ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ৬ বৈশাখ ১৪৩২

ঢাকা শহরের পথের কাঁটা ব্যাটারিচালিত রিকশা!

আল জুবায়ের, সিটি রিপোর্টার

প্রকাশিত: ১৮:২৩, ১৮ এপ্রিল ২০২৫; আপডেট: ১৯:৩০, ১৮ এপ্রিল ২০২৫

ঢাকা শহরের পথের কাঁটা ব্যাটারিচালিত রিকশা!

ছবি: জনকণ্ঠ

রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ব্যাটারি চালিত রিকশার দাপটে ভোগান্তিতে পড়েছে সাধারণ জনগণ। আজ শুক্রবার (১৮ এপ্রিল), রাজধানীর বাংলামোটর, সাইন্সল্যাব, নিউমার্কেট, নীলক্ষেত, আজিমপুর, লালবাগসহ আশেপাশের এলাকাগুলো ঘুরে এমন চিত্র দেখা যায়। অনেক সময় হেঁটে যাওয়ার রাস্তা পর্যন্ত ফাঁকা থাকছে না।   

 

রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকাসংলগ্ন, ঢাকা কলেজের সামনের এলাকায় ফুটওভার ব্রিজ না থাকায়, রাস্তা দিয়ে পার হচ্ছিলেন আমেনা বেগম ও তার ৮ বছর বয়সী মেয়ে ইসরাত মিতু। এসময় বিপরীত দিক থেকে হঠাৎ দ্রুত গতিতে ছুটে আসছিল ব্যাটারিচালিত একটি রিকশা, অল্পের জন্য বড় দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে যায় মা ও মেয়ে। 

 

পরে প্রতিবেদকের সাথে কথা হলে তিনি জানান, ‘ব্যাটারি রিকশার জন্য কোথাও গিয়ে শান্তি নাই। কখন এসে মেরে দেয় ঠিক নেই। যেখানেই যায় সেখানেই এই রিকশা এত দ্রুত যায় তারা মানুষকে মানুষই মনে করে না। এগুলো দ্রুত বন্ধ হওয়া উচিত।’

 

শুধু আমেনা বেগমই নন এমন অসংখ্য ঘটনা এখন নিত্যদিনের রুটিন। পুরো রাজধানী জুড়ে ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে পড়েছে এ অবৈধ ব্যাটারিচালিত রিকশা। যার নেই কোনো হার্ড ব্রেক কিংবা নির্দিষ্ট গতিসীমা। যার যেভাবে ইচ্ছা সেভাবেই চালাচ্ছেন। মহল্লার ছোট-বড় গলি থেকে শুরু করে, সড়ক থেকে ফ্লাইওভার পর্যন্ত, সকল জায়গায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এই ব্যাটারি রিকশা। 


 

ব্যাটারিচালিত রিকশার প্রতি ক্ষোভ রেখে বাইক চালক আহনাফ নিশাত বলেন, ‘বর্তমানে যে অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে তা খুব ভয়াবহ। সেদিন আমার বাইকের পেছনে এসে একটি রিকশা ধাক্কা মারায় আমার বেক লাইট ভেঙে গেছে। ঘুরে দেখি তিনি মধ্যবয়সী। না তিনি টাকা দিতে পেরেছেন না কিছু হয়েছে।  এভাবে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। ফ্লাইওভারে পর্যন্ত এই ব্যাটারি রিকশা এখন দেখা যায়। সরকার ও প্রশাসনকে বলবো দ্রুত এদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে।’


 

বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠনের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকাসহ সারাদেশে আনুমানিক ৩৫-৪০ লাখ ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল করছে। এই যানবাহনটির এখন পর্যন্ত কোন সরকারি অনুমোদন মেলেনি। নেই কোনো রেজিস্ট্রেশন নম্বর। যানচালকদের কোনো প্রশিক্ষণ নেই। চালকদের ট্রাফিক আইন সম্পর্কে ধারণা না থাকায় তারা বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালাচ্ছে । এতে বিভিন্ন স্থানে প্রতিদিন যেমন ছোট-বড় দুর্ঘটনা ঘটছে, তেমনি পথচারীদের চলাচল ও সড়ক পারাপারে মারাত্মক বিঘ্ন সৃষ্টি হচ্ছে। রেজিস্ট্রেশন নম্বর না থাকায় বড় ধরনের দুর্ঘটনার পর পালিয়ে গেলে খুঁজে বের করার কোন সুযোগ থাকছে না।

 

সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তারা বলছেন, ‘বেআইনি ও ঝুঁকিপ্রবণ হওয়া সত্ত্বেও ব্যাটারি চালিত রিকশা এখনই নিষিদ্ধ করা যাচ্ছে না। কারণ এই রিকশার ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ২ কোটি মানুষের রুটি রুজি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।’


 

সাইন্সল্যাবে দায়িত্বরত পুলিশের এক সার্জেন্ট বলেন, ‘দিনে দিনে এই ব্যাটারি রিকশা বেড়েই চলেছে। এর ফলে প্রতিদিনই ছোট-বড় দুর্ঘটনা ঘটছে। এগুলো দ্রুত রোধ করতে হবে আর সবার আগে আমাদের সচেতন হতে হবে। আমরা দ্রুত এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়ার জন্য এই ব্যাটারি রিকশাকে বেছে নিচ্ছি ফলে নিজেদের জীবন নিজেরাই হুমকির মুখে ফেলছি।’

 

বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন-

 

সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করেন বুয়েটের অধ্যাপক ও গণপরিবহণ বিশেষজ্ঞ ড. শামসুল হক। গণমাধ্যমকে তিনি বলেন,’রেজিস্ট্রেশনবিহীন যে সব গাড়ি যেমন- ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা, নছিমন, করিমন সেগুলোর বিষয়ে করণীয় কী এগুলো কেউ ভাবছেন বলে মনে হচ্ছে না। প্রতিদিনই এসব গাড়ির জন্য সড়কে দুর্ঘটনায় প্রাণ যাচ্ছে। মহাসড়কে ধীরগতির এসব ঝুঁকিপূর্ণ যানবাহন দুর্ঘটনার বড় কারণ। মহাসড়ক সব সময় অবারিত থাকা উচিত। এসব ছোট গাড়ির জন্য আলাদা লেন করতে পারলে সুফল পাওয়া যাবে।’

 

বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক হাদিউজ্জামান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘২০০৯ সালে যখন চীন থেকে এসব যানবাহন আমদানি হয়েছে তখনই এ বিষয়ে পরিকল্পনা করা দরকার ছিল। গত ১৫ বছরে কয়েক লাখ মানুষের কর্মনির্ভর করে এখানে।সব মহাসড়কের দুই পাশে দ্রুততম সময়ের মধ্যে সার্ভিস রোড চালু করতে হবে। আনফিট যানবাহন সরিয়ে নিতে হবে।’

 

এর আগে, গত ১৯ নভেম্বর হাইকোর্ট তিন দিনের মধ্যে ঢাকা মহানগর এলাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল বন্ধের নির্দেশ দেন। এরপর সড়ক ও রেলপথ অবরোধ করে নজিরবিহীন বিক্ষোভ করেন অটোরিকশাচালকেরা। এই পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৫ নভেম্বর হাইকোর্টের ওই আদেশের ওপর স্থিতাবস্থা দেন চেম্বার আদালত।

 

সূত্র থেকে জানা যায়, ‘ঢাকা মহানগরীতে ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচলে আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়নে স্থানীয় সরকার বিভাগ একটি কমিটি করে। ওই কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় সিটি কর্পোরেশন এলাকায় তিন চাকার স্বল্পগতির ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা বা ই-রিকশার চলাচল নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশনকে লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এ জন্য বিদ্যমান আইনের তৃতীয় তফসিলের ১৯-এর ২ অনুচ্ছেদ সংশোধনের সুপারিশ করা হয়।’ 

 

ওই অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘কোনো ব্যক্তি করপোরেশন কর্তৃক প্রদত্ত লাইসেন্স ব্যতীত নগরীতে মোটরগাড়ি ছাড়া অন্য কোনো সাধারণ যানবাহন রাখিতে, ভাড়া দিতে বা চালাইতে পারিবে না।’ এই অনুচ্ছেদ সংশোধন করে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার লাইসেন্স দেওয়ার এখতিয়ার ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের হাতে ন্যস্ত করার প্রস্তাব করা হয়। পরে স্থানীয় সরকার, বিভাগ স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন), (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫-এর খসড়া করে তা পর্যালোচনার জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এ-সংক্রান্ত কমিটিতে পাঠায়। 

 

চার মাস পেরিয়ে গেলেও তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি প্রশাসন ও সরকারকে। 

 

জুবায়ের/ সুরাইয়া

আরো পড়ুন  

×