
.
যে সংস্কারে জাতির কল্যাণ হয় সে সংস্কার বিএনপি চায়। তবে সংবিধানের বাইরে গিয়ে সংস্কার নয় বলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনকে জানিয়েছে বিএনপি। বৃহস্পতিবার সকালে জাতীয় সংসদ ভবনের এলডি হলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে দলের পক্ষ থেকে বিএনপি নেতারা এ অবস্থান তুলে ধরেন। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, সংস্কার একটা চলমান অনিবার্য প্রক্রিয়া, তা হতেই হবে। আরেক স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, সংস্কার সাংবিধানিকভাবে হওয়া উচিত। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়াই আমাদের প্রত্যাশা। এদিকে সংস্কার নিয়ে ফের রবিবার জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠক করবে বিএনপি।
নজরুল ইসলাম খান বলেন, বিশ্বে রাষ্ট্র পরিবর্তনের জন্য এমন সংগ্রাম খুব কমই দেখা যায়। অতীতে দেশে অনেক বিজয় অর্জিত হলেও তা আমরা ধরে রাখতে পারিনি। তাই আমরা চাই পরিবর্তন হোক, চাই উন্নত রাষ্ট্র গঠন হোক। তবে খুব বেশি ভালো করার চেষ্টায় যেন মানুষের ভেতরে থাকা পরিবর্তনের আকাক্সক্ষা স্তিমিত না হয়ে যায়। এখন যে সুযোগ তৈরি হয়েছে, সেটা কাজে লাগাতে
হবে। জনগণের আকাক্সক্ষা পূরণে সরকার ও কমিশনকে সহযোগিতা করছি। আমরা চাই, এ বিজয় যেন হাতছাড়া না হয়।
নজরুল ইসলাম বলেন, বিএনপির সংস্কার পরিকল্পনা কেবল রাজনৈতিক দাবিতে সীমাবদ্ধ নয়। এটি দলের পক্ষ থেকে একটি দৃঢ় প্রতিশ্রুতি। আমরা বিশ্বাস করি, জনগণই সবকিছুর মূলে। তাই জনগণের সম্মতিতেই প্রতিটি সিদ্ধান্ত হওয়া উচিত। বিএনপির ৩১ দফার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের নিজস্ব ‘জুলাই সনদ’ না থাকলেও, বিএনপির ৩১ দফা রয়েছে। সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করেই এটি তৈরি করা হয়েছে।
নজরুল ইসলাম বলেন, সংস্কার একটা চলমান অনিবার্য প্রক্রিয়া, তা হতেই হবে। আমি যখন একা আমার ঘরে থাকি তখন ঘরের যে সেটআপ আমি যখন বিয়ে করি সেটা বদলে যাবেই। আমাদের যখন সন্তান হবে তখন সেটা আবার বদলে যাবে। আরেকটা সন্তান হলে আরও বদলে যাবে। তাদের বয়স যখন বাড়বে তখন আবার বদলে যাবে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছু বদলায়, বদলাবেই। আমরা সবাই ভালো চাই। কিন্তু খুব ভালো করার জন্য যেন আমরা বেশি সময় না নেই। সময় নিতে গিয়ে যেন মানুষের পরিবর্তনের যে আকাক্সক্ষা সেটা স্তিমিত হয়ে না যায়। নিশ্চয় আমরা ভালো করতে চাই এবং ভালো কিছু করার প্রয়াস অব্যাহত থাকবে, সব সময়।
ঐকমত্য কমিশনের অন্য প্রতিনিধিদের মধ্যে ছিলেন কমিশনের সদস্য বদিউল আলম মজুমদার, অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এমদাদুল হক, ড. ইফতেখারুজ্জামান ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার।
নজরুল ইসলাম খান বলেন, আমরা বুধবারও প্রধান উপদেষ্টাকে বলেছি, বিএনপির চাইতে বেশি সংস্কার বাংলাদেশে আর কোনো রাজনৈতিক দল করেনি। রাজনৈতিকভাবে বলেন, আর গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বলেন অনেক সংস্কার বিএনপি করেছে। দেশে বহু দলীয় গণতন্ত্র তো বিএনপি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছে, দেশে সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাও বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেছে। আর তত্ত্বাবধায়ক শাসনব্যবস্থা তো বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেছে, প্রশাসনের বিকেন্দ্রীকারণসহ অনেক ক্ষেত্রে সংস্কার করেছে বিএনপি। এমনকি বিএনপি গ্রাম সরকারও প্রবর্তন করেছে। মুক্ত বাজার অর্থনীতি বিএনপি চালু করেছে, দুর্নীতি দমন কমিশন বিএনপি গঠন করেছে। আজকে অর্থনীতিতে সরকারের রাজস্ব আয়ের অন্যতম খাত হলো ভ্যাট, বিএনপি তা করেছে। আজকে অর্থনীতির মূল স্তম্ভ পোশাক খাত যা বিএনপির হাতে হয়েছে, কৃষি উন্নয়ন, প্রবাসী কর্মসংস্থান, পল্লী বিদ্যুতায়ন থেকে শুরু করে সমবায় উন্নয়ন, কুটির শিল্প এসব বিএনপিই করেছে। তাই বিএনপি সংস্কারের বিপক্ষে না, বিএনপি সংস্কারের পক্ষের দল। তারপরও কেউ কেউ নানা কথা বলেন, তারা যখন সংস্কারের ‘স’ উচ্চারণ করেননি যখন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ভিশন-২০৩০ দিয়েছেন। কেউ যখন সংস্কারের কথা ভাবেনি তখন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ জিয়াউর রহমান ১৯ দফা কর্মসূচি দিয়েছেন।
নজরুল ইসলাম খান বলেন, আমরা সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছি। আমরা বলেছি, এর চেয়ে ভালো প্রস্তাব থাকলে সেটা সাদরে গ্রহণ করব। কাজেই যদি ঐকমত্য কমিশনের সনদ নাও হয় বিএনপির জন্য সনদ আছে একটা সংস্কারের সনদ। কাজেই আমরা সংস্কারের পক্ষে। আমরা একটা জিনিস বলব, সব কিছুর উপরে জনগণ। জনগণ কার মাধ্যমে সম্মতি জানায় আমরা জানি।
নজরুল ইসলাম বলেন, আমরা বিশ্বাস করি, এমন যোগ্য মানুষরা এই কমিশনের দায়িত্ব পেয়েছেন, যাদের নেতৃত্বে এই কমিশন কাজ করেছে। তাদের সহযোগিতায় আমরা আাগামী দিনে আমাদের দেশটাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারব।
সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বিএনপি সংস্কার নিয়ে সিরিয়াস হওয়ার কারণেই ঐকমত্য তৈরিতে আলোচনা চালাচ্ছে। তবে যে সংস্কারে জাতির কল্যাণ হয় সেটিই বিবেচনা করা হবে। সংস্কার সাংবিধানিকভাবে হওয়া উচিত জানিয়ে তিনি বলেন, কমিশনের মৌলিক প্রস্তাবনাগুলো নিয়ে আলাপ করে ঐকমত্য আসার চেষ্টা করা হবে।
সালাহউদ্দিন বলেন, স্প্রেডশিটে বিভ্রান্তি সৃষ্টি ও মিসলিড করা হয়েছে। ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আমাদের ধারাবাহিকভাবে আলোচনা হচ্ছে। সংবিধানের প্রস্তাবনা থেকে শুরু করে মূলনীতি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। জুডিসিয়ারি নিয়ে বিএনপির সংস্কার প্রস্তাব মিসলিড করা হয়েছে। বিচারক নিয়োগের অধ্যাদেশের ক্ষমতাসহ সব সংস্কার সাংবিধানিকভাবে হওয়া উচিত। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বিএনপি চায়, কিন্তু প্রক্রিয়া যেন সাংবিধানিকভাবে হয়।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রিয়াজ বলেন, আমাদের লক্ষ্য একটি জাতীয় সনদ তৈরি করা। যার মাধ্যমে দেশে একটি স্থায়ী ও কার্যকর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হবে। তিনি জানান, বিএনপি তাদের সুস্পষ্ট মতামত দিয়েছে, আর ঐকমত্য কমিশনও তা নিয়ে গঠনমূলক আলোচনা করতে চায়।
আলী রিয়াজ বলেন, বাংলাদেশে গণতন্ত্র রক্ষার আন্দোলনে বিএনপির যে ভূমিকা রয়েছে, তা জনগণ জানে। তাদের রাজনৈতিক অবস্থান অনেক ক্ষেত্রেই প্রশংসনীয়।
ঐকমত্য কমিশনের ভাইস চেয়ারম্যান ও সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রিয়াজের সভাপতিত্বে বৈঠকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খানের নেতৃত্বে ৫ সদস্যের প্রতিনিধিদলে ছিলেন স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ইসমাইল জবিহউল্লাহ, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল ও সাবেক সচিব আবু মো. মনিরুজ্জামান খান প্রমুখ।
এদিকে রবিবার আবার জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠক করবে বিএনপি। বেলা ১১টায় জাতীয় সংসদ ভবনের এলডি হলে বএ বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে বলে জানা যায়।
প্যানেল