
প্রেশার গ্রুপের কারণে সরকারকে কর অব্যাহতি দিতে হয়
প্রতিবছর বাজেটের সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক, ব্যবসায়িক ও প্রশাসনিক প্রেশার গ্রুপের কারণে সরকারকে কর অব্যাহতি দিতে হয়। এতে সরকারের যে দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য থাকে তা বিচ্যুত হয় বলে মনে করেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। সোমবার ধানম-ির সিপিডি কার্যালয়ে আয়োজিত ‘করপোরেট ইনকাম ট্যাক্স রিফর্ম ফর গ্র্যাজুয়েটিং বাংলাদেশ: ট্যাক্স জাস্টিস পারসপেক্টিভ’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এমনটা জানান।
ড. মোয়াজ্জেম বলেন, সরকারের যে স্মুথ ট্রানজিশন পিলার আছে তার প্রথমে রয়েছে অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি। রাজস্ব আহরণের ৪০ শতাংশ আসে পরোক্ষ কর বা ভ্যাট থেকে এবং ২০ শতাংশ আসে করপোরেট ট্যাক্স থেকে। সুতরাং উত্তরণকালে এই দুটি খাত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কর ন্যায্যতার ভিত্তিতে করপোরেট কর হার সংস্কার ও কর ন্যায্যতার ভিত্তিতে ভ্যাট সংস্কার করা দরকার। কিন্তু প্রতিবছর বাজেট এলে বিভিন্ন ধরনের প্রেশার গ্রুপ তৈরি হয়। তারা সরকারের ওপর চাপ দিতে থাকে কর হার কমানোর জন্য। এর ফলে কর হার নিয়ে সরকারের যে সামগ্রিক দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য তা বিচ্যুত হয়।
তিনি বলেন, ২০২৬ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশে উত্তরণ হবে। উত্তরণকালীন সহায়তার জন্য সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ অব্যাহত আছে। কিন্তু এই উদ্যোগ অনেক সময় সীমাবদ্ধ থাকে স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে যে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা রয়েছে তা অব্যাহত থাকবে কিনা, নতুন করে ভর্তুকি পাওয়ার উপায় এ ধরনের আলোচনায়। এমনকি সংস্কার উদ্যোগ নেওয়া হলেও সেখানে ভর্তুকি অব্যাহত রাখা এবং খুব বেশি হলে রপ্তানি বহুমুখীকরণের ওপর কথা বলা হয়।
এলডিসির স্মুথ ট্রানজিশনকালে সরকারের যে কোনো কৌশল বাস্তবায়নে অভ্যন্তরীণ রাজস্ব বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই এমনটা জানিয়ে তিনি বলেন, আগামীদিনে সরকার উচ্চমাত্রায় রাজস্ব না পেলে ভর্তুকি, দক্ষতা উন্নয়ন, ক্যাপাসিটি বিল্ডিং অথবা রপ্তানি বহুমুখীকরণের জন্য সহায়তাÑ কোনোটাই সরকারের পক্ষে দেওয়ার সুযোগ তৈরি হবে না। তাই আগামীদিনে অভ্যন্তরীণ রাজস্ব বৃদ্ধিতে কি উদ্যোগ নেওয়া হবে, সেটা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ।
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, কর ফাঁকি ছাড়াও প্রণোদনা ও কর ছাড়ের কারণে সরকার প্রতিবছর বিপুল পরিমাণে রাজস্ব হারাচ্ছে। বিনিয়োগের কথা বলে বিভিন্ন খাতভিত্তিক কর ছাড় দেওয়া হচ্ছে। এগুলো সম্পূর্ণ বন্ধ করা উচিত। প্রণোদনা বা কর ছাড় বিনিয়োগের ভিত্তি হতে পারে না। বাংলাদেশের প্রণোদনা কাঠামো পরিপূর্ণভাবে রাজনৈতিক বিবেচনায় দেওয়া হয়েছে। এই কাঠামো থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে।
তিনি বলেন, সরকারের করের টাকা মূলত সাধারণ জনগণের টাকা। এটা কোনোভাবেই যেনতেন উপায়ে খরচ করার সুযোগ নেই। বিদ্যুতের ক্ষেত্রে ঢালাওভাবে কর রেওয়াত সুবিধা দেওয়া হচ্ছে, এটা ন্যায্য না। কারণ বিদ্যুৎ যারা উৎপাদন করেন তারা তো অন্যান্য বড় কোম্পানির মতো সক্ষমতা রাখেন। আবার কর ব্যয় হিসেবে এনবিআরকে বছরে ৭১ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করতে হয়। এই বিপুল পরিমাণ ব্যয়ের কোনো হিসাব নেওয়া হচ্ছে না। যাকে ইনসেনটিভ দেওয়া হয়, তিনি কি রাজস্বের জন্য উপকারী? এছাড়া কর বৈষম্য দূর করতে এবং আগামীদিনে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য পূরণে যেকোনো মূল্যে ডিজিটাল কর ব্যবস্থা ও আর্থিক লেনদেন নিশ্চিত করতে হবে বলেও তিনি জানান।
এসময় এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনে কর ছাড় ও কর প্রণোদনাকে বড় চ্যালেঞ্জ উল্লেখ করে তিনি বলেন, এলডিসি উত্তরণের পর বহুজাতিক কোম্পানির বিনিয়োগ বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এতে কর ফাঁকি ও কর পরিহারের ঝুঁকিও বাড়বে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সিপিডি প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি কর ব্যবস্থার ডিজিটাল অবকাঠামো উন্নয়ন ও নীতিগত সংস্কারের সুপারিশ করেছে।
সিপিডির গবেষণায় উঠে এসেছে, একদিকে বিপুল পরিমাণ কর ফাঁকি দেওয়া হচ্ছে, অন্যদিকে অনেক প্রতিষ্ঠান কর দিতে গিয়ে সমস্যার মুখে পড়ছে। গবেষণায় অংশ নেওয়া ৪৫ শতাংশ কোম্পানি জানিয়েছে, করপোরেট কর দেওয়ার সময় কর কর্মকর্তারা ঘুষ চেয়েছেন। এ ছাড়া বিদ্যমান কর হার অন্যায্য বলে দাবি করেছে ৮২ শতাংশ কোম্পানি।
কর ফাঁকির উদাহরণ টেনে সিপিডির এই গবেষণা পরিচালক বলেন, কর ফাঁকির কারণে ২০২৩ অর্থবছরে (২০২২-২৩) আনুমানিক ২ লাখ ২৬ হাজার ২৩৬ কোটি টাকা রাজস্ব হারিয়েছে বাংলাদেশ। ২০১২ সালে কর ফাঁকির এই পরিমাণ ছিল ৯৬ হাজার ৫০৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ গত ১১ বছরে দেশে কর ফাঁকির পরিমাণ দ্বিগুণের বেশি হয়েছে।
এর আগে মূল প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন সিপিডির জ্যেষ্ঠ গবেষণা সহযোগী তামিম আহমেদ। তিনি বলেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির জন্য গণহারে বিপুল অর্থ ব্যয় অন্যায্য। অথচ এ খাতে অর্থ অপচয়ের জন্য অন্য খাতে চাপ বাড়ছে। তিনি বলেন, ডিজিটালাইজেশন কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা আমরা দেখতে পাচ্ছি। ব্যবসায়ী ও এনবিআরের স্বার্থে এটা করা জরুরি। অথচ এনবিআর ও ব্যবসায়ীদের এক ধরনের অনীহা রয়েছে। বাংলাদেশে যে কোনো লেনদেন একক ডিজিটাল সিস্টেমের মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। যাতে করে যে কোনো লেনদেন ট্রেস ও ট্রাক করা যায়। সেটার আলোকে দাখিলকৃত রিটার্নকে যাচাই করা যায়।
একইসঙ্গে কর হার বৃদ্ধিতে সিপিডির কিছু সুপারিশমালাও তুলে ধরেন তামিম আহমেদ। তিনি বলেন, দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে সামনের বাজেটে সর্বনি¤œ কর ১৫ শতাংশ করতে পারে আর ক্যাপিটাল মার্কেটে ঢালাওভাবে আড়াই শতাংশ কর ছাড় বন্ধ করতে হবে। বরং কোম্পানির অবস্থাভেদে তা হতে পারে। কর আদায়ে একটি নির্দিষ্ট ফ্রেমওয়ার্ক ও কমিটি থাকতে হবে। করের অমীমাংসিত ইস্যু কমিটির মাধ্যমে নিষ্পত্তি হবে। করপোরেট প্রতিষ্ঠানের মুনাফা বৃদ্ধি করে কর বাড়ানো যেতে পারে।
নিবন্ধনকৃত কোম্পানির মধ্যে যারা কর দেয় না তাদের তালিকা প্রকাশ করে তাদের বিষয়ে জনগণকে অবহিত করতে হবে। স্কুল-কলেজের বাচ্চার মাধ্যমে কর রিটার্ন জমা দিয়ে কর প্রদানে নাগরিকদের উদ্বুদ্ধ করা যেতে পারে। কর পদ্ধতি শতভাগ ডিজিটাল করা। বিদ্যুতে অন্যায্য কর প্রণোদনা বন্ধ করতে হবে। করের জন্য বিশাল ব্যয় খাত প্রকাশ করা।
মূলত কর কর্মকর্তার কর টার্গেট বন্ধ করা এবং কর আদায়ের ওপর বোনাস বন্ধ করা। যাতে তিনি কর আদায়ে জোর জবরদস্তি না করেন। প্রয়োজনে কর কর্মকর্তার হয়রানি ও ঘুষ বন্ধে কর আদায় প্রক্রিয়া ভিডিও বা সিসি টিভির আওতায় আনা। অবৈধ টাকা এবং পাচারের অর্থ ফেরাতে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া।