ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ৬ বৈশাখ ১৪৩২

গলি থেকে মূল সড়ক ফ্লাইওভার সর্বত্র দাপিয়ে বেড়াচ্ছে

ঢাকা মহানগরীর পথের কাঁটা ব্যাটারিচালিত রিক্সা

আল জুবায়ের

প্রকাশিত: ০০:০৯, ১৯ এপ্রিল ২০২৫

ঢাকা মহানগরীর পথের কাঁটা ব্যাটারিচালিত রিক্সা

.

রাজধানীর নিউ মার্কেট এলাকার ঢাকা কলেজের সামনের এলাকায় ফুটওভার ব্রিজ না থাকায় রাস্তা দিয়ে পার হচ্ছিলেন আমেনা বেগম ও তার ৮ বছর বয়সী মেয়ে ইসরাত মিতু। তবে বিপরীত দিক থেকে হঠাৎ দ্রুত গতিতে ছুটে আসছিল ব্যাটারিচালিত একটি রিক্সা, অল্পের জন্য বড় দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে গেলেন মা ও মেয়ে। পরে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, ব্যাটারি রিক্সার জন্য কোথাও গিয়ে শান্তি নেই কখন এসে মেরে দেয় ঠিক নেই। যেখানেই যায় সেখানেই এই রিক্সা আর এত দ্রুত যায় তারা মানুষকে মানুষই মনে করে না। এগুলো দ্রুত বন্ধ হওয়া উচিত।
শুধু আমেনা বেগমই নন এমন অসংখ্য ঘটনা এখন নিত্যদিনের রুটিন। রাজধানীজুড়ে ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে পড়েছে এ অবৈধ ব্যাটারিচালিত রিক্সা। যার নেই কোনো হার্ড ব্রেক কিংবা নির্দিষ্ট গতিসীমা। যার যেভাবে ইচ্ছা সেভাবেই চালাচ্ছেন। মহল্লার ছোট-বড় গলি থেকে শুরু করে মূল সড়ক থেকে ফ্লাইওভার পর্যন্ত সকল জায়গায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এই ব্যাটারিচালিত রিক্সা।
শুক্রবার রাজধানীর বাংলা মোটর, সায়েন্স ল্যাব, নিউ মার্কেট, নীলক্ষেত, আজিমপুর, লালবাগসহ আশপাশের এলাকাগুলো ঘুরে এমনই চিত্র দেখা গেছে। এসব এলাকা ঘনবসতিপূর্ণ হওয়াতে মানুষকে আরও বেশি ভোগান্তিতে পড়তে হয়। দেখা গেছে, অনেক সময় হেঁটে যাওয়ার রাস্তা পর্যন্ত  ফাঁকা থাকে না।
ব্যাটারিচালিত রিক্সার প্রতি ক্ষোভ রেখে বাইক চালক আহনাফ নিশাত বলেন, বর্তমানে যে অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে তা খুব ভয়াবহ। সেদিন আমার বাইকের পেছনে এসে একটি রিক্সা ধাক্কা মারায় আমার ব্যাকলাইট ভেঙে গেছে। ঘুরে দেখি তিনি মধ্য বয়সী, না তিনি টাকা দিতে পেরেছেন না কিছু হয়েছে। এভাবে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। ফ্লাইওভারে পর্যন্ত এই ব্যাটারিচালিত রিক্সা এখন দেখা যায়। সরকার ও প্রশাসনকে বলব দ্রুত এদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠনের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকাসহ সারাদেশে আনুমানিক ৩৫-৪০ লাখ ব্যাটারিচালিত রিক্সা চলাচল করছে। এই যানবাহনটির এখন পর্যন্ত কোনো সরকারি স্বীকৃতি মেলেনি। তার পরেও অবৈধ যানটি দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সড়ক। একটি রিক্সারও বিআরটিএ বা সিটি করপোরেশন থেকে অনুমোদন নেই। নেই কোনো রেজিস্ট্রেশন নম্বর। যানচালকদের কোনো প্রশিক্ষণ নেই। চালকদের ট্রাফিক আইন সম্পর্কে ধারণা না থাকায় তারা বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালাচ্ছে। এতে বিভিন্ন স্থানে প্রতিদিন যেমন ছোট-বড় দুর্ঘটনা ঘটছে, তেমনি পথচারীদের চলাচল ও সড়ক পারাপারে মারাত্মক বিঘ্ন সৃষ্টি হচ্ছে। রেজিস্ট্রেশন নম্বর না থাকায় বড় ধরনের দুর্ঘটনার পর পালিয়ে গেলে খুঁজে বের করার কোনো সুযোগ থাকছে না।
সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা বলছেন, বেআইনি ও ঝুঁকিপ্রবণ হওয়া সত্ত্বেও ব্যাটারিচালিত রিক্সা এখনই নিষিদ্ধ করা যাচ্ছে না। কারণ এই রিক্সার ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ২ কোটি মানুষের রুটি রুজি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।
ট্রাফিক পুলিশ বলছে, ব্যাটারিচালিত রিক্সার বিষয়ে সরকার দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ গ্রহণ না করলে এক সময় ব্যাপক হুমকির মুখে পড়তে হবে। সায়েন্স ল্যাবে দায়িত্বরত পুলিশের এক সার্জেন্ট বলেন, দিনে দিনে এই ব্যাটারিচালিত রিক্সা বেড়েই চলেছে। এর ফলে প্রতিদিনই ছোট-বড় দুর্ঘটনা ঘটছে। এগুলো দ্রুত রোধ করতে হবে আর সবার আগে আমাদের সচেতন হতে হবে। আমরা দ্রুত এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়ার জন্য এই ব্যাটারিচালিত রিক্সাকে বেছে নিচ্ছি ফলে নিজেদের জীবন নিজেরাই হুমকির মুখে ফেলছি।
বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন ॥ সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করেন বুয়েটের অধ্যাপক ও গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. শামসুল হক। গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, রেজিস্ট্রেশনবিহীন যেসব গাড়ি যেমন- ব্যাটারিচালিত অটোরিক্সা, নছিমন, করিমন সেগুলোর বিষয়ে করণীয় কী এগুলো কেউ ভাবছেন বলে মনে হচ্ছে না। প্রতি দিনই এসব গাড়ির জন্য সড়কে দুর্ঘটনায় ঝরছে প্রাণ। এসব গাড়ির চালকের গাড়ি চালানোর কোনো দক্ষতাই নেই। নেই গাড়ির কোনো নিবন্ধনও। বিআরটিএ এসব গাড়ির বিষয়ে এখনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না কেন তা বুঝি না। মহাসড়কে ধীরগতির এসব ঝুঁকিপূর্ণ যানবাহন দুর্ঘটনার বড় কারণ। মহাসড়ক সব সময় অবারিত থাকা উচিত। এসব ছোট গাড়ির জন্য আলাদা লেন করতে পারলে সুফল পাওয়া যাবে।
বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক হাদিউজ্জামান গণমাধ্যমকে বলেন, সিঙ্গেল সড়কগুলো যখন সরাসরি মহাসড়কের সঙ্গে সংযুক্ত করে দেওয়া হয় আর আইন করা হয় এসব তিন চাকার যান মহাসড়কে ওঠা নিষেধ, তা হলে বিকল্প রাস্তা প্রয়োজন। আর বিকল্প রাস্তার ব্যবস্থা না করে আইন করে কখনোই এসব যানবাহন বন্ধ করা সম্ভব নয়। কেননা ২০০৯ সালে যখন চীন থেকে এসব যানবাহন আমদানি হয়েছে তখনই এ বিষয়ে পরিকল্পনা করা দরকার ছিল। গত ১৫ বছরে কয়েক লাখ মানুষের কর্মনির্ভর করে এখানে। তিনি বলেন, সব মহাসড়কের দুই পাশে দ্রুততম সময়ের মধ্যে সার্ভিস রোড চালু করতে হবে। এতে মহাসড়ক একদিকে ঝুঁকিমুক্ত হবে এবং থ্রি হুইলারসহ অযান্ত্রিক যানবাহন চলাচল বন্ধ হবে। আনফিট যানবাহন সরিয়ে নিতে হবে।
এর আগে গত ১৯ নভেম্বর হাইকোর্ট তিন দিনের মধ্যে ঢাকা মহানগর এলাকায় ব্যাটারিচালিত রিক্সা চলাচল বন্ধের নির্দেশ দেন। এরপর সড়ক ও রেলপথ অবরোধ করে নজিরবিহীন বিক্ষোভ করেন অটোরিক্সাচালকরা। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৫ নভেম্বর হাইকোর্টের ওই আদেশের ওপর স্থিতাবস্থা দেন চেম্বার আদালত।
সূত্র জানায়, ঢাকা মহানগরীতে ব্যাটারিচালিত রিক্সা চলাচলে আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়নে স্থানীয় সরকার বিভাগ একটি কমিটি করে। ওই কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় সিটি করপোরেশন এলাকায় তিন চাকার স্বল্পগতির ব্যাটারিচালিত অটোরিক্সা বা ই-রিক্সার চলাচল নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশনকে লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এ জন্য বিদ্যমান আইনের তৃতীয় তফসিলের ১৯-এর ২ অনুচ্ছেদ সংশোধনের সুপারিশ করা হয়।
ওই অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘কোনো ব্যক্তি করপোরেশন কর্তৃক প্রদত্ত লাইসেন্স ব্যতীত নগরীতে মোটরগাড়ি ছাড়া অন্য কোনো সাধারণ যানবাহন রাখিতে, ভাড়া দিতে বা চালাইতে পারিবে না।’ এই অনুচ্ছেদ সংশোধন করে ব্যাটারিচালিত অটোরিক্সার লাইসেন্স দেওয়ার এখতিয়ার ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের হাতে ন্যস্ত করার প্রস্তাব করা হয়। পরে স্থানীয় সরকার বিভাগ স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫-এর খসড়া করে তা পর্যালোচনার জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এ-সংক্রান্ত কমিটিতে পাঠায়। এই কমিটি শীঘ্রই বৈঠক করে খসড়াটি চূড়ান্ত করবে। এরপর এটি পাসের জন্য উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে তোলা হবে। তবে চার মাস পেরিয়ে গেলেও তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি প্রশাসন ও সরকারকে ফলে রাজধানীতে দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে এসব অবৈধ ব্যাটারিচালিত রিক্সা।

প্যানেল

×