
ছবি: সংগৃহীত।
বাংলাদেশের ব্যাংকিং ইতিহাসে বর্তমানে যেই অধ্যায় রচিত হচ্ছে, তা যেন রক্ত দিয়ে লেখা কোনো উপন্যাস নয়, বরং অন্ধকারে মোড়ানো এক দুর্নীতির সাম্রাজ্যের বিবর্ণ দলিল। যেখানে বিচার নয়, বরং অলিগার্কদের পৃষ্ঠপোষকতায় বহাল তবিয়তে চলছে টাকার খেলা। এই খেলার সবচেয়ে আলোচিত নাম—এস আলম গ্রুপ এবং তাদের উত্তরসূরি দুই পুত্র, আশরাফুল আলম ও আসাদুল আলম।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) এক মহাব্যবস্থাপকের বিস্ফোরক বক্তব্যে যে তথ্য উঠে এসেছে, তা কল্পকাহিনীকেও হার মানায়। সিঙ্গাপুরে নাগরিকত্ব পেতে লাগে সাদা টাকার প্রমাণসহ ন্যূনতম ২৫০ কোটি টাকা। এস আলমের দুই ছেলে এই শর্ত পূরণ দেখালেও, তদন্তে বেরিয়ে আসে—ঐ অর্থ জালিয়াতি ও অর্থপাচারের ফসল।
তদন্ত সংস্থার ব্যাংক হানার পরই গায়েব হয়ে যায় কোটি টাকার পে-অর্ডার। পে-অর্ডার, ক্লিয়ারিং ডেট, উৎস গোপন, এমনকি ব্যাংকিং সিস্টেমের ভিতরে আরেকটি “সিস্টেম”—এই ষড়যন্ত্রে নীরব সহযোগী হয়ে উঠেছে গোটা আমলাতন্ত্রের একটি অংশ। চাকরি হারানোর আতঙ্কে অনেকে চুপ থেকেছেন, কিন্তু সিআইডির তদন্তে ফাঁস হয় ১.১৩ ট্রিলিয়ন টাকার অর্থপাচার।
এস আলম গ্রুপ সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, সাইপ্রাস, ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে কোম্পানি খুলে অর্থপাচারের নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে। ক্যানলি লজিস্টিক্স প্রাইভেট লিমিটেড, যার মূলধন ২২.৩৪ মিলিয়ন ডলার—সবই পাচার করা টাকা।
এস আলম গ্রুপ ও তাদের সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় ব্যাংকটির এবং প্রায় ৭৩১.১৩ বিলিয়ন টাকা ঋণ নেয়—যা ব্যাংকটির মোট ঋণের প্রায় ৫০ শতাংশ। অথচ জামানত ছিল মাত্র ৪৩.৫৯ বিলিয়ন টাকা।
সিঙ্গাপুরে এক বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা গড়েছে এস আলম গ্রুপ, বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি ছাড়াই। ঢাকার আদালত এস আলম ও পরিবারের ৪২ কোম্পানির ৪৩৭.৮৫ কোটি শেয়ার জব্দের নির্দেশ দেয় (মূল্য: প্রায় ৫১০৯ কোটি টাকা), ১৩ হাজার ৬৭ ডেসিমেল জমি জব্দের আদেশ দেওয়া হয়, ছয়টি কারখানা বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে, ১০ বিলিয়ন ডলারের বেশি পাচারের অভিযোগ এনেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর, ১৭ বিলিয়ন ডলার লোপাটের অভিযোগ উঠেছে সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তায়।
বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে বাংলাদেশের জিডিপি ছিল ৪৩৭.৪২ বিলিয়ন ডলার। আর এস আলমের এই অর্থলুটের পরিমাণ জিডিপির প্রায় চার শতাংশ—একটি ব্যক্তিগত গ্রুপের হাতে দেশের অর্থনীতির বড় একটি অংশের লুটপাট!
এর পাশাপাশি সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (BSEC) এস আলম ও সালমান এফ রহমানের বিরুদ্ধে শেয়ারবাজারে দুর্নীতির তদন্তে চার সদস্যের কমিটি গঠন করেছে।
এস আলম গ্রুপ এখন শুধু একটি ব্যবসায়ী পরিবারের নাম নয়, বরং বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থার ওপর চেপে বসা এক ভয়ংকর ছায়া। এই ছায়া সরাতে হলে কেবল তদন্ত নয়—চাই রাজনৈতিক সদিচ্ছা, বিচারিক স্বচ্ছতা এবং জনগণের জবাবদিহিতার দাবি।
নুসরাত