ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ৬ বৈশাখ ১৪৩২

আসছে ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার বাজেট

মূল্য নিয়ন্ত্রণে অগ্রাধিকার

এম শাহজাহান

প্রকাশিত: ০০:০১, ১৯ এপ্রিল ২০২৫

মূল্য নিয়ন্ত্রণে অগ্রাধিকার

.

দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে নতুন অর্থবছরের বাজেট প্রণয়ন করা হচ্ছে। নিত্যপণ্যের বাজারে স্বস্তি ফেরাতে থাকবে নানা পদক্ষেপ। বিশেষ করে চাল, ডাল, চিনি, আটা, ভোজ্যতেল, পেঁয়াজ, ডিম ও মাছ-মাংসের মতো অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের দাম যাতে সারা বছর সহনীয় পর্যায়ে থাকে সেই কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে। প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট নির্দেশনা পাওয়ার পর সেভাবে বাজেট তৈরি করছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া প্রচলিত রীতি ভেঙে এবার বাজেটের আকার কিছুটা কমিয়ে বাস্তবায়নযোগ্য ও বাস্তবসম্মত করা হবে। কোনো মেগা প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে না। তবে নতুন কর্মসংস্থান বাড়াতে বিনিয়োগ উৎসাহিতকরণ ও দারিদ্র্য বিমোচনে বেশকিছু কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে। এ জন্য ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ তৈরি করা এবং সামাজিক নিরাপত্তা খাতের আওতা বাড়িয়ে উপকারভোগীর সংখ্যা বাড়ানো হবে। সরকারের আয় বাড়াতে করের হার না বাড়িয়ে কর আদায়ের আওতা বাড়ানোর পদক্ষেপ নিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এ তথ্য।
তথ্য মতে, আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার বাজেট দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। যা আগামী ২ জুন নতুন অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপন করবেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। সম্প্রতি কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিল ও বাজেট ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত সভায় এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়ায় এবার আর সংসদে বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করা হচ্ছে না। অর্থ উপদেষ্টা বাংলাদেশ টেলিভিশনে (বিটিভি) নতুন অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করবেন। রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের মাধ্যমে এ বাজেট ঘোষণা করা হবে। ঈদুল আজহার ছুটি শুরু হওয়ার আগেই বাজেট  দেওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এ কারণে ২ জুন সোমবার বাজেট ঘোষণার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সাধারণত আগের অর্থবছরগুলোতে বৃহস্পতিবার বাজেট দেওয়া হতো। বাজেট ঘোষণার পর আগের রীতি অনুযায়ী অর্থ উপদেষ্টা বাজেট পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে অংশ নেবেন।
জানা গেছে, নতুন বাজেটে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করা হবে। গত কয়েক বছর ধরেই দেশে মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কের ঘরে অবস্থান করছে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পরও মূল্যস্ফীতির তেজিভাব লক্ষ্য করা গেছে। তবে শেষ পর্যন্ত মূল্যস্ফীতি কমাতে আমদানি বাড়ানো ও নিত্যপণ্য আমদানিতে শুল্ক মওকুফের মতো বেশকিছু পদক্ষেপ নেওয়ায় এবার রমজানে দ্রব্যমূল্য কমে আসে। ওই সময় ভোক্তারা বাজারে স্বস্তি পেয়েছেন। কিন্তু এখন আবার একটু একটু করে বাড়তে শুরু করেছে নিত্যপণ্যের দাম। বিশেষ করে চাল ও ভোজ্যতেলের দাম বেড়ে গেছে। সামনে বর্ষা মৌসুম শুরু হলে শাক-সবজির দাম বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কোরবানি ঈদ সামনে রেখে মসলা জাতীয় পণ্য নিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীদের তৎপরতা বাড়তে পারে। এ অবস্থায় দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে বাজেট প্রণয়ন করা হচ্ছে। অন্যদিকে দেশে এখনো উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে, যা ৯-১০ শতাংশের ঘরে থাকছে। তবে নতুন বাজেটে মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার ঘোষণা দেবেন অর্থ উপদেষ্টা।
এ প্রসঙ্গে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ সম্প্রতি সচিবালয়ে বলেন, সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দিতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। মূল্যস্ফীতিকে কমিয়ে আনা গেলে বাজারে স্বস্তি ফিরে আসবে। দ্রব্যমূল্য কমে আসবে। তিনি বলেন, নতুন বাজেটে কর্মসংস্থানে বিনিয়োগ উৎসাহিতকরণ, জ্বালানি সাশ্রয়, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দক্ষতা উন্নয়ন ও  তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হবে। মানুষের জীবনমান উন্নয়নে সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করবে অন্তর্বর্তী সরকার।
এ ছাড়া এনবিআর চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান খান আগামী বাজেট নিয়ে জনকণ্ঠকে জানান, সরকারের আয় বাড়াতে রাজস্ব আদায় বাড়ানো হবে। এ লক্ষ্যে গ্রোথ সেন্টার বাড়ানো এবং বেশি সংখ্যক নাগরিককে করের আওতায় নিয়ে আসা হবে। যারা নিয়মিত কর দিচ্ছেন তাদের ওপর করের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হবে না। আমাদের লক্ষ্য নতুন করদাতা খুঁজে বের করা। অর্থাৎ করের হার না বাড়িয়ে এর আওতা বাড়ানো এবং একটি ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ তৈরি করা হবে। এ ছাড়া দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে নতুন বাজেটে নিত্যপণ্যের দেশীয় উৎপাদন বাড়ানো, আমদানি উৎসাহিতকরণ, বন্দর উন্নয়ন, ঋণপত্র খোলা সহজীকরণ, ব্যাংকিং খাতের সেবা বাড়ানো, সহজ ঋণপ্রাপ্তি, আমদানিপণ্যের শুল্ক-কর ছাড়ের সুবিধা ভোক্তা পর্যায়ে নিশ্চিত করার মতো বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে। এ ছাড়া অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট ভেঙে দিয়ে প্রতিযোগিতামূলক বাজার তৈরি করার ওপর জোর দেবে সরকার। কৃষিজাত পণ্য বিশেষ করে পোল্ট্রি, গবাদিপশু ও মাছের দেশীয় উৎপাদন বাড়াতে ভর্তুকি, প্রণোদনা এবং আমদানিকৃত পণ্যে শুল্ক-কর ও ভ্যাট ছাড় দেওয়া হতে পারে।  
তথ্যমতে, অত্যাবশ্যকীয় ১৭টি পণ্যের বেশিরভাগই আমদানিনির্ভর। অন্যদিকে এসব পণ্যের দেশীয় উৎপাদনেও বীজ, সার, ওষুধ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা হয়ে থাকে। এ অবস্থায় ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই থেকে বেশ কয়েক বছর ধরেই অত্যাবশ্যকীয় ১৭ ভোগ্যপণ্য সামগ্রী যেমন- চাল, গম, আলু, পেঁয়াজ, রসুন, ছোলা, বুট, ডাল, হলুদ, মরিচ, ভুট্টা, আটা, ময়দা, লবণ, ভোজ্যতেল, চিনি ও সকল প্রকার ফল ইত্যাদির সরবরাহ পর্যায়ে উৎসে কর ২ শতাংশ হারে কর্তনে বিধান বাতিল করার প্রস্তাব করে আসছে। এটা করা হলে বাজেট ঘোষণার পরও নিত্যপণ্যের দাম স্থিতিশীল থাকবে বলে মনে করে এফবিসিসিআই। আশা করা হচ্ছে, নিত্যপণ্য পেঁয়াজের দাম ও আমদানির লাগাম টানতে এ পণ্যটির উৎপাদন বাড়বে দেশে। গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ উৎপাদনে গত দুই বছর ধরে বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ দেওয়া হয়। আগামী অর্থবছরের বাজেটেও এই ধারা বহাল রাখা হতে পারে।  
এ ছাড়া ভোজ্যতেল ও চিনি আমদানিতে শুল্ক-কর ও ভ্যাট ছাড়ের বিষয়টি বিবেচনায় রেখেছে এনবিআর। তবে সম্প্রতি ভোজ্যতেল আমদানিতে শুল্ক সুবিধা প্রত্যাহার করা হয়েছে। কৃষির উপখাত হিসেবে বিশেষ সুবিধা পাবে পোল্ট্রি, মৎস্য ও গবাদিপশু পালন খাত। এ খাতের উদ্যোক্তাদের প্রণোদনা ও নগদ সহায়তা দেওয়ার মতো কর্মসূচি নেওয়া হবে। এ ছাড়া সার, বীজ, জীবন রক্ষাকারী ওষুধ এবং আরও কতিপয় শিল্পের কাঁচামালের ক্ষেত্রে বিদ্যমান শুল্কহার অপরিবর্তিত রাখার প্রস্তাব করা হবে। সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দিতে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি অব্যাহত রাখা, খোলা বাজারে চাল-আটা (ওএমএস) বিক্রি কার্যক্রম জোরদার এবং টিসিবির উপকারভোগী বাড়ানো মতো কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে প্রস্তাবিত বাজেটে। এ জন্য সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায়ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ থাকছে। একই সঙ্গে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সামগ্রী সার, বীজ, জীবন রক্ষাকারী ওষুধ এবং আরও কতিপয় শিল্পের কাঁচামালের ক্ষেত্রে বিদ্যমান শুল্কহার অপরিবর্তিত রাখার প্রস্তাব করা হতে পারে। এ প্রসঙ্গে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, অত্যাবশ্যকীয় পণ্য এবং খাদ্যশস্যের সরবরাহের ওপর কর কমানো উচিত। সিপিডি উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যে এ ধরনের কর হ্রাসের পক্ষে অনেক আগে থেকেই কথা বলে আসছে। এর ফলে নিত্যপণ্যের দামে স্বস্তি ফিরে আসবে। উল্লেখ্য, চলতি (২০২৪-২৫) অর্থবছরের মূল বাজেটের আকার ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। সে হিসাবে চলতি অর্থবছরের তুলনায় আগামী বাজেটের মূল আকার ৭ হাজার কোটি টাকা কমতে পারে। অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ ইতোমধ্যে জানিয়েছেন, নানা কারণে আগামী বাজেট ছোট করতে হচ্ছে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকারও ছোট হবে। নতুন করে বড় কোনো প্রকল্প নেওয়া হবে না। তবে যেসব বড় প্রকল্প আছে, সেগুলোতে অর্থায়ন চলমান থাকবে। সূত্রগুলো জানায় এডিপিতে বরাদ্দ রাখা হবে ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার মতো। বরাদ্দের দিক থেকে আগামী বাজেটে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, তথ্যপ্রযুক্তি এবং সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে। বাজেটের সিংহভাগ অর্থের জোগান দেয় এনবিআর। আগামী অর্থবছরে সংস্থাটির জন্য ৫ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হচ্ছে। চলতি বাজেটে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের মূল লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। এরই মধ্যে সেই লক্ষ্যমাত্রা সংশোধন করে ৪ লাখ ৬৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়েছে। আগামী অর্থবছরের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হচ্ছে ৫ দশমিক ২৫ শতাংশ।

প্যানেল

×