
ছবি: জনকণ্ঠ
বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে প্রতি বছর কমছে প্রায় ৬৯ হাজার হেক্টর কৃষি জমি। তা সত্ত্বেও গবেষণা ও উদ্ভাবনের মাধ্যমে বাড়ছে খাদ্যশস্য উৎপাদন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারি গবেষণার পাশাপাশি বেসরকারি পর্যায়েও বেশ ভালো কৃষি গবেষণা হচ্ছে। যেখানে কৃষকরা সরাসরি অংশগ্রহণ করতে পারছেন এবং গবেষণার ফলাফল থেকে উপকৃতও হচ্ছেন তারা। গবেষণার পাশাপাশি এ প্রতিষ্ঠানগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে কৃষি ব্যবস্থাকে উন্নত করতে কাজ করে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১৯ সালের কৃষি জরিপ অনুযায়ী, ২০০৮ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে বাংলাদেশের আবাদি জমির পরিমাণ কমে গেছে ৪ লাখ ১৬ হাজার একর। এ তথ্য যথেষ্ট উদ্বেগের। কৃষি জমি হারিয়ে যাওয়ার কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে অপরিকল্পিত নগরায়ন, ইটভাটা, শিল্পকারখানা, অগোছালো বসতি স্থাপন, সড়ক নির্মাণ, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং তিন ফসলি কৃষি জমিতে শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপন। এর উপর জলবায়ু পরিবর্তন যেন মরার ওপর খাড়ার ঘা।
বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে নদী ভাঙন ও উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততার প্রভাবে প্রতিনিয়ত অনেক কৃষি জমি অনাবাদি হয়ে যাচ্ছে। ২০১০ সালে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা জার্মানওয়াচের প্রতিবেদনে জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ১০টি দেশের মধ্যে স্থান পায় বাংলাদেশ। এছাড়া ব্রিটিশ গবেষণা সংস্থা মেপলক্রাফট তাদের এক প্রতিবেদন অনুসারে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকিতে থাকা ১৫টি দেশের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ।
আবাদি জমির পরিমাণ কমে গেলেও আশার কথা হলো, সেই সময় দেশে খাদ্যশস্য উৎপাদন ১ কোটি টনের বেশি বেড়েছে। আবাদি জমির পরিমাণ কমলেও এক ফসলি ও অনাবাদি জমির রূপান্তর ঘটেছে দ্রুত। দেশে দুই ফসলি জমি প্রায় ৪৬ দশমিক ৩ শতাংশ এবং তিন ফসলি জমির পরিমাণ ছাড়িয়েছে ২১ শতাংশ। যা ফসল উৎপাদনের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
এমন পরিস্থিতিতে কৃষি বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, কৃষির ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় সরকারি এবং বেসরকারি পর্যায়ে গবেষণা ও উদ্ভাবন বাড়ানো জরুরি। এছাড়াও ভবিষ্যতের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রধান ফসল যেমন চাল, গম, ভুট্টা ও সয়াবিন নিয়ে গবেষণা কর্মসূচিতে কৃষকের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের কৃষিতে সফলতা আসলেও অনেক ঝুঁকিও তৈরি হয়েছে। সময়ের সাথে সাথে অধিকাংশ কৃষি জমির উর্বরতা ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। ভূগর্ভস্থ পানির উপর অত্যধিক নির্ভরতার কারণে পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। তাছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবও রয়েছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই দেশে কৃষি ফসলের উৎপাদন বেড়েছে।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো কৃষির বিভিন্ন শাখায়, যেমন বীজ, সার, ফসল ব্যবস্থাপনা, খামার প্রযুক্তি, কৃষি যন্ত্রপাতি, প্রাণী স্বাস্থ্য এবং দেশের পোল্ট্রি ফার্ম নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। কৃষি যন্ত্রপাতি গ্রামীণ পর্যায়ে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে এসব প্রতিষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এসিআই এগ্রি বিজনেস লিমিটেড আধুনিক এবং সাশ্রয়ী কৃষি যন্ত্রপাতি সরবরাহের কাজ করছে। এসিআই ক্রপ কেয়ার জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধি এবং কৃষকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি প্রদান, কীটনাশকের সঠিক এবং দায়িত্বশীল ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষকদের জ্ঞান ও দক্ষতা উন্নয়নে কাজ করছে।
নেসলে গ্রুপ চাল ও অন্যান্য কৃষিপণ্যতে আর্সেনিকের মাত্রা কমানোর জন্য কাজ করছে। গত ১০ বছরে প্রতিষ্ঠানটি দিনাজপুর ও বগুড়ায় প্রায় দেড় হাজার কৃষককে সার ব্যবহার, কীটনাশক ব্যবহার এবং সঠিক সেচ পদ্ধতি সম্পর্কে সচেতনতামূলক প্রশিক্ষণ দিয়েছে। ‘ধান, গম, ভুট্টা ও মসলার টেকসই উৎসের জন্য কৃষকদের সংযোগ’ প্রকল্পের অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠানটি ৪৮টি ছোট গ্রুপে প্রশিক্ষণের আয়োজন করেছে। এছাড়াও নেসলে প্রতি বছর একটি কৃষি মেলারও আয়োজন করে থাকে।
সার এবং কীটনাশক বাজারজাতকরণের পাশাপাশি, সিনজেনটা কৃষকদের জন্য সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা প্রদানের কাজ করছে। সিনজেনটা ফাউন্ডেশন ফর সাসটেইনেবল এগ্রিকালচার খাদ্য ও পুষ্টি ব্যবস্থায় কাঠামোগত পরিবর্তন আনতে কাজ করছে। আর সামাজিক উন্নয়ন সংস্থা ফ্রেন্ডশিপ দেশের গ্রামীণ অঞ্চলে কৃষকদের হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ প্রদান করছে। যেখানে বেসরকারি ব্যাংক স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড আর্থিক সহায়তা প্রদান করছে। ব্যাংকটি বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে কৃষির উন্নয়নেও অবদান রাখছে।
কুষ্টিয়া অঞ্চলে এশিয়ান কৃষি প্রযুক্তি হাব নামে একটি কৃষি গবেষণা-ভিত্তিক প্রযুক্তি কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বিএটি বাংলাদেশ, যা বাংলাদেশ সহ এশিয়ার অন্যান্য দেশের কৃষকদের জন্য কৃষি প্রযুক্তি সমাধান প্রদান করে। এই প্রযুক্তি কেন্দ্রের প্রধান উদ্দেশ্য হলো এমন উচ্চ ফলনশীল জাতের উদ্ভাবন যা স্থানীয় জলবায়ুর সাথে আরও স্থিতিশীল ও উপযোগী হবে এবং টেকসই কৃষি প্রযুক্তির বিভিন্ন সমাধান যেমন সার ব্যবস্থাপনা, সেচের জন্য ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন হ্রাস, মাটির স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা, কার্বন-স্মার্ট চাষ প্রযুক্তি ইত্যাদি প্রদান করা। পাশাপাশি, কৃষি খাতে বিদ্যমান শ্রম সংকট মোকাবেলায় কৃষকদের সহায়তার জন্য সাশ্রয়ী কৃষিযন্ত্রায়ন সমাধান নিয়ে কাজ করছে এই বেসরকারি প্রতিষ্ঠান।
জাগো ফাউন্ডেশন ট্রাস্টের ‘নবোদয়’ প্রজেক্ট খুলনার কামাখোলা অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে লবণ সহিষ্ণু সবজি চাষ এবং সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টিতে কাজ করে। বাংলাদেশে অনেক অঞ্চল জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে লবণাক্ত হয়ে যাচ্ছে। এ কারণে স্থানীয়রা ফসল উৎপাদন থেকে শুরু করে খাবার পানি সংগ্রহ পর্যন্ত নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়ে থাকে। এমন পরিস্থিতিতে, তারা সঠিক ফসল পরিকল্পনার মাধ্যমে জমির পূর্ণ ব্যবহার নিশ্চিত করার পাশাপাশি বেড ফার্মিং, ফেন্স ফার্মিং, লফট ফার্মিং এবং ব্যাগ ফার্মিংসহ বিভিন্ন চাষের পদ্ধতি নিয়ে কাজ করছে। সংস্থাটি প্রাকৃতিকভাবে লবণ সহিষ্ণু ফসলের জাত চাষের জন্যও প্রচার করছে। এই ধরনের প্রচেষ্টার মাধ্যমে সংস্থাটি খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি আয় উপার্জনের বিকল্প উৎস সৃষ্টি করা এবং পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রেও অবদান রাখছে।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মো. গোলাম ফারুক এ প্রসঙ্গে বলেন, "দেশে জমির পরিমাণ কমে গেলেও উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। এর প্রধান কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো উচ্চ ফলনশীল জাতের উন্নয়ন। কৃষকরা উচ্চ ফলনশীল বীজের ব্যবহার গ্রহণ করেছেন, যা সরকারি এবং বেসরকারি খাতের যৌথ প্রচেষ্টায় সম্ভব হয়েছে। কৃষকদের মধ্যে একটি ভিন্ন ধরনের সচেতনতা গড়ে উঠেছে। তারা এখন শুধু নিজেদের জন্যই নয়, বৃহত্তর জনগণের চাহিদা পূরণের জন্যও উৎপাদন করছেন। এমনকি পরিবেশ নিয়েও সচেতন তারা। উচ্চ ফলনশীল জাত উৎপাদন করতে প্রচুর যত্ন এবং সঠিক সময়ে সার ও কীটনাশক প্রয়োগ প্রয়োজন। উৎপাদন বৃদ্ধি পেলেও এর ফলে পরিবেশে ব্যাপক প্রভাব পড়ছে। তাই আমাদের কৃষি সম্প্রদায়ের মধ্যে ‘কীভাবে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে পরিবেশবান্ধব কৃষি পরিচালনা করা যায়’ - এ বিষয়ে ব্যাপক সচেতনতা তৈরির জন্য আলোচনা হচ্ছে।"
শিহাব