ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ৬ বৈশাখ ১৪৩২

বাংলাদেশ-পাকিস্তান পররাষ্ট্র সচিব বৈঠক, সম্পর্ক এগিয়ে নিতে চায় দুই দেশ

কূটনৈতিক রিপোর্টার।

প্রকাশিত: ২৩:০৭, ১৭ এপ্রিল ২০২৫

বাংলাদেশ-পাকিস্তান পররাষ্ট্র সচিব বৈঠক, সম্পর্ক এগিয়ে নিতে চায় দুই দেশ

ছবিঃ সংগৃহীত

বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের সরাসরি বিমান চালুসহ উভয় দেশের বাণিজ্যিক উন্নতি, অমীমাংসিত বিষয়গুলোর সমাধান, মুক্তিযুদ্ধের ক্ষতি পুরণ, আটকে পড়া পাকিস্তানিদের প্রত্যাবাসন, ১৯৭১ পূর্ববর্তী সম্পদে ন্যায্য হিস্যা এবং ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ে গৃহীত বৈদেশিক সাহায্য ফেরত সম্পর্কিত বিষয়ে দু’দেশের সচিবদের (এফওসি) বৈঠকে আলোচনা করা হয়েছে।

এদিকে পাকিস্তানে পররাষ্ট্র সচিব আমেনা বালুচ বৈঠকের ব্যাপারে সরাসরি কিছু না বললেও দুদেশের এফওসি বৈঠক ভালো হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেছেন। 


এফওসি সম্পর্কে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, বাংলাদেশ পাকিস্তান দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়নে কাজ করতে ঐক্যমত্য হয়েছে। পাকিস্তানে বাংলাদেশের পণ্য বিক্রির উপর  জোর দাবি জানানোর পাশাপাশি পাকিস্তান বাংলাদেশের সঙ্গে সাংস্কৃতিক বিনিময়, বাণিজ্য, পর্যটন ও বিনিয়োগ বাড়াতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।


পররাষ্ট্র সচিব বলেন, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের বিভিন্ন দ্বিপাক্ষিক বিষয় পর্যালোচনা এবং দুই দেশের পারস্পরিক স্বার্থে নতুন ক্ষেত্র চিহ্নিত করার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম। সভায় উভয় পক্ষ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বিভিন্ন বিষয়াদি পর্যালোচনা করে আরও সহযোগিতার সম্ভাব্য ক্ষেত্রগুলি চিহ্নিত করে। উভয় পক্ষ সম্পর্ক উন্নয়নে এবং দুই দেশের পারস্পরিক স্বার্থে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতায় নতুন গতি প্রদানের উপর জোর দেয়। 


তিনি বলেন, পাকিস্তান দক্ষিণ এশিয়ায় আমাদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী দেশ। সকল প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যাওয়া আমাদের পররাষ্ট্র নীতির অন্যতম লক্ষ্য। এই প্রেক্ষিতে উভয় দেশ বিদ্যমান সম্পর্ককে সামনের দিনগুলোতে আরো এগিয়ে নেবার ব্যাপারে একমত হয়েছেন।


পররাষ্ট্র সচিব জানান, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ইস্যু এবং দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান ঐতিহাসিকভাবে অমীমাংসিত বিষয়গুলো নিয়েও আলোচনা হয়েছে।


পররাষ্ট্র সচিব বলেন, আমরা পাকিস্তানের সাথে অর্থনৈতিকও বাণিজ্যিক সম্পর্কের উপর জোর দিয়েছি। পাকিস্তানের বাজারে বাংলাদেশের পণ্যের রপ্তানি বাড়াতে বাজারে প্রবেশের সুযোগ বৃদ্ধি, বাণিজ্য প্রক্রিয়া সহজীকরণ এবং শুল্ক বাধা দূরীকরণ ও বাংলাদেশে পাকিস্তানের বিনিয়োগ বৃদ্ধিকরণের জন্য প্রচেষ্টা জোরদার করার উপর আমি গুরুত্বারোপ করি। কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে সহযোগিতা বৃদ্ধির জন্যও আলোচনা হয়েছে, যাতে প্রযুক্তি, উন্নত প্রজাতি এবং অভিজ্ঞতা বিনিময়ের মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধি করা যায় সে লক্ষ্যে উভয় দেশ ঐক্যমত হয়েছে। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা ও বন্যা প্রতিরোধে দু দেশের অভিজ্ঞতা বিনিময়ের উপর জোর দেওয়া হয়।


তিনি জানান, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। আপনারা জানেন যে, সাম্প্রতিককালে দুদেশের মধ্যে সরাসরি শিপিং রুট চালু হয়েছে এবং সরাসরি ফ্লাইট পুনরায় চালু করার মাধ্যমে দুই দেশের জনগণের মধ্যে সংযোগ ও ব্যবসা বানিজ্য বৃদ্ধির বিষয়টিও আলোচনা করা হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে শীঘ্রই দুদেশের মধ্যে সরাসরি ফ্লাইট চালুর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সেটা দৃশ্যমান হবে।


তিনি আরও বলেন, আমরা উচ্চশিক্ষা ও বৈজ্ঞানিক গবেষণায় পারস্পরিক সহযোগিতার নতুন সুযোগসন্ধানের ওপর গুরুত্ব দিয়েছি এবং এ সকল ক্ষেত্রে পারস্পরিক শিক্ষা বৃত্তির সংখ্যা বৃদ্ধির উপর গুরুত্বারোপ করেছি। পাশাপাশি, সংস্কৃতি ও ক্রীড়া ক্ষেত্রে সম্পর্ক জোরদার করার প্রয়োজনীয়তার কথাও আলোচনায় এসেছে। দুই দেশের শিল্পী, চিত্রশিল্পী, সংগীতশিল্পী, লেখক ও শিক্ষাবিদদের সফরের মাধ্যমে সাংস্কৃতিক বিনিময়কে উভয় পক্ষ থেকেই উৎসাহিত করা হয়েছে।


পররাষ্ট্র সচিব বলেন, পাকিস্তানের সাথেবিদ্যমান ঐতিহাসিকভাবে অমীমাংসিত বিষয়গুলো উত্থাপন করেছি, যেমন: আটকেপড়া পাকিস্তানিদের প্রত্যাবাসন, অবিভাজিত সম্পদে বাংলাদেশের ন্যায্য হিস্যা প্রদান, ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য প্রেরিত বিদেশি সাহায্যের অর্থ হস্তান্তর এবং ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের তৎকালীন সশস্ত্রবাহিনী কর্তৃক সংঘটিত গণহত্যার ব্যাপারেও আলোচনা হয়েছে।

আমরা বলেছি, দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী দেশ হিসেবে আমরা পাকিস্তানের সাথে বিদ্যমান ঐতিহাসিকভাবে অমীমাংসিত বিষয়সমূহের দ্রুততম সময়ের মধ্যে নিষ্পত্তির মাধ্যমে একটি মজবুত, কল্যাণমুখী সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য পাকিস্তানের সহযোগিতা কামনা করি এবং এই লক্ষ্যে আমরা একযোগে কাজ করার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।


পররাষ্ট্র সচিব বলেন,উভয় দেশের সম্পর্কের পুনরুজ্জীবনের কথা বলা হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায়  আঞ্চলিক সহযোগিতা, স্থিতিশীলতা এবং উন্নয়নকে এগিয়ে  নেওয়া  যায়। আমরা ওআইসি সনদের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতি এবং মুসলিম উম্মাহর স্বার্থে কাজ করার ব্যাপারে বাংলাদেশের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছি। মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনায়  দুই দেশই গাজা উপত্যকায়  ইসরায়েলি দখলদার বাহিনীর দ্বারা সংঘটিত গণহত্যা ও চরম মানবাধিকার লঙ্ঘনের নিন্দা জানিয়েছে। আমি জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিকদের মিয়ানমারে তাদের মাতৃভূমিতে নিরাপদে প্রত্যাবর্তনের লক্ষ্যে পাকিস্তানের সমর্থন কামনা করি।


সচিব জানান, পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গেও সাক্ষাত করেছেন। পাক সচিব প্রধান উপদেষ্টা বরাবর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর শুভেচ্ছাবার্তা পৌছে  দেন। তখন প্রধান উপদেষ্টাও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী সমীপে তার শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করেন। পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের বিদ্যমান সম্পর্ককে আরো গতিশীল করার ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করার আশা প্রকাশ করেন প্রধান উপদেষ্টা।


তিনি দু’দেশের মধ্যে বিদ্যমান দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের নানা দিক নিয়ে আলোচনা করেন। মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার সাথে সাক্ষাতের পূর্বে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব ও মাননীয় পররাষ্ট্র উপদেষ্টার সাথেও সৌজন্য সাক্ষাত করেন।


সম্প্রতি পাকিস্তান থেকে কয়েকটি বাণিজ্য প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফর করেছে। উভয় দেশই এসব সফর নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছে এবং বাংলাদেশ থেকেও পণ্যভিত্তিক বাণিজ্য প্রতিনিধি দল পাকিস্তানে পাঠানোর ওপর গুরুত্বারোপ করেছে।


উল্লেখ্য, বৃহস্পতিবার সকাল দশটায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় দু’দেশের পররাষ্ট্র সচিবদের (এফওসি) বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে বাংলাদেশ পক্ষের নেতৃত্ব দেন পররাষ্ট্রসচিব মো. জসিম উদ্দিন এবং পাকিস্তান পক্ষের নেতৃত্ব দেন দেশটির পররাষ্ট্রসচিব আমনা বালুচ।
উল্লেখ্য, পাকিস্তানের ৩৩তম পররাষ্ট্র সচিব হিসেবে গত বছর ১১ সেপ্টেম্বর দায়িত্ব নেওয়া আমনা বেলোচ মঙ্গলবার ঢাকায় পৌঁছান। বিমানবন্দরে তাকে স্বাগত জানান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ এশিয়া উইংয়ের মহাপরিচালক ইশরাত জাহান।


উল্লেখ্য, গত বছরের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ঢাকা ও ইসলামাবাদের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা চলছে। সেই প্রেক্ষাপটে গত ১৫ বছরের মধ্যে দুই দেশের মধ্যে এটি প্রথম আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়।

রিফাত

×