
ছবি: সংগৃহীত
পটুয়াখালী প্রজনন মৌসুমে সামুদ্রিক মাছ, বিশেষ করে ইলিশ রক্ষায় বাংলাদেশসহ উপকূলীয় অনেক দেশই প্রতিবছর একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সমুদ্রগামী মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা দিয়ে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে আজ (১৫ এপ্রিল) থেকে শুরু হচ্ছে ৫৮ দিনের বঙ্গোপসাগরে একটি সর্বাত্মক মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞা, যা চলবে ১১ জুন পর্যন্ত।
অন্যদিকে প্রতিবেশী দেশ ভারতও ১৫ এপ্রিল থেকে ১৪ জুন পর্যন্ত তাদের সমুদ্রসীমায় মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। অর্থাৎ দু’দেশের সমন্বিত এই উদ্যোগে বৃহৎ পরিসরে সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য ও মাছের প্রজননে সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি হবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
কেন এই নিষেধাজ্ঞা?
গ্রীষ্মের এই সময়টি সামুদ্রিক মাছ, বিশেষ করে ইলিশের প্রধান প্রজননকাল। মাছগুলো ডিম ছাড়ে উপকূলবর্তী এলাকায়। এই সময়ে যদি অধিক হারে মাছ ধরা হয়, তাহলে প্রজনন ব্যাহত হয় এবং পরবর্তী মৌসুমে মাছের উৎপাদনে মারাত্মক প্রভাব পড়ে।
এ কারণেই ২০১৫ সাল থেকে বাংলাদেশ সরকার সমুদ্রগামী সব প্রকার মাছ ধরায় প্রতি বছর গ্রীষ্মকালীন এই নিষেধাজ্ঞা চালু করে।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট-এর এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রজননকালে মাছ ধরা বন্ধ থাকলে পরবর্তী মৌসুমে ইলিশের উৎপাদন প্রায় ২০-২৫% পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। পটুয়াখালী জেলার মৎস্য কর্মকর্তা কামরুল ইসলাম বলেন, “এই সময়ে সামুদ্রিক মাছগুলো নিরাপদে ডিম ছাড়ে ও বংশবৃদ্ধি করে। দুই দেশের সমন্বিত এই নিষেধাজ্ঞা বঙ্গোপসাগরের মৎস্যসম্পদ সংরক্ষণে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হবে।”
সমুদ্র শান্ত, কিন্তু উপকূল উত্তাল
তবে মাছ ধরার ওপর এই দীর্ঘমেয়াদি নিষেধাজ্ঞা সরাসরি আঘাত হানে উপকূলের লাখো মানুষের জীবিকায়। বিশেষ করে দিনমজুর নির্ভর জেলে পরিবারগুলো এই সময়ে চরম দুর্দশায় পড়ে। সরকার প্রতি বছর নিবন্ধিত জেলেদের জন্য খাদ্য সহায়তা ঘোষণা করলেও, বাস্তব চিত্র কিছুটা ভিন্ন।
পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালীর উপজেলার জেলে ইউনুছ হাওলাদার মাঝি বলেন, “নিষেধাজ্ঞা হলেই আমাদের কাজ বন্ধ। সরকার বলে চাল দেবে, কিন্তু অনেক সময় পাই না, আবার দেরি হয়। অনেকেই পাই না যারা সত্যিই মাছ ধরে।”
পটুয়াখালী জেলায় বর্তমানে নিবন্ধিত জেলে ৬৯ হাজারের বেশি। কিন্তু স্থানীয়ভাবে ধারণা করা হয়, অনিবন্ধিত ও ভাসমান জেলে মিলিয়ে এ সংখ্যা ১ লাখ ছাড়িয়ে যায়। এদের অনেকে সরকারি সহায়তার বাইরে থেকে যান।
স্থানীয় মৎস্যজীবী সংগঠনগুলোর দাবি, সহায়তার তালিকায় অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতি রয়েছে। সহায়তার চাল সময়মতো পৌঁছায় না, এবং প্রকৃত জেলের জায়গায় অনেক সময় সুবিধাভোগী হন প্রভাবশালী ব্যক্তি বা রাজনৈতিক সংযোগধারীরা।
সমন্বিত প্রচেষ্টা—ভবিষ্যতের জন্য সম্ভাবনা
এই বছর বাংলাদেশের নিষেধাজ্ঞা ১৫ এপ্রিল থেকে ১১ জুন, আর ভারতের ১৫ এপ্রিল থেকে ১৪ জুন পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। ফলে এই সময়টায় বঙ্গোপসাগরের বড় একটি অঞ্চল কার্যত নিষ্ক্রিয় থাকবে মাছ ধরার ক্ষেত্রে, যা ভবিষ্যতের জন্য টেকসই মাছ উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সামুদ্রিক মাছের উৎপাদন বাড়াতে এবং প্রজাতিসমূহের টেকসই ভবিষ্যত নিশ্চিতে প্রজনন মৌসুমে মাছ ধরা বন্ধ রাখার এই উদ্যোগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
আন্তর্জাতিক মৎস্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়ার্ল্ড ফিশ-এর সাবেক গবেষক ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্য বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. মীর মোহাম্মদ আলী বলেন, “বঙ্গোপসাগরে মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত সময়টি ইলিশসহ অনেক সামুদ্রিক মাছের জন্য প্রজননের উপযুক্ত সময়। এই সময়ে মাছ ধরা বন্ধ রাখা মানে শুধু পরবর্তী মৌসুমের উৎপাদন বাড়ানো নয়, বরং সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য রক্ষা, খাদ্য চক্র বজায় রাখা ও দীর্ঘমেয়াদে সমুদ্রসম্পদ টেকসই করার জন্য একটি অত্যন্ত কার্যকর কৌশল।”
তিনি আরও বলেন, “বিশ্বের উন্নত মৎস্যসম্পন্ন দেশগুলোও এই ধরনের নিষেধাজ্ঞাকে সমুদ্রসম্পদ ব্যবস্থাপনার মূল অংশ হিসেবে বিবেচনা করে। আমাদের মতো দেশগুলোর জন্য এটি আরও গুরুত্বপূর্ণ, কারণ আমাদের বিপুল জনগোষ্ঠী সামুদ্রিক মাছের ওপর নির্ভরশীল। তাই বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ এই সিদ্ধান্ত একটি প্রশংসনীয় অগ্রগতি। তবে, এটি যেন শুধু প্রশাসনিক আদেশে সীমাবদ্ধ না থাকে। মাঠপর্যায়ে জেলেদের জন্য বিকল্প জীবিকা, খাদ্য সহায়তা এবং সচেতনতা নিশ্চিত করতে হবে—তা না হলে তারা অনিয়মিতভাবে মাছ ধরায় ফিরে যেতে পারে, যা পুরো উদ্যোগকেই ক্ষতিগ্রস্ত করবে।”
সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, নিষেধাজ্ঞা একটি সময়োপযোগী ও বৈজ্ঞানিক পদক্ষেপ, তবে এর সাথে সমান্তরালভাবে জেলেদের জন্য সঠিক তালিকাভুক্তি, নিয়মিত খাদ্য সহায়তা, এবং জীবিকা বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা জরুরি। সাগর যেমন বিশ্রাম পাচ্ছে, তেমনি বিশ্রামের দরকার উপকূলবাসীর দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মনেও।
আবীর