ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৮ এপ্রিল ২০২৫, ৫ বৈশাখ ১৪৩২

সমলয় পদ্ধতিতে ধানের চাষ

কৃষিক্ষেত্রে ভিন্ন মাত্রা কমছে ব্যয়, কৃষক লাভবান

রফিকুল ইসলাম আধার

প্রকাশিত: ২১:৫৮, ১৫ এপ্রিল ২০২৫; আপডেট: ২১:৫৮, ১৫ এপ্রিল ২০২৫

কৃষিক্ষেত্রে ভিন্ন মাত্রা কমছে ব্যয়, কৃষক লাভবান

শেরপুরে সমলয় পদ্ধতিতে ধানের চারা রোপণ করা হচ্ছে যন্ত্রের মাধ্যমে

কৃষি ও খাদ্যসমৃদ্ধ অঞ্চল শেরপুরে এবার প্রচলিত সনাতন পদ্ধতিতে বীজতলা তৈরি ও চারা রোপণের বদলে সমলয় চাষাবাদ পদ্ধতিতে রোপণ করা হয়েছে ধানের চারা। রাইস ট্রান্সপ্লান্টার যন্ত্রের মাধ্যমে ধানের চারা রোপণ ও কম্বাইন্ড হার্ভেস্টর যন্ত্রের মাধ্যমে ধান মাড়াই করার কারণে একদিকে যেমন কাটছে শ্রমিক সংকট, অন্যদিকে আধুনিক চাষাবাদে কমছে উৎপাদন খরচ। এ ছাড়া উচ্চ ফলনশীল জাতের ধানের বীজ ব্যবহার করায় স্বাভাবিক সময়ের ১০/১৫ দিন আগেই ফসল ঘরে তোলা যায়। এতে লাভবান হচ্ছেন প্রান্তিক কৃষকরা। এ কারণে আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদে কৃষকদের আগ্রহী করে তুলছে জেলা কৃষি বিভাগ। কৃষি বিভাগের দাবি, আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কৃষি খাতে যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে দেশের কৃষিখাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা সম্ভব।
জানা যায়, কৃষি যান্ত্রিকীকরণের অংশ হিসেবে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে পুনর্বাসন কর্মসূচির আওতায় সমলয় চাষাবাদে যান্ত্রিক উপায়ে রাইস ট্রান্সপ্লান্টার যন্ত্রের মাধ্যমে বোরো ধানের বীজতলা তৈরি ও ধানের চারা রোপণ করেছেন শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার কৃষকরা। এ পদ্ধতিতে এক একর জমিতে চারা রোপণ করতে সময় লাগছে মাত্র একঘণ্টা। সনাতন পদ্ধতিতে ১ একর জমিতে ধানের চারা রোপণে খরচ পড়ে ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা। এতে দিনে ২০ জন শ্রমিকের প্রয়োজন হয়। আবার মৌসুমের সময় শ্রমিক না পাওয়ায় দুশ্চিন্তায় থাকেন কৃষকরা। কৃষকের এসব সমস্যার সমাধান দিচ্ছে সমলয় পদ্ধতি। কৃষকরা বলছেন, এ পদ্ধতিতে যন্ত্রের ব্যবহারের ফলে কমেছে খরচ, বেঁচে যাচ্ছে সময়। শ্রমিক সংকটের চিন্তার ভাঁজও নেই কৃষকদের কপালে। 
কৃষি বিভাগ সূত্র জানায়, সমলয় পদ্ধতিতে চাষাবাদের জন্য বিশেষ অটোমেটিক কৃষিযন্ত্রের মাধ্যমে ট্রেতে চারা বপন করা হয়। ট্রেতে চারা বপন যন্ত্রের ৩টি চেম্বার থাকে। ট্রের প্রথম চেম্বারে মেশিনের মাধ্যমে মাটি দেওয়া হয়। আর দ্বিতীয় চেম্বারে মেশিনের মাধ্যমে অঙ্কুরিত বীজ দেওয়া হয়। পরে তৃতীয় চেম্বারে আবারও মেশিনের মাধ্যমে মাটি দিয়ে বীজ ঢেকে দেওয়া হয়। এরপর ট্রেগুলো জমিতে সারিবদ্ধভাবে রাখা হয়। মাটি যেন শুকিয়ে না যায়, সেজন্য পরিমিত পানি স্প্রে করা হয়। চারার উচ্চতা ৪ ইঞ্চি হলে বা চারার বয়স ২০ থেকে ২৫ দিন হলে তা জমিতে রোপণ করার উপযোগী হয়। রাইস ট্রান্সপ্ল্যান্টার দিয়ে চারা একই গভীরতায় সমানভাবে লাগানো যায়। ফলে ফলনও বাড়ে। একসঙ্গে রোপণ করায় ধান একসঙ্গে পাকে ও কৃষকরা একসঙ্গে ধান ঘরেও তুলতে পারেন।
সরেজমিনে নালিতাবাড়ী উপজেলার রাজনগর এলাকায় গেলে কথা হয় সমলয় পদ্ধতিতে চাষাবাদ করা চাষিদের সঙ্গে। কৃষক সাইফুল ইসলাম জানান, বোরো ধান চাষাবাদে তারা এর আগে কখনো আধুনিক যন্ত্রের মাধ্যমে ট্রেতে ধানের চারা উৎপাদন করেননি। এবার কৃষি বিভাগের সহযোগিতায় যন্ত্র দিয়ে ধানের বীজতলা তৈরি ও চারা রোপণ করেছেন। এতে সনাতন পদ্ধতির চেয়ে খরচও কম পড়েছে। কৃষক বিমল চন্দ্র বর্মণ বলেন, প্রথমবারের মতো এমন পদ্ধতিতে ধানের বীজতলা করেছি। কৃষি অফিস থেকে বিনামূল্যে বীজ ও সার দিয়েছে। যন্ত্র দিয়ে ধানের চারা লাগিয়েও দিয়েছে। এ কারণে এবার আবাদে তেমন খরচ হয়নি। কৃষক আব্দুল কুদ্দুস জানান, সনাতন পদ্ধতিতে ধান লাগানোর জন্য শ্রমিক সংকট ও বাড়তি খরচ যন্ত্রের মাধ্যমে রোপণের জন্য কমে গেছে। ধানের ফলনও তুলনামূলক বেশ ভালো হবে আশা করছি। যেখানে সনাতন পদ্ধতিতে একরপ্রতি ৬৫-৭০ একর ধান পাওয়া যেত, সেখানে এবার একরপ্রতি ৮০-৮৫ মণ ধান পাওয়া যাবে বলে আমরা আশাবাদী। এতে দুদিক দিয়েই আমরা লাভবান হব। একই কথা জানান স্থানীয় কৃষক জ্যোতি ভূষণ, সুখমোহন চন্দ্র বর্মণসহ অনেকেই।
নালিতাবাড়ী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল ওয়াদুদ জানান, কৃষিকে আধুনিক ও লাভজনক করতে টেকসই যান্ত্রিকীকরণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সমলয় পদ্ধতিতে বীজতলা তৈরি, চারা রোপণ ও ধান কাটা- সবই যন্ত্রের মাধ্যমে হবে। কৃষকদের ভর্তুকি মূল্যে যন্ত্র দেওয়ার পাশাপাশি এ পদ্ধতিতে চারা রোপণ করতে স্থানীয় কৃষকদের ট্রেতে বীজতলা তৈরিসহ সহজে চারা উঠানোর প্রশিক্ষণ দিয়েছে কৃষি বিভাগ। চলতি বোরো মৌসুমে এবার নালিতাবাড়ীতে ৫০ একর জমিতে ৬৭ জন কৃষককে সমলয় পদ্ধতিতে চাষাবাদের জন্য বিনামূল্যে সার-বীজসহ রাইস ট্রান্সপ্লান্টার যন্ত্র দিয়ে ধানের চারা রোপণ করে দিয়েছে উপজেলা কৃষি বিভাগ।
এ ব্যাপারে জেলা খামারবাড়ির উপপরিচালক মো. সাখাওয়াত হোসেন বলেন, সমলয় পদ্ধতির চাষাবাদ আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতির সর্বোত্তম ব্যবহার। আর এ পদ্ধতি ব্যবহার কৃষিক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এজন্য কৃষিপ্রণোদনার আওতায় কম খরচে ওই পদ্ধতির চাষাবাদে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে বেশি ফলন পাওয়া যাচ্ছে। আর পুরোনো পদ্ধতির চেয়ে এ পদ্ধতি ব্যবহার করে অন্তত ১৫ দিন আগে ফসল ঘরে তোলা সম্ভব হচ্ছে। এজন্য আধুনিক এসব যন্ত্র ব্যবহারে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করছে জেলা কৃষি বিভাগ। তার মতে, চলতি বোরো মৌসুমে জেলায় ৯২ হাজার হেক্টরের বেশি জমিতে ধান আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে নকলা ও নালিতাবাড়ী উপজেলায় ১০০ একর জমিতে সমলয় পদ্ধতিতে চাষাবাদ হয়েছে। আগামী দিনে এ পদ্ধতিতে চাষাবাদ আরও বাড়বে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

প্যানেল

×