কি প্রতিষ্ঠা পাবে ন্যায়বিচার? নাকি ইতিহাস আবারও মুখ ফিরিয়ে নেবে?
কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে আদালতে তোলা হয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেপ্তার সাবেক ১২ মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর দুই উপদেষ্টাসহ ১৯ আসামিকে। ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয় সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক মন্ত্রী আমির হোসেন আমু, ড. আব্দুর রাজ্জাক, কামরুল ইসলাম, মুহাম্মদ ফারুক খান, দীপু মনি, গোলাম দস্তগীর গাজী, শাজাহান খান, উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ও তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সভাপতি হাসানুল হক ইনু, সাবেক প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, কামাল আহমেদ মজুমদার, সাবেক সচিব মো. জাহাংগীর আলম ও অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক সহ আরও অনেককে। এ যেন এক সময়ের সর্বেসর্বা মানুষদের শূন্যতার প্রতিচ্ছবি।
তবে আদালতে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয় উত্তেজনা। হ্যান্ডকাপ পড়ানোয় ক্ষুব্ধ হয়ে পুলিশকে হুমকি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে সাবেক মন্ত্রী শাহজাহান খান ও হাসানুল হক ইনুর বিরুদ্ধে। রোববার শুনানির সময় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এই অভিযোহ করেন পুলিশের দুই সদস্য। মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় রোববার সাবেক ১২ মন্ত্রীসহ আওয়ামী লীগের ১৭ জনকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। শুনানির এক পর্যায়ে ব্যারিস্টার মোস্তাফিজুর রহমান আসামিদের হাতকড়া পড়ানোর বিষয়টি আদালতের নজরে আনেন।
প্রত্যক্ষদর্শী পুলিশ সদস্য জানান,“হ্যান্ডকাপ পরাতে গেলে আমাদের গালাগালি করেন। রাজাকারের বাচ্চা বলেছেন। এমনকি হুমকি দিয়েছেন—‘তোদের গুষ্টি শেষ করে দেব!’”
এ বিষয়ে চিপ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, আদালতে আসামিকে হ্যান্ডকাপ পরিয়ে তোলা হবে কি না সেটা জেল অথরিটি সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। আসামিকে যদি কন্ট্রোল করতে না পারা যায় এবং তার পক্ষ থেকে যদি কোনো নিরাপত্তা ঝুঁকি থাকে তাহলে তাকে হ্যান্ডকাপ পরিয়ে বা আরও জটিল কোনো পদ্ধতি গ্রহণ করে আদালতে তুলতে পারে জেল কর্তৃপক্ষ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীর বাহিনীর সদস্যরা আদালতকে জানিয়েছেন, বিশেষ করে হাসানুল হক ইনু, শাজাহান খান ও জিয়াউল হাসান তাদের নির্বংশ করার হুমকি দিয়েছেন। তাদের সঙ্গে খুবই খারাপ আচরণ করেছেন। এছাড়া এদের মধ্যে একজন তো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে লক্ষ্য করে হেলমেটও ছুড়ে মেরেছেন। এজন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিরাপত্তা ঝুঁকি মনে করে তাদের হ্যান্ডকাপ পরিয়েছে।
এই চিত্র যেন এক বাস্তবতাকে আমাদের সামনে এনে দেয়—ক্ষমতার অপব্যবহারের মূল্য চূড়ান্ত হয় দেরিতে হলেও নিশ্চিতভাবে। দু'দশক ধরে যাদের নেতৃত্বে গড়ে উঠেছে ক্ষমতার দুর্গ, তাদের এই পতন শুধু রাজনীতির এক অধ্যায়ের ইতি নয়, বরং জনগণের কাছে এক সতর্কবার্তা।
একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলছিলেন—“এটি আমাদের জন্য ইতিহাসের আয়না—যেখানে ক্ষমতা, অহংকার আর অন্যায়ের ফলাফল একসময় ধরা পড়ে।”
এই ১৯ জন সাবেক প্রভাবশালী নেতার বিরুদ্ধে বিচার চলছে। প্রমাণিত হলে শাস্তি অনিবার্য। তবে প্রশ্ন রয়ে যায়—এই বিচার কি শুধুই প্রতীকী? নাকি এটি হয়ে উঠবে রাজনৈতিক জবাবদিহির যুগান্তকারী দৃষ্টান্ত? গণতন্ত্রের সৌন্দর্য তখনই খুঁজে পাওয়া যায়, যখন আইনের সামনে সবাই সমান।
ফারুক