
আয়নাঘর পরিদর্শন ও উদ্ঘাটনে কেউ আমাদের সহযোগিতা করেনি। আমরা নিজেরাই খুঁজে খুঁজে সিক্রেট সেলগুলো বের করেছি। অধিকাংশ আলামত মুছে ফেলা হয়েছে। কিন্তু, তারা চায়নি আমরা সেনা ছাউনির ভিতরে সিক্রেট সেল ভিজিট করি বলে মন্তব্য করেছেন গুম সংক্রান্ত সরকারি তদন্ত কমিশনের সদস্য ও মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন।
গতকাল ২০ এপ্রিল রবিবার বাংলাদেশ সময় রাত নয়টায় যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস এন্ড ডেভেলপমেন্ট ফর বাংলাদেশ (এইচ আর ডি বি) আয়োজিত-"বাংলাদেশের আয়নাঘরের বিভীষিকা : ন্যায়বিচার ও উত্তরণের পথ" শীর্ষক একটি ওয়েবিনারে তিনি এ মন্তব্য করেন।
মানবাধিকারকর্মী ড. রেজাউল হাসান রিয়াজ-এর সঞ্চালনায় সেমিনারে অতিথি হিসেবে আরো যুক্ত ছিলেন আয়নাঘর সারভাইভার ব্যারিস্টার মীর আহমাদ বিন কাশেম আরমান। অনুষ্ঠানে গবেষক, সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী, শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ অংশগ্রহণ করেন।
মীর আহমাদ বিন কাশেম আরমান আয়নাঘরে থাকার ভয়াবহ অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন,"আমাকে ২৪ ঘণ্টা বেঁধে রাখা হতো,রাত থেকে সকাল পর্যন্ত হাত পেছন দিক দিয়ে, আবার সকাল থেকে রাত পর্যন্ত হাত সামনে থেকে। আমাদেরকে সময়, স্থান,কোনো কিছুই বলা হতো না, এমনকি নামাজের সময়ও না। আমাকে হাত বাঁধা অবস্থায় নামাজ পড়তে হতো। যখন জিজ্ঞেস করতাম,আমাকে এভাবে বন্দি করে রাখা কেন? তারা বলত, ‘উপরের আদেশ’।"
আরমান আরো বলেন,"আমাকে যেখানে নেওয়া হয়েছিল, যদি আমাকে সেখানে না নেওয়া হতো, তাহলে আমার পক্ষে বিশ্বাস করা কঠিন হতো,বাংলাদেশের নাগরিকদের সাথে এরকম আচরণের ব্যবস্থা রয়েছে।"
তিনি তাঁর ওপর হওয়া অন্যায়ের বিচার দাবি করে বলেন,"যা আমার সঙ্গে ঘটেছে, তা যেন গোটা বিশ্ববাসী জানতে পারে এবং এমন একটি আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্য বিচার হয়, যার মাধ্যমে ভুক্তভোগীরা ন্যায়বিচার পাবে। যাদের প্রিয়জন ফিরে আসেনি, তাদের পরিবার অন্তত এতটুকু শান্তি পাবে,জানতে পারবে, যারা জড়িত ছিল, তারা শাস্তি পেয়েছে।"
গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের সদস্য ও বিশিষ্ট মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন বলেন,"আমরা যা কিছু উদ্ঘাটন করেছি, সবই ভিকটিমদের বক্তব্য ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে। ভিকটিমদের এমন জায়গায় রাখা হতো, যেখানে প্রস্রাব, পায়খানা ও শোয়ার জায়গা ছিল একই। আমরা কল্পনাও করতে পারিনি, একটি সেল টেবিলের মতো আকৃতির হতে পারে! প্রত্যেকটি সেলই ছিল এক একটি নির্যাতনের বাক্স। নির্যাতনের মাত্রা ছিল ভয়াবহ,ঘূর্ণায়মান ইলেকট্রিক চেয়ারে বসানো, শরীরে পিন ঢোকানো, নখ তুলে ফেলা, সারা শরীরে পিটুনি,এসব ছিল নিত্যনৈমিত্তিক। আদিম যুগে পশুর সঙ্গে যেমন আচরণ করা হতো, মানুষের সঙ্গে ঠিক তেমন আচরণ করা হয়েছে।"
তিনি আরও বলেন,"অধিকাংশ ভিকটিমকে জঙ্গির তকমা লাগানো হয়েছে। কেউ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে মসজিদে যায়, কোনো আলোচনায় অংশ নেয়, কিংবা কোনো ইসলামী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত,এমন সন্দেহেই তাদের টার্গেট করা হয়েছে। বিগত সময়ে বাংলাদেশে ধর্মীয় স্বাধীনতা লঙ্ঘন করা হয়েছে এবং ধর্ম পালন করার কারণে মানুষ নির্যাতনের শিকার হয়েছে।"
এখন পর্যন্ত নিখোঁজ গুম হওয়া ব্যক্তিদের সম্পর্কে নূর খান লিটন বলেন,"এখন পর্যন্ত প্রায় ২০০ জনের খোঁজ মেলেনি; তাদের জীবিত থাকার সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ।"
তদন্তের অগ্রগতি ও বিচার প্রসঙ্গে তিনি জোর দিয়ে বলেন,"বিচার অবশ্যই হবে। যারা মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে, তারা পার পাবে না।"
সেমিনারের সমাপনী বক্তব্যে এইচ আর ডি বি সেক্রেটারি জনাব দেলওয়ার মজুমদার সরকারের প্রতি পাঁচ দফা দাবি তুলে ধরেন-
১. সারা দেশে যত আয়নাঘর রয়েছে, সেগুলো অনতিবিলম্বে খুঁজে বের করে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক মিডিয়ার মাধ্যমে জাতিকে জানাতে হবে।
২. এসব আয়নাঘরের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের দ্রুত গ্রেফতার করে ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে বিচারের আওতায় আনতে হবে।
৩. গত ১৬ বছরে গুম হওয়া হাজারো বিরোধী দলীয় নেতা-কর্মীদের, যাদের অনেকের আজও কোনো খোঁজ মেলেনি, তাদের সন্ধানে ও দায়ীদের বিচারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
৪. আয়নাঘরের কারণে ক্ষতিগ্রস্তদের যথাযথ চিকিৎসা ও আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
৫. সংবিধান সংস্কার, ক্ষমতার ভারসাম্য, জবাবদিহিতা, পরস্পর নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য রক্ষা পদ্ধতি নিশ্চিত করে এমন একটি সরকার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে, যাতে এ ধরনের বর্বরতা ভবিষ্যতে আর না ঘটে।
সভায় অংশগ্রহণকারী গবেষক, সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী ও শিক্ষার্থীরা ন্যায়বিচার নিশ্চিতকরণ, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের নৃশংসতা রোধে কার্যকর ও টেকসই পদক্ষেপ গ্রহণের ওপর জোর দেন।
আফরোজা