
নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন গ্রহণকালে প্রধান উপদেষ্টা
নারীর প্রতি বৈষম্য দূর করতে নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের যেসব সুপারিশ এখনই বাস্তবায়নযোগ্য, তা দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। শনিবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন গ্রহণের পর এই নির্দেশনা দেন প্রধান উপদেষ্টা।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘যেসব সুপারিশ দ্রুত বাস্তবায়নযোগ্য, সেটা যেন আমাদের মাধ্যমে হয়ে যায়। আমরা যেন এই কাজের মাধ্যমে বিশ্বের অন্যান্য দেশের জন্য উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারি। পৃথিবীর মেয়েরা এটার দিকে তাকিয়ে আছে। তারা এটা নিয়ে পর্যালোচনা করবে। অনুপ্রাণিত হবে। অন্য দেশের নারীরাও এটা নিয়ে সিরিয়াস।’
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘এটা শুধু নারীদের বিষয় নয়, সার্বিক বিষয়। এই প্রতিবেদন ছাপিয়ে বিলি করা হবে। এটা পাঠ্যবইয়ের মতো বই আকারে ছাপা হবে। দলিল হিসেবে অফিসে রেখে দিলে হবে না, মানুষের কাছে উন্মুক্ত করে দিতে হবে।’
নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের এই প্রস্তাবগুলো জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছেও নিয়ে যাওয়া হবে বলে জানান প্রধান উপদেষ্টা।
নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রধান শিরীন পারভিন হক বলেন, ‘জুলাইয়ে যারা প্রাণ দিয়েছে, তাদের স্মরণার্থে এমন কিছু করতে চেয়েছি যা মানুষের জন্য কল্যাণকর হবে, সমাজের জন্য কল্যাণকর হবে।’
সুপারিশগুলোকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘কিছু এ সরকারই করে যেতে পারবে, কিছু পরের নির্বাচিত সরকার করতে পারবে এবং নারী আন্দোলনের আশা-আকাক্সক্ষাগুলো আলাদা করে তুলে ধরা হয়েছে।’ নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন ১৫টি বিষয়ে সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রতিবেদন হস্তান্তর অনুষ্ঠানে শিরীন হকের নেতৃত্বে কমিশনের সদস্য ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের সিনিয়র ফেলো মাহীন সুলতান, বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ফৌজিয়া করিম ফিরোজ, বাংলাদেশ গার্মেন্টস ও শিল্প শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি কল্পনা আক্তার, নারী-স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ হালিদা হানুম আক্তার, বাংলাদেশ নারী শ্রমিক কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুমাইয়া ইসলাম, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক সদস্য নিরুপা দেওয়ান, এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংকের সাবেক সিনিয়র সামাজিক উন্নয়ন উপদেষ্টা ফেরদৌসী সুলতানা এবং শিক্ষার্থী প্রতিনিধি নিশিতা জামান নিহা উপস্থিত ছিলেন।
সংসদের আসন ৬শ’ করার সুপারিশ ॥ ১৫টি মূল বিষয়ে সুপারিশ করেছে নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন। শনিবার বিকালে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে এই প্রতিবেদন হস্তান্তর করে কমিশন। এ সময় কমিশনের সদস্যরা প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপ প্রধান উপদেষ্টার সামনে তুলে ধরেন।
সুপারিশগুলোর মধ্যে আছে– সংসদীয় আসন সংখ্যা ৬০০-তে বৃদ্ধি করা, যেখানে প্রতিটি নির্বাচনি এলাকায় একটি সাধারণ আসন এবং নারীদের জন্য একটি সংরক্ষিত আসন থাকবে। উভয় আসনে সরাসরি ভোটের মাধ্যমে নির্বাচন হবে। এই সুপারিশ অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে বাস্তবায়ন সম্ভব বলে মনে করে কমিশন।
কমিশন তাদের সুপারিশে জানিয়েছে, সংবিধানে মৌলিক অধিকার হিসেবে খাদ্য বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মের স্বীকৃতি দেওয়া এবং এই অধিকারগুলো ক্রমান্বয়ে বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতিসহ বলবৎযোগ্য করা। বেঁচে থাকার অধিকার থেকে কাউকে বঞ্চিত না করা। অর্থাৎ মৃত্যুদ-ের বিধান বিলুপ্ত করা।
প্রতিবেদনে বলা হয়, জাতীয় সংসদে উচ্চকক্ষ করার সিদ্ধান্ত হলে ৫০ শতাংশ আসনে আনুপাতিক হারে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল যে নারী-পুরুষ প্রার্থী দেবে, তা ‘জিপার’ পদ্ধতিতে মনোনয়ন করবেন। যাতে প্রত্যেক দল থেকে সমান সংখ্যক নারী ও পুরুষ মনোনীত হয়। বাকি ৫০ শতাংশ আসনে নির্দলীয় ভিত্তিতে অন্যান্য গোষ্ঠীর মাঝে ৫টি নারী আন্দোলনের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা।
এছাড়া জনপরিসরে নারীর ভূমিকার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলের মধ্যে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে গণতান্ত্রিক চর্চার প্রসার এবং অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা। রাজনীতিতে সামাজিক ও দুর্নীতি বিষয়ক বাধা দূর করতে বিধি প্রণয়ন করা। আরপিওতে নারীর অংশগ্রহণ বিষয়ক বিধান পালন বাধ্যতামূলক করা।
স্থানীয় সরকার পর্যায়ে নারীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার জন্য প্রতিটি ওয়ার্ডে একটি সাধারণ আসন এবং একটি নারী আসন থাকবে। এই ব্যবস্থা অস্থায়ী বিশেষ পদক্ষেপ হিসেবে আগামী তিনটি স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রযোজ্য হবে। নারী সংসদ সদস্যদের নারী সমাজের কাছে জবাবদিহি করার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করারও সুপারিশ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে ‘সংবিধান আইন ও নারীর অধিকার : সমতা ও সুরক্ষার ভিত্তি’, নারীর অগ্রগতির জন্য প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা ও জাতীয় সংস্থাসমূহ, নারীর স্বার্থ ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় বিকেন্দ্রীকরণ ও স্থানীয় পর্যায়ের উন্নয়ন, নারী ও মেয়ে শিশুর জন্য সহিংসতামুক্ত সমাজ, ‘জনপরিসরে নারীর ভূমিকা : জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে’, জনপ্রশাসনে নারীর অংশগ্রহণ, নারীর অগ্রগতির জন্য শিক্ষা, প্রযুক্তি ও দক্ষতাবৃদ্ধি, সব বয়সী নারীর জন্য সুস্বাস্থ্য, অর্থনীতিতে অংশগ্রহণ ও সম্পদের অধিকার, শ্রম ও কর্মসংস্থান, নারী শ্রমিকের নিরাপদ অভিবাসন, দারিদ্র্য হ্রাসে টেকসই সামাজিক সুরক্ষা গণমাধ্যমে নারীর অংশগ্রহণ, চিত্রায়ন ও প্রকাশ, ক্রীড়া ও সংস্কৃতিতে নারীর অন্তর্ভুক্তি ও বিকাশ এবং দুর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তনে নারী বিষয়ে সুপারিশ করা হয়েছে।
ব্রিফিংয়ে কমিশন প্রধান যা বলেন ॥ প্রতিবেদন বিষয়ে আয়োজিত ব্রিফিংয়ে নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রধান শিরীন পারভিন হক বলেন, আমরা প্রতিবেদনে সব মিলিয়ে ৪৩৩টি সুপারিশ দিয়েছি। আমরা মনে করি, ৪৩৩টির মধ্যে যদি ২০০টিও বাস্তবায়ন হয়, তাহলেও আমরা অনেকটা এগিয়ে যাব।
তিনি বলেন, আমাদের সুপারিশগুলো তিনটি ভাগে করেছি। আমরা মনে করি, এই অন্তর্বর্তী সরকারের সময় করা সম্ভব, দ্বিতীয়ত আমরা মনে করছি, এর পরের যে সরকার আসবে, যেই মেয়াদেই হোক না কেন, সেই সময়ের মধ্যে কী করা যায়। সেটাকে আমরা আলাদা ভাগ করেছি। আরেকটি ভাগ হচ্ছে, নারী আন্দোলনের যে চিরন্তন আকাক্সক্ষা ‘স্বাধীনতা’ এবং সেই স্বাধীনতা পেতে হলে, নারীর যদি সত্যিকারের মুক্তি পেতে হয়, তাহলে আমরা কী করতে চাই, আমাদের আকাক্সক্ষা কী, স্বপ্ন কী- সেগুলো তুলে ধরেছি।
আমরা জানি, অনেক কিছু নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হবে, আমরা সেই বিতর্ককে স্বাগত জানাই। কারণ আমরা মনেকরি, এখন ২০২৫ সাল, হাই টাইম এগুলো নিয়ে জনপরিসরে আলোচনা হোক, বিতর্ক হোক, জানাজানি হোক, মানুষ জানুক নারী কী চায়, নারীর স্বপ্নটা কী।
১৫টি মূল বিষয়সহ ৪৩৩টি সুপারিশ করেছে নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন। সুপারিশগুলোর মধ্যে আছে- শ্রম আইনে গৃহকর্মী ও যৌন কর্মীদের শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান। এটি অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে বাস্তবায়ন করা সম্ভব বলে মনে করে নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন।