
.
টাঙ্গাইলের মধুপুরের মান্দি গ্রাম গায়রাতে হয়েছে শ্রাদ্ধ। শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানে এসেছেন তাদের আত্মীয়স্বজন। তাদের চাচ্চি মাহারির লোকজন। কেউ এসেছেন শুকর চাল নিয়ে, কেউ এসেছেন মুরগি, চালসহ নানা জিনিসপত্র নিয়ে। এভাবে সবাই যার যার অবস্থান থেকে নিয়ে এসেছেন জিনিসপত্র। আপ্যায়নের জন্য পুরো বাড়ি ঘিরে শামিয়ানা টানিয়ে রাখা হয়েছে। চেয়ার, বেঞ্চ, টেবিল নিয়ে বসে বসে সবাই খাচ্ছেন। রয়েছে খাবার দেওয়ার লোকজন। পাশেই চলছে একদল যুবকের রান্নার কাজ। রাবার পাতায় মোড়ানো হচ্ছে ভাত, তরকারি। বাড়ির দক্ষিণ কোনে কয়েক নারী বসে বসে গুনগুন করে কান্না করছেন। সামনেই কাঠের দুটি থাম্মার মতো পোঁতা রয়েছে। থাম্মার মাথায় ধুতি বাঁধা। পাশাপাশি দুটি থাম্মা। বসে থাকা নারীরা জানালেন, এটি তাদের সাংসারেক নিয়মের খাম্মা বা স্মৃতিস্তম্ভ। মৃত ব্যক্তি দুজন স্বামী-স্ত্রী। তাদের স্মরণে প্রার্থনা করেছেন তারা। মৃত ব্যক্তি দুজনের শ্রাদ্ধ। স্মরণ করেছেন সবাই।
সকালে তাদের সাংসারেক খামাল পুরোহিত এসে খাম্মার যাবতীয় নিয়মকানুন করে যান। তারপর থেকে শ্রাদ্ধতে আসা লোকজনেরা সবাই আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের কার্যক্রম করে যাচ্ছেন। এমনটি জানালেন, গায়রা গ্রামের গারো সম্প্রদায়ের খাম্মা সঙার নানা কথা। এ খাম্মা রীতি তাদের আদি গারো সম্প্রদায়ের সাংসারেক সময় থেকে পালন করে আসা নিয়ম। এখন খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হলেও মধুপুরে এখনো টিকে আছে তাদের এ খাম্মা বা খিম্মা সঙা ঐতিহ্য।
জানা যায়, ভারতের উত্তর-পূর্ব ভারতীয় রাজ্য মেঘালয়, অসম, ত্রিপুরা ও নাগাল্যান্ড এবং বাংলাদেশের গারো পাহাড়, বৃহত্তর ময়মনসিংহ ও সিলেটে গারো সম্প্রদায়ের বসবাস রয়েছে। খাসিয়াদের পরেই গারোরা মেঘালয়ের দ্বিতীয় বৃহত্তম নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী। গারোরা সাধারণত নিজেদের মান্দি হিসেবে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। মান্দি শব্দের অর্থ মানুষ। বৃহত্তর ময়মনসিংহে বসবাস করা গারোরা ব্রহ্মপুত্র নদের পূর্ব-উত্তরকে আপাল আর পশ্চিম-দক্ষিণ অংশ আবিমা বলে আখ্যায়িত করে থাকে।
গারো সম্প্রদায়ের লোকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গারোদের প্রধান দেবতার নাম তাতারা রাবুগা। এ ছাড়াও অন্যান্য দেবতা মিসি সালজং, সুসমি, গয়ড়াসহ অনেক দেবতা পূজা পার্বণ করে থাকে। সাংসারেক রীতি অনুসারে নানা ধরনের অনুষ্ঠান রীতিনীতি পালন করা হতো। এখন খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হওয়ার কারণে তাদের আদি সাংসারেক ঐতিহ্যে ভাটা পড়ে যাচ্ছে।
এক সময় সাংসারেক গারোদের ‘খিম্মা সঙা’ প্রথা ছিল। খিম্মা বা খাম্মা গারো বা আচিক শব্দ। এর অর্থ স্মৃতিস্তম্ভ। সঙা হলো পোঁতা। সাংসারেক গারোদের আদি ঐতিহ্য অনুযায়ী কোনো মানুষ মারা গেলে মৃত ব্যক্তির স্মৃতি রক্ষার্থে এ খিম্মা সঙা করা হতো। কাঠের খোদাই করা খুঁটি দিয়ে খিম্মা দেওয়া হতো। খিম্মায় সাংসারেক প্রথা অনুসারে ৫ বা ৭টি খাঁচ রাখা হতো। মৃত ব্যক্তি পুরুষ হলে খিম্মার ওপর দিকে জাঙ্গি বা খাঁচ রাখা হতো। আর নারী হলে নিচের দিকে জাঙ্গি বা খাঁচ রাখা হতো। খিম্মার উপরের দিকে মাথার মতো রাখা হয়।
খিম্মা পুঁতে রাখা হতো বাড়ির উঠানের সামনের এক কোনে। নারী-পুরুষ ভেদে পালন করা হতো নানাবিধ নিয়মকানুন। নারী হলে নারীদের পোশাক দকশাড়ি, গহনা আর পুরুষ হলে ধুতি, খুতুপ খিম্মায় পরিয়ে রাখা হতো। আরও সাংসারেক আদি ঐতিহ্য মতে, নানা প্রথা নিয়ম অনুযায়ী মানা হতো। খিম্মা প্রথা গারো আদি ঐতিহ্যবাহী একটি প্রাচীন প্রথা। এক সময় এ প্রথা সাংসারেক গারোরা পালন করত। ধীরে ধীরে এ খিম্মা বা খাম্মা প্রথা হারিয়ে যাচ্ছে। অন্যান্য এলাকায় তেমন দেখা না গেলেও মধুপুর এলাকায় এক সময় অনেক বাড়িতে ছিল। এখন আর আগের মতো নেই। খিম্মা প্রথা কমে যাচ্ছে। মধুপুরের বিভিন্ন গারো পল্লি ঘুরে তাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
মধুপুর আবিমা অঞ্চলে বিভিন্ন গারো পল্লিতে ঘুরে কিছু কিছু বাড়িতে এ খিম্মা দেখা যায়। আবার অনেক বাড়িতেই খিম্মা নেই। মধুপুরের গারোদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদের কার্যালয়ের সামনে সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে অন্যতম প্রয়াত পরেশ মৃর খিম্মা স্থাপন করেছে। তার স্মৃতি রাখার জন্য সংগঠনের পক্ষ থেকে এ খিম্মা স্থাপন করা হয়। পাহাড়িয়া এলাকার চুনিয়া গ্রামে সাংসারেক গারো খামাল প্রয়াত জনিক নকরেকের বাড়িতেও খিম্মা প্রথা রয়েছে। তিনি ছিলেন মধুপুর আবিমা অঞ্চলের সাংসারেক গারোদের খামাল বা পুরোহিত। সাইসনামারি গ্রকমে প্রয়াত রাগেন্দ্র নকমার বাড়িতেও রয়েছে খিম্মা। শহীদ পীরেনের নামেও বন এলাকার ঝালাবাঁধায় করা হয়েছে খিম্মা। এভাবে সাংসারেক গারোদের আদি ঐতিহ্য কিছু কিছু বাড়িতে দেখা গেলেও এ খিম্মা প্রথাটি অনেক এলাকা থেকে হারিয়ে যাচ্ছে।
জয়েন শাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি ইউজিন নকরেক বলেন, সাংসারেক গারোরা যখন জুম চাষ করত। তখন পাহাড়ে পাহাড়ে থাকত। যেখানে যখন জুম ফলাত, সেখানেই থাকত। তাদের কেউ মারা গেলে পুড়ে ফেলত। ছাই এনে দাফন করত। পরে বাড়িতে নিকটাত্মীয় মামা-ভাইরাসহ অন্যদের সঙ্গে নিয়ে শূকর, মদ, মুরগি দিয়ে খিম্মা বা খাম্মা স্থাপন করত। শুকুর মুরগির রক্ত স্থাপিত খাম্মার ওপরে দেওয়া হতো, যাতে মৃত ব্যক্তির আত্মা শান্তি পায়।
তিনি বলেন, এ খাম্মা কাঠ দিয়ে দিতে হয়। তাদের সাংসারেক বিশ্বাস মতে ঐতিহ্যবাহী চু বা মদ আত্মীয়স্বজনরা খাম্মায় মৃত ব্যক্তির আত্মার শান্তির জন্য ঢেলে দেয়। শ্রাদ্ধ দেওয়ার আগে এ নিয়ম পালন করে থাকে। তার মতে, খাম্মার নিয়মমতো খরচ করতে না পারা, আধুনিকায়ন, শহরমুখী মনোভাব ও খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার কারণে এখন অনেকটা কমে যাচ্ছে।