
পার পাচ্ছেন না সাবেক মন্ত্রী-এমপিরাও ডিএমপি
বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে আঁতাত করে, লুকিয়ে থেকেও পার পাচ্ছেন না আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক এমপি-মন্ত্রীরা। কোনো না কোনোভাবে অবস্থান জানলেই গ্রেপ্তার করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। কেউ দীর্ঘ কয়েক মাস আত্মগোপনে থাকার পর জনসম্মুখে আসার পর সাধারণ জনতা আটক করে পুলিশের কাছে সোপর্দ করছেন। কেউ কেউ এতদিন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে আঁতাত করে আত্মগোপনে ছিলেন।
সেসব রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা আর আশ্রয় না দেওয়ায় সম্প্রতি বেশ কয়েকজন এমপি গ্রেপ্তার হয়েছেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে কোনো না কোনোভাবে জড়িত এমপি-মন্ত্রীদের পর্যায়ক্রমে গ্রেপ্তার করা হবে বলে জানিয়েছে পুলিশ। এদিকে ৫ আগস্টের পর থেকে ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত ৭৫ জন এমপি-মন্ত্রী গ্রেপ্তার হয়ে বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন। এ সময়ে সরকারি আমলাসহ আরও গ্রেপ্তার হয়েছেন ৭৯ জন।
৫ আগস্ট আওয়ামী সরকারের পতনের আগে ও পরে যে সকল এমপি-মন্ত্রী দেশত্যাগ করতে পারেননি, তারা আত্মগোপনে চলে যান। অনেকে দেশত্যাগ করতে গিয়ে বিমানবন্দর থেকে, স্থল বন্দর থেকে গ্রেপ্তার হয়েছেন। কৌশল খাটিয়ে আত্মগোপনে থেকেও আত্মরক্ষা করতে পারেননি অনেকে। তবে অনেক এমপি-মন্ত্রী ৭ মাসের বেশি সময় ধরে আত্মগোপনে রয়েছেন। কেউ কেউ রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে আঁতাত করে দেশেই লুকিয়ে আছেন। গত এক মাসে এমন পাঁচজন এমপিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
গত ৮ এপ্রিল রাতে রাজধানীর গুলশান-২ থেকে বেঙ্গল গ্রুপ ও বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল আরটিভির চেয়ারম্যান এবং নোয়াখালী-২ আসনের সাবেক এমপি মোরশেদ আলমকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। ডিবি জানায়, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে খবর পেয়ে গুলশানের একটি বাসা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। ৫ আগস্টের পর থেকে তিনি বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপনে ছিলেন।
সর্বশেষ ৮ তারিখ রাতে খবর আসলে অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে ধানমন্ডি এলাকায় কিশোর মো. শামীম হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে হাজির করলে আদালত তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
৮ এপ্রিল রাতে হত্যাচেষ্টা ও বিস্ফোরক মামলায় জামিনে মুক্ত হন সিরাজগঞ্জ-৩ আসনের সাবেক এমপি ও ঢাকা শিশু হাসপাতালের সাবেক পরিচালক ডা. আব্দুল আজিজ। কারামুক্তির পর তাকে জেলা কারাগার চত্বর থেকে ধরে মারধর করে পুলিশে দেয় ছাত্র-জনতা। পরেরদিন বিস্ফোরক মামলায় পুনরায় তাকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়। এর আগে ৩ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর কলাবাগান এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
৭ এপ্রিল রাজবাড়ী-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য কাজী কেরামত আলীকে মহাখালী থেকে গ্রেপ্তার করেছে ডিবি। গত মাসের ৫ তারিখ রাতে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ঢাকা-২০ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য এম এ মালেককে।
সবশেষ ১৫ এপ্রিল বস্তি এলাকায় আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় গাইবান্ধা-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য শাহ সারওয়ার কবিরকে গ্রেপ্তার করেছে জেলা পুলিশ।
গাইবান্ধা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আনোয়ার হোসেন বলেন, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে আমরা জানতে পারি, শাহ সারওয়ার কবির দিনাজপুর শহরের ঈদগাহ বস্তি এলাকায় একটি বাড়িতে অবস্থান নিয়েছেন। পরে ওই এলাকায় কয়েকটি বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে তাকে আটক করা হয়েছে। বাড়িটি তার ভগ্নিপতি আলতাফ হোসেনের। গত ১ মার্চ থেকে ওই বাড়িতে আত্মগোপনে ছিলেন সারওয়ার।
গ্রেপ্তার অভিযানে অংশ নেওয়া ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের একজন অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার (এডিসি) নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, সম্প্রতি গ্রেপ্তার হওয়া বেশ কয়েকজন এমপি গ্রেপ্তার আতঙ্কে দেশের বিভিন্ন স্থানে লুকিয়ে ছিলেন। এক সপ্তাহ এখানে, পরের সপ্তাহ অন্যখানে আত্মগোপনে ছিলেন। অনেকে দেশত্যাগ করতে রাজনৈতিক দলের নেতাদের সহায়তা চেয়েছেন। নেতারা টাকা-পয়সা খেয়েছেন ঠিক কিন্তু দেশ ত্যাগের সুযোগ করে দিতে পারেননি।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ বলছে, অনেক এমপি-মন্ত্রী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে ছাত্রহত্যার ঘটনায় এজাহার নামীয় আসামি। এদের অনেকেই গ্রেপ্তার হয়েছেন। আবার অনেকে আত্মগোপনে রয়েছেন। এদের সন্ধান পেলেই গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। গ্রেপ্তারে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে আরও গ্রেপ্তার করা হবে।
কারাগারে ৭৫ এমপি-মন্ত্রী ॥ কারা অধিদপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (মিডিয়া) মো. জান্নাত-উল-ফরহাদ জনকণ্ঠকে জানান, ৫ আগস্টের পর থেকে ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত ৭৫ জন এমপি-মন্ত্রী গ্রেপ্তার হয়ে বর্তমানে দেশের বিভিন্ন কারাগারে রয়েছেন। এদের মধ্যে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী রয়েছেন ৪১ জন, এমপি রয়েছেন ৩৪ জন।
বিভিন্ন সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তারকৃত মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীরা হলেন- সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আব্দুস নাসের চৌধুরী, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রী লে. কর্নেল (অব.) মুহাম্মদ ফারুখ খান, সাবেক মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী অব. ক্যাপ্টেন এ বি তাজুল ইসলাম, সাংস্কৃতিক বিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুন্সী, সাবেক পরিবেশ ও বন উপমন্ত্রী আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম, বেসামরিক বিমান ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন, শিল্পমন্ত্রী নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ন, শিল্প মন্ত্রী ও প্রেসিডিয়াম সদস্য আমির হোসেন আমু, খাদ্য মন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম, দুই কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক ও আব্দুস শহীদ, পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী মো. শহিদুজ্জামান সরকার, বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান ফজলুর রহমান, ডেপুটি স্পিকার সামশুল হক টুকু, পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী কর্নেল অব. জাহিদ ফারুক শামীম, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান, রেলমন্ত্রী অ্যাডভোকেট নুরুল ইসলাম সুজন, গণপূর্ত মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, জনপ্রশাসন মন্ত্রী ফরহাদ হোসেন, চট্টগ্রাম পার্বত্য বিষয়ক মন্ত্রী দীপঙ্কর তালুকদার, সমাজকল্যাণ মন্ত্রী মো. নুরুজ্জামান আহম্মেদ, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, সমাজকল্যাণ মন্ত্রী ডা. দীপু মনি, নৌ পরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান, জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য মো. গোলাম কিবরিয়া টিপু, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রী র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী, যুব ও ক্রীড়া উপমন্ত্রী আরিফ খান জয়, জাসদের সভাপতি ও সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, খাদ্য মন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার, আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক, টাঙ্গাইলের সাবেক মেয়র শহিদুর রহমান খান মুক্তি, পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী, প্রতিমন্ত্রী কাজী কেরামত আলী, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আলী এবং পানি সম্পদ মন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেন।
গ্রেপ্তার এমপিরা হলেন- সাবেক সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু, নারায়ন চন্দ্র চন্দ, মো. রাগেবুল আহসান রিপু, আলহাজ সাফিয়া খাতুন, ড. ইঞ্জিনিয়ার মাসুদা সিদ্দিকী রোজি, কাজি জাফর উল্লাহ, দিলীপ কুমার আগারওয়ালা, কামরুল আশরাফ খান পটন, শফিউল আলম মহিউদ্দিন, নাসিমুল আলম চৌধুরী, শাহে আলম, আব্দুস সালাম মুর্শেদী, মো. মিজানুর রহমান, সাদেক খান, ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন, আলী আজম মুকুল, সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ, আব্দুস সোবহান মিয়া, মো. এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরী, অ্যাডভোকেট সোহরাব উদ্দিন, বখতিয়ার আলম রনি, মো. সিরাজুল ইসলাম মোল্লা (ডলার সিরাজ), মাজহারুল ইসলাম সুজন, মো. দবিরুল ইসলাম, ইঞ্জিনিয়ার এনামুল হক, মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান আসাদ, মো. আবুল কালাম আজাদ, একরামুল করিম চৌধুরী, আয়েশা ফেরদৌস, মোহাম্মদ আলী, উম্মে ফাতেমা নাজমা ওরফে শিউলি আজাদ, আব্দুল মজিদ খান, মেজর অব. জেনারেল সালাহউদ্দিন মিয়াজি ও মেজর অব. মো. শাহজাহান ওমর।
এ ছাড়া সরকারি আমলা ৭০ এবং অন্যান্য ৯ জন বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন। অন্য ৯ জনের মধ্যে সরকারের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্তরা, ব্যাংকের মালিক, করদাতা নামিদামি ব্যক্তিত্ব রয়েছেন।