
.
প্রায় দেড় যুগ ধরে বিএনপি ক্ষমতার বাইরে। অনুকূল পরিবেশ পেয়ে এখন নির্বাচনের অপেক্ষায় দলটি। তবে সরকারের তরফ থেকে নির্বাচন নিয়ে সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা না করায় দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে অস্থিরতা বিরাজ করছে। তাই দ্রুত নির্বাচনের দাবিতে নেওয়া হয়েছে বিভিন্ন কৌশল। এরই অংশ হিসেবে আজ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করবে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে বিএনপির একটি প্রতিনিধি দল। এ সময় দ্রত নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার দাবিতে আল্টিমেটাম দেওয়া হবে। এরপরও দাবি আদায় না হলে আন্দোলনের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে বিএনপি।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকেই ত্রয়োদশ জাতীয় সংস নির্বাচনের দাবিতে ধারাবাহিকভাবে বিএনপি নির্বাচনের টাইম লাইন দাবি করে আসছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে বার বার এ বছর ডিসেম্বর থেকে ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে নির্বাচনের কথা বলা হলেও সুনির্দিষ্ট করে নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা না করায় বিএনপি নেতাকর্মীরা ক্ষুব্ধ।
এ পরিস্থিতিতে আজ বুধবার দুপুর ১২টায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করবে বিএনপি মহাসচিবের নেতৃত্বে দলের একটি প্রতিনিধি দল। পরদিন সংস্কার ইস্যুতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠক করবে। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকের সময় নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণাসহ দলের পক্ষ থেকে বেশ কিছু দাবি-দাওয়া তুলে ধরবেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। কি কি দাবি দাওয়া তুলে ধরা হবে তা আগেই দলীয় ফোরামে আলোচনা করে ঠিক করা হয়েছে বলে জানা যায়।
সূত্র মতে, প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় আজকের বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রথমেই জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপের বিষয়ে জানতে চাইবে বিএনপি। প্রধান উপদেষ্টা রোডম্যাপ ঘোষণা করতে সময় চাইলে দলের পক্ষ থেকে একটি আল্টিমেটাম দেওয়া হবে। এ ছাড়া নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার দ্রুত করা, দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও দ্রব্যমূল্যসহ সার্বিক বিষয়ে কথা বলবেন দলের নেতারা। এরপর সরকারের মনোভাব বুঝে করণীয় ঠিক করবে বিএনপি। যদিও ইতোমধ্যেই আন্দোলন কর্মসূচি ঠিক করে রাখা হয়েছে। আন্দোলনের বিষয়ে সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোরও মতামত নেওয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ নিয়ে সরকারের সঙ্গে বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে যখন টানাপোড়েন চলছে ঠিক তখন অনুষ্ঠিত হচ্ছে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বিএনপির এই বৈঠক। তাই আজ প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বিএনপি নেতাদের বৈঠকে নির্বাচনী রোডম্যাপের বিষয়ে কি হয় এ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনসহ সর্বত্র ব্যাপক জল্পনা-কল্পনা চলছে। নির্বাচন কমিশনও এ বৈঠকের সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করছে বলে জানা যায়।
এ বিষয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানিয়েছেন, আশা করছি সরকারের সঙ্গে আলোচনার পর নির্বাচনী রোডম্যাপসহ সকল সমস্যার সমাধান হবে। আর তা না হলে একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপিকে গণতন্ত্রের স্বার্থে যা যা করণীয় তাই করতে হবে। কারণ, অনির্বাচিত সরকার দেশের সমস্যা সমাধান করতে পারবে না। জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকারই রাষ্ট্র সংস্কারসহ দেশের সকল সমস্যার দ্রুত সমাধান করতে পারবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির একজন কেন্দ্রীয় নেতা জানান, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠককালে দলের পক্ষ থেকে দ্রুত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের গুরুত্ব তুলে ধরে এ নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানানো হবে। তবে প্রধান উপদেষ্টা রোডম্যাপ ঘোষণা না করলে বিএনপির পক্ষ থেকে একটি আল্টিমেটাম দেওয়া হবে। আর জানিয়ে দেওয়া হবে এ আল্টিমেটাম অনুসারে নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা না করা হলে এর প্রতিবাদে রাজপথে কর্মসূচি পালন করা হবে।
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করা না হলেও বিএনপি নানা কৌশল নিয়ে মাঠে সক্রিয় রয়েছে। দলটি এখন সকল কর্মসূচি পালন করছে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। প্রতিটি সংসদীয় আসনের জন্য ৩ জন করে প্রার্থী ঠিক করে রেখেছেন বিএনপি। তবে ৩০০ আসনের জন্য প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত করবে সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর। এ জন্য প্রার্থীদের বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।
তবে কোনো অবস্থাতেই বিলম্বে জাতীয় সংসদ নির্বাচন বা আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন চায় না বিএনপি। এ জন্যই তারা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও নির্বাচন কমিশনের কাছে দ্রুত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছে। অবশ্য বিএনপির দাবির প্রতি সাড়া দিয়ে নির্বাচন কমিশনও (ইসি) আগে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। সরকারের অনুমতি পেলে ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের জন্য সকল প্রস্তুতি নির্বাচন কমিশন শেষ করতে চায় বলেও জানিয়ে দিয়েছে।
জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি জোরদার করার বিষয়ে সারাদেশের নেতাকর্মীদের প্রতি তারেক রহমানের বিশেষ বার্তার পর এখন কেন্দ্র থেকে শুরু করে সর্বস্তরে যেসব কর্মসূচি চলছে তাতে নির্বাচনী আমেজ সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে জেলা-উপজেলা পর্যায়ের দলীয় কর্মসূচিতে সম্ভাব্য প্রার্থীরা বিভিন্নভাবে শোডাউন করছেন। আর গণসংযোগ বাড়িয়ে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে কথা বলছেন। কেউ কেউ নিজের প্রার্থী হওয়া সম্পর্কেও নেতাকর্মীদের মতামত নিচ্ছেন। এ ছাড়া প্রতিটি সংসদীয় এলাকায় স্থানীয় নেতাকর্মীদের নিয়মিত মতবিনিময় সভা হচ্ছে। এর মাধ্যমে সারাদেশেই নির্বাচনী আমেজ সৃষ্টি হয়ে গেছে বলে বিএনপি নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষ মনে করছেন।
দেশব্যাপী নির্বাচনমুখী আরও বিভিন্ন কর্মসূচি পালনের মধ্য দিয়ে বিএনপি সর্বস্তরে নেতাকর্মীদের চাঙ্গা করবে। সেই সঙ্গে প্রতিটি নির্বাচনী এলাকায় সম্ভাব্য প্রার্থীদের আমলনামাও পর্যবেক্ষণ করবে। আগে ঠিক করে রাখা প্রতি আসনের ৩ জন সম্ভাব্য প্রার্থীর পাশাপাশি এর বাইরে অধিক জনপ্রিয় কোনো প্রার্থীর সন্ধ্যান পাওয়া যায় কি না তাও পর্যবেক্ষণ করবে দলীয় হাইকমান্ড। এর পর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর ৩০০ আসনে প্রার্থী চূড়ান্ত করা হবে বলে জানা যায়। দলের নেতাদের মতামত নিয়ে প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত করবেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। আর তাকে এ কাজে সহযোগিতা করবেন দলের আরও ক’জন সিনিয়র নেতা।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিভিন্ন অপপ্রচার থেকে মুক্ত থাকতে দলীয় কৌশল ঠিক করেছে বিএনপির হাইকমান্ড। এরই অংশ হিসেবে দলের যে নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে যখন যে অভিযোগ আসছে দ্রুত তদন্ত করে তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক শাস্তি নিশ্চিত করা হচ্ছে। গত কয়েক মাসে সারাদেশের বিভিন্ন পর্যায়ের দুই শতাধিক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে শাস্তির ব্যবস্থা করেছে বিএনপি। এতে জাতীয় নির্বাচনের আগে দলের পক্ষ থেকে জনগণের কাছে এই বার্তা গেছে যে বিএনপি অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কাউকে প্রশ্রয় দিচ্ছে না। তাই এ বার্তা দলের জন্য ইতিবাচক বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
গতবছর ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের ৩ দিন পর ৮ আগস্ট প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে। সবার আগে এ সরকারকে স্বাগত জানায় বিএনপি। এখনো এ সরকারের প্রতি আস্থা থাকার কথা বললেও ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের টাইম লাইন না দেওয়ায় আস্থা সংকট দেখা দিয়েছে। তবে দ্রুত নির্বাচনের টাইম লাইন ঘোষণা করা হলে এ সংকট থাকবে না বলে দলটির নেতাকর্মীরা জানান।
সূত্র মতে, বিএনপি চায় নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কিছু সংস্কার শেষে দ্রুত জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচনের পর বিজয়ী হলে তারা আগের দেওয়া ৩১ দফা প্রস্তাবের আলোকে রাষ্ট্র মেরামতের জন্য সংস্কার চায়। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাছেও এ বিষয়টি তুলে ধরেছে বিএনপি। দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠনের লক্ষ্যে বিএনপি নিজস্ব রাজনৈতিক কৌশল নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে।
অভিজ্ঞ মহলের মতে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিএনপির রাজনৈতিক অবস্থান এখন সুদৃঢ়। তাই দ্রুত নির্বাচন হলে বিএনপির ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। এ জন্যই দলটির সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা দ্রুত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছেন। বিএনপি নেতাকর্মীরা মনে করছেন, নির্বাচনকেন্দ্রিক ন্যূনতম সংস্কার শেষ করে যত দ্রুত সম্ভব জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন করা জরুরি। কারণ, সংসদ নির্বাচন না হলে দেশে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে না। আর জনগণের সরকার না হলে অনেক সমস্যার বাস্তবসম্মত সমাধান হবে না। তাই বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে নির্বাচনের জন্য চাপে রাখতে চায় বিএনপি। এ জন্য প্রয়োজনে আন্দোলনও করতে চায়।
উল্লেখ্য, ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর ক্ষমতা ছাড়ার পর থেকে রাজপথে আন্দোলন সংগ্রাম করে এ পর্যন্ত এসেছে বিএনপি। বর্তমানে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া লন্ডনে চিকিৎসাধীন। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও দীর্ঘদিন লন্ডনে অবস্থান করছেন। তবে তিনি লন্ডনে থাকলেও দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে দিকনির্দেশনা দিয়ে দলকে এগিয়ে নিচ্ছেন।