ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২২ এপ্রিল ২০২৫, ৮ বৈশাখ ১৪৩২

প্রধান উপদেষ্টার কাছে শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন হস্তান্তর

সামাজিক নিরাপত্তা স্কিমে শ্রমিকদের অন্তর্ভুক্তির সুপারিশ

বিশেষ প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ২৩:০৯, ২১ এপ্রিল ২০২৫

সামাজিক নিরাপত্তা স্কিমে শ্রমিকদের অন্তর্ভুক্তির সুপারিশ

প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠক শেষে ফটোসেশনে অংশ নেন

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে শ্রম সংস্কার কমিশন। সোমবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রতিবেদন হস্তান্তর করা হয়। প্রতিবেদনে শ্রম সংস্কার কমিশন সুপারিশগুলোর মধ্যে ২৫টি মূল সুপারিশকে গুরুত্বারোপ করেছে। 
চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান ও শ্রমিক আন্দোলনে নিহত সব শ্রমিককে রাষ্ট্র কর্তৃক শহীদের স্বীকৃতি প্রধান, শ্রমিকদের প্রত্যেকেরই অবসর, কর্ম অক্ষমতা, অসুস্থতা, মাতৃত্বকালীন সময় বা যে কোনো প্রতিকূল অবস্থায় সামাজিক নিরাপত্তা প্রাপ্তি এবং কোনো না কোনো সামাজিক নিরাপত্তা স্কিমে অন্তর্ভুক্তির সুপারিশ করেছে শ্রম সংস্কারবিষয়ক সংস্কার কমিশন। একইসঙ্গে সব শ্রমিকের আইন সুরক্ষা নিশ্চিত করারও সুপারিশ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, দেশে আট কোটি শ্রমজীবী মানুষ আছেন।

তার মধ্যে ৮৫ শতাংশ বা ৭ কোটি শ্রমিকের আইনি সুরক্ষা নেই। শ্রমবিষয়ক সংস্কার কমিটি এই শ্রমিকদের আইনি সুরক্ষা নিশ্চিতের সুপারিশ করেছে। এছাড়াও কর্মক্ষেত্রে সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখার স্বার্থে বিশেষ সুপারিশ করেছে কমিশন। সেগুলো হলো, শ্রম আইনে মহিলা শব্দের পরিবর্তে নারী শব্দ ব্যবহার এবং কর্মক্ষেত্রে ‘তুই/তুমি’ সম্বোধন বন্ধ করা।
শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন দাখিলের পর প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে কমিশনের সুপারিশ সম্পর্কে সাংবাদিকদের অবহিত করেন প্রধান উপদেষ্টার উপপ্রেস সচিব মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ মজুমদার। সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, দেশের শ্রমিকদের জন্য জাতীয় ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের সুপারিশ করেছে কমিশন।

লক্ষ্য হলো, কোনো শ্রমিক যেন তার চেয়ে কম মজুরি না পান, তা নিশ্চিত করা। সেই সঙ্গে শ্রমিকদের নিবন্ধন থেকে শুরু করে পরিচয়পত্র দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। সাম্প্রতিক শ্রমিক আন্দোলনে শ্রমিকদের বিরুদ্ধে যেসব মামলা করা হয়েছে, সেসব মামলা দ্রুত প্রত্যাহার করারও কথাও বলেছে কমিশন।
শ্রমিকদের সংগঠন করার অধিকার নিশ্চিত এবং তাদের দর-কষাকষি করার প্রক্রিয়া যেন আরও সহজ হয়, তা নিশ্চিত করার সুপারিশ করা হয়েছে। কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি দূর করতে ২০০৯ সালের হাইকোর্টের নির্দেশনার আলোকে যৌন নিপীড়নবিরোধী নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের সুপারিশ করেছে কমিশন। সেই সঙ্গে নারীদের মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাস করার কথা বলা হয়েছে, যে সুপারিশ অন্য কমিশনও করেছে।
সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে শ্রমিকদের কল্যাণে সর্বজনীন তহবিল করার সুপারিশ করা হয়েছে। সেই সঙ্গে শ্রম আদালতসহ আপিল বিভাগের সর্বক্ষেত্রে যেন বাংলা প্রচলন করা হয়, তা নিশ্চিত করার সুপারিশ করা হয়েছে। সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারী-পুরুষের সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে।
জানা গেছে, প্রধান উপদেষ্টার কাছে দেওয়া শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, শ্রম খাতে দুর্ঘটনা বা অবহেলাজনিত কারণে নিহতদের ক্ষতিপূরণ ও আহতদের পুনর্বাসন, চিকিৎসার জন্য রাষ্ট্রীয় যথাযথ নীতি গ্রহণ করা উচিত। একইসঙ্গে রানা প্লাজা, তাজরিন গার্মেন্টস এবং হাসেম ফুডসহ উল্লেখযোগ্য কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় দায়ীদের দ্রুত বিচার ও শাস্তির আওতায় আনার সুপারিশ করা হয়েছে।  সুপারিশে সব শ্রমিকের আইনি সুরক্ষা ও স্বীকৃতির কথা বলা হয়েছে।

এক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক, অপ্রাতিষ্ঠানিক, কৃষি, গৃহভিত্তিক, অভিবাসী, স্বনিয়োজিত শ্রমিকসহ সব শ্রমিকের জন্য রাষ্ট্র কর্তৃক শ্রম আইনের সুরক্ষা নিশ্চিত করার সুপারিশ করা হয়েছে। এই লক্ষ্যে কাজের স্বীকৃতি ও পরিচয়পত্র নিরবচ্ছিন্ন কাজ এবং আয়ের নিশ্চয়তা, মর্যাদাকর-শোভন কর্ম পরিবেশ, অস্থায়ী ও এজেন্সি নির্ভর নিয়োগের ক্রমবর্ধমান প্রবণতা রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হয়েছে।
সুপারিশে নিজের ও পরিবারের মর্যাদাকর জীবনযাপন উপযোগী ন্যায্য মজুরি (লিভিং ওয়েজ), উন্নয়নে ন্যায্য অংশীদারত্ব ও হিস্যা-প্রাপ্তির অধিকার, প্রত্যেকের জন্য নিরাপদ কাজ ও স্বাস্থ্যসম্মত কর্মপরিবেশ, দুর্ঘটনায় যথাযথ ক্ষতিপূরণ এবং নিজের ও পরিবারের সাধারণ স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার অধিকার, প্রত্যেকেরই অবসর, কর্ম অক্ষমতা, অসুস্থতা, মাতৃত্বকালীন সময় বা যে কোনো প্রতিকূল অবস্থায় সামাজিক নিরাপত্তা প্রাপ্তি এবং কোনো না কোনো সামাজিক নিরাপত্তা স্কিমে অন্তর্ভুক্তি, প্রত্যেকের অধিকার সুরক্ষা ও ন্যায্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করার জন্য সংগঠিত হওয়া, সমষ্টিগতভাবে প্রতিনিধিত্ব করার, অধিকার লঙ্ঘনে অভিযোগ জানানো, প্রতিকার ও ন্যায়বিচার পাওয়ার নিশ্চয়তার কথা বলা হয়েছে। 
প্রতিবেদনে বলা হয়, এই অধিকারগুলো নিশ্চিতকরণে, সরকার কর্তৃক দেশের সংবিধান, আইএলও কনভেনশন ও কর্মক্ষেত্রে মৌলিক নীতিমালা ও অধিকার সংক্রান্ত ঘোষণা, শোভন কাজের মানদণ্ড এবং মানবাধিকার ও ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক দায়বদ্ধতার আলোকে, যথাযথ ত্রিপক্ষীয় পদ্ধতি অনুসরণ করে বর্তমান শ্রম আইনের প্রয়োজনীয় এবং মৌলিক সংস্কার অথবা একাধিক আইন প্রণয়ন করা এবং কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের ব্যবস্থা গ্রহণ করার কথা বলা হয়।
প্রসঙ্গত, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গত বছরের ১৭ নভেম্বর বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিআইএলএস) এর নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদকে প্রধান করে ১০ সদস্যের একটি শ্রম সংস্কার কমিশন গঠন করে।
কমিশনের অন্য সদস্যরা হলেন- শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব ড. মাহফুজুল হক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের অধ্যাপক ড. জাকির হোসেন, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র টিইউসির চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিটির সভাপতি তপন দত্ত, বাংলাদেশ লেবার কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট একেএম নাসিম, বাংলাদেশ এমপ্লয়ার ফেডারেশনের সাবেক সভাপতি এম কামরান টি রহমান, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘের সভাপতি চৌধুরী আশিকুল আলম, বাংলাদেশ লেবার ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক শাকিল আখতার চৌধুরী, আলোকচিত্রী ও শ্রমিক আন্দোলনের সংগঠক তাসলিমা আখতার এবং একজন ছাত্র প্রতিনিধি।

×