
বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্কের গতি সঞ্চার হতে শুরু করেছে
বিগত সরকারের পতনের পর বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্কের গতি সঞ্চার হতে শুরু করেছে। দীর্ঘ ১৫ বছর পর পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব আমনা বালুচের বাংলাদেশ সফরে দু’দেশের পররাষ্ট্র সচিবদের ষষ্ঠ ফরেন অফিস কনসালটেন্সি (এফওসি) হয়েছে। দুই পররাষ্ট্র সচিবের এই বৈঠকে সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য অভিন্ন ভিত্তি খুঁজে পেয়েছেন। ২০১০ সালের পর এটিই সর্ব্বোচ্চ কূটনৈতিক বৈঠক।
এর আগে দুটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে সাইড লাইনে দু’দফায় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফের সঙ্গে বৈঠক করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মোহাম্মদ ইউনূস। এর পরই দু’দেশের মাঝে কূটনৈতিক জট খুলতে শুরু করেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, অভিন্ন ইস্যুগুলোর দ্রুত সমাধানই এই সম্পর্ক উন্নয়নে নতুন মাত্রা পেতে পারে। এজন্য সর্ব্বোচ্চ রাজনৈতিক পর্যায়ে মীমাংসা হতে হবে।
দুই দেশের সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার বিষয়ে বিশ্লেষকরা বলছেন, পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের ধর্মীয় মিল থাকলেও বাণিজ্যিকভাবে বাংলাদেশের সম্পর্ক কতটুকু সফলতা আনবে সে বিষয়ে লক্ষ্য রেখে সামনের দিকে অগ্রসর হওয়া প্রয়োজন। পাকিস্তানে বাংলাদেশের পণ্যের গ্রহণযোগ্যতা কেমন, দেশটির সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক এগুতে চাইলে ব্যবসায়ীদের লাভের বিষয়গুলো মাথার রেখে সম্পর্ক উন্নয়নে অগ্রসর হতে পারলে উভয় দেশের সম্পর্ক উন্নয়ন স্থায়ী হবার সম্ভাবনা রয়েছে।
তবে পাকিস্তানের অনেক পণ্য বাংলাদেশের জনগণ ব্যবহার করে। সে দিকটি বিবেচনায় রেখে এগোতে পারলে সম্পর্ক উন্নয়নে কোনো আপত্তি থাকবে না। পাকিস্তানও বাংলাদেশের পণ্য শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে পারলে সম্পর্ক থেকে দেশের লাভ আশা করা যায়।
এফওসি সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক (আইআর) বিভাগের ইমেরিটাস অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহম্মেদ জনকণ্ঠকে বলেন, পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের যে স্থবিরতা এই বৈঠকের মধ্যে দিয়ে সে স্থবিরতা কাটতে শুরু করেছে।
তিনি বলেন, একটি দেশের সঙ্গে অন্য একটি দেশের সম্পর্ক তিনটি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করেই রচিত হয়। পাকিস্তান সে স¤পর্ককে এগিয়ে নিতে চাইলে তাদের উচিত হবে বাংলাদেশের টাকাগুলো ফেরত দেওয়া এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় তখনকার সশস্ত্র বাহিনীর নির্যাতন স্বীকার করে ক্ষমা চাওয়া।
অধ্যাপক ইমতিয়াজ বলেন, এগুলো একটি দেশের রাজনৈতিক বিষয় যেগুলো পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠকে অথবা সামনে আসছে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠকে শেষ করার বিষয় না। দেশ দুটির সর্ব্বোচ্চ প্রধানরাই কেবল সে বিষয়গুলো সমাধান করার ক্ষমতা রাখেন।
দু’দেশের সম্পর্ক উন্নয়নে কে কতটুকু ভূমিকা রাখতে পারে জানতে চাইলে চীনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সি ফয়েজ আহম্মেদ জনকণ্ঠকে বলেন, পাকিস্তানের উচিত হবে অমীমাংসিত ইস্যুগুলোর সমাধান করা। যা সচিব, পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিয়ে হবে না। দেশটির সর্ব্বোচ্চ প্রধানদের মাধ্যমে সুরাহা করা।
তিনি প্রধান উপদেষ্টার এ উদ্যোগকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, প্রধান উপদেষ্টার সকল কর্মকা-কে আমরা সমর্থন করি বিষয়টা এমন না। তবে পাকিস্তানের সঙ্গে অলোচনার সূত্রপাত করাটা নিঃসন্দেহে ভালো উদ্যোগ। আরও ভালো উদ্যোগ হলো প্রধান উপদেষ্টা মুক্তিযুদ্ধের সময়ের অমীমাংসিত ইস্যুগুলো উপস্থাপন করে দুই দেশের সম্পর্কের উন্নয়নের দিকটি তুলে ধরেছেন।
তিনি বলেন, একটি দেশের সঙ্গে অন্য দেশের রাজনৈতিক, কূটনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সম্পর্কগুলো অন্য দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে হয় এটা ভাবা ঠিক না। প্রত্যেক দেশের সঙ্গে প্রত্যেক দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় থাকে, যা প্রতিহিংসাপরায়ণতা দ্বারা বাস্তবায়ন করা যায় না।
তিনি বলেন, ভারত আমাদের প্রতিবেশী দেশ। তাদের সঙ্গে আমাদের ভিন্নতা থাকতে পারে কিন্তু দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে অবশ্যই একে অপরের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা দরকার।
প্রধান উপদেষ্টার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রধান উপদেষ্টা নিজেও বলেছেন ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ভালো। রাষ্ট্রদূত উল্লেখ করেন যদিও সম্পর্কে ঘাটতি যাচ্ছে, তবুও তিনি বলেছেন এটা ভালো দিক এবং বিষয়টি অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
এফওসিতে বাংলাদেশ অমীমাংসিত ইস্যুর সমাধান, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে সেখানকার সশস্ত্রবাহিনীর হামলার জন্য ক্ষমা চাওয়া, দেশ বিভাগের আগে পূর্ব পাকিস্তানের তথা বাংলাদেশের ৪.৫২ বিলিয়ন পাওনা ডলার ফেরত চেয়েছে বাংলাদেশ। যা এফওসির পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্র সচিব গণমাধ্যমকে জানিয়েছে।
এদিকে এফওসি সম্পর্কে পাকিস্তান সরাসরি কিছু না জানালেও পাকিস্তান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। সেখানে ক্ষমা চাওয়া ও টাকা ফেরত দেওয়ার ব্যাপারটি উল্লেখিত না হয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের দ্বিপক্ষীয় আলোচনা ভালো হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়, পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠকের পর বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ‘মুক্তিযুদ্ধে নৃশংসতার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কিংবা স্বাধীনতাপূর্ব অভিন্ন সম্পদের জন্য বকেয়া অর্থ দাবির’ মতো বিষয় ফলাও করে প্রচার করা হয়েছে। কিন্তু পাকিস্তানের দিক থেকে যে বক্তব্য দেওয়া হচ্ছে, তাতে এই অমীমাংসিত বিষয়গুলোর কোনো উল্লেখ নেই।
উল্লেখ্য, গত বৃহস্পতিবার ঢাকায় দুই দেশের সচিব পর্যায়ে ফরেন অফিস কনসালটেশন বা আনুষ্ঠানিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
দেড় দশক পর হওয়া এই বৈঠকে ইসলামাবাদের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারের জন্য অমীমাংসিত বিষয়ের সমাধান চেয়েছে বলে বৈঠক শেষে এক ব্রিফিংয়ে জানান বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মো. জসীম উদ্দিন।
তিনি বলেন, স্বাধীনতাপূর্ব ক্ষতিপূরণ হিসেবে বাংলাদেশ পাকিস্তানের কাছে চার দশমিক ৫২ বিলিয়ন বা ৪৫২ কোটি ডলার ফেরত চেয়েছে।
এছাড়া, এফওসিতে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের নৃশংসতার জন্য আনুষ্ঠানিক ক্ষমা চাওয়ার বিষয়ও তুলেছে ঢাকা। একদিন পর শুক্রবার পাকিস্তানের পক্ষ থেকে ষষ্ঠবারের মতো অনুষ্ঠিত হওয়া পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠক সম্পর্কে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়।
এতে বলা হয়, দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে পুনরুজ্জীবিত করতে যৌথ অঙ্গীকার প্রতিফলিত হয়েছে পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠকে।
বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বিভিন্ন দিক, গাজায় ইসরাইলি হামলার নিন্দা এমনকি জম্মু ও কাশ্মীর ‘ভারতের অবৈধ দখলে’ রয়েছে দাবি করে এর সমাধানের মতো ইস্যু নিয়ে ঢাকার বৈঠকে আলোচনার কথা বলা হলেও মুক্তিযুদ্ধে ‘গণহত্যার জন্য ক্ষমা চাওয়া’ কিংবা ‘বকেয়া অর্থের’ বিষয়ে কিছু বলা নেই ওই প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব আমনা বালুচের সঙ্গে বৈঠক শেষে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব জসীম উদ্দিন জানিয়েছিলেন, আলোচনায় অমীমাংসিত বিষয়ের মধ্যে ছিল, আটকে পড়া পাকিস্তানিদের প্রত্যাবাসন, অবিভক্ত সম্পদের সুষম বণ্টন, ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য প্রেরিত বৈদেশিক সাহায্য তহবিল হস্তান্তর এবং ১৯৭১ সালে তৎকালীন পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী কর্তৃক সংঘটিত গণহত্যার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে জনসমক্ষে ক্ষমা চাওয়া।
বাংলাদেশের আগের একটি হিসাবে ৪০০ কোটি ডলার এবং আরেকটা হিসাবে ৪৫২ কোটি ডলার। এ হিসাব আলোচনায় বলেছি। তবে, এসব ইস্যুতে একটি শব্দও ব্যয় করেনি পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে, অতীতের ইস্যুর চেয়ে ভবিষ্যতের সম্ভাবনার দিকেই বেশি নজর দিয়েছে ইসলামাবাদ। তাদের ভাষ্য, দেশ দুটির সাংস্কৃতিক সম্পর্ক এবং অভিন্ন ইতিহাস ও জনআকাঙ্খার কথা এসেছে আলোচনায়।
বৈঠকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষাগত ও কৌশলগত সহযোগিতা নিয়ে বিস্তারিত আলাপ করেছে দুই পক্ষ, বলা হয়েছে প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে।
প্রসঙ্গত, ২০১০ সালের ১ নভেম্বর বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠকের পরও একাত্তরে গণহত্যার জন্য ক্ষমাসহ তিন সমস্যার কথা পাকিস্তানের বিজ্ঞপ্তিতে এড়িয়ে যাওয়া হয়। বাংলাদেশের বিজ্ঞপ্তিতে প্রসঙ্গটি উল্লেখ ছিল। এবারের মতো ২০১০ সালেও পাকিস্তান অনিষ্পন্ন বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা অব্যাহত রাখার আশ্বাস দিয়েছিল।
এর দুই বছর পর পাকিস্তানের তখনকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিনা রাব্বানি খার বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীকে ডি-৮ শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নেওয়ার আমন্ত্রণ জানাতে ঢাকায় এসেছিলেন। ৬ ঘণ্টার সংক্ষিপ্ত সফরের সময় শেখ হাসিনার হাতে ডি-৮ শীর্ষ সম্মেলনের আমন্ত্রণপত্র তুলে দেওয়ার পাশাপাশি সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করেন তিনি। ওই সময় হিনা রাব্বানি অতীত ভুলে সম্পর্ক সামনে এগিয়ে নেওয়ার কথা বলেছিলেন।
সাবেক কূটনীতিক এবং গবেষণাপ্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের (বিইআই) প্রেসিডেন্ট এম হুমায়ুন কবীর বলেন, ঐতিহাসিক অমীমাংসিত বিষয়গুলোর সমাধান রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়। সামনে রাজনৈতিক পর্যায়ে আলোচনা হলে বাংলাদেশ জবাব আশা করতে পারে। যেহেতু বাংলাদেশের দাবি যৌক্তিক, পাকিস্তান আজ না হোক কাল আমাদের দাবি মানবে বলে আমাদের বিশ্বাস।
এদিকে পাকিস্তানের ইংরেজি দৈনিক দ্য এক্সপ্রেস ট্রিবিউন একটি প্রতিবেদন ছেপেছে, যার শিরোনাম ‘শীর্ষ কূটনীতিক ১৫ বছর পর ঢাকায় বরফ গলিয়েছেন’। পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৫ বছর ধরে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্কের ‘শীতল যুদ্ধ’ বাণিজ্য, যোগাযোগ এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে অগ্রগতির পথ রুদ্ধ করে দিয়েছে। দুই পররাষ্ট্র সচিব তাদের বৈঠকে সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য অভিন্ন ভিত্তি খুঁজে পেয়েছেন।