ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৬ এপ্রিল ২০২৫, ২ বৈশাখ ১৪৩২

শত বাধা পেরিয়ে যেভাবে সফল উদ্যোক্তা হলেন জাসমা আজম

শফিকুল ইসলাম শামীম, নিজস্ব সংবাদদাতা, রাজবাড়ী

প্রকাশিত: ২২:০৭, ১৪ এপ্রিল ২০২৫

শত বাধা পেরিয়ে যেভাবে সফল উদ্যোক্তা হলেন জাসমা আজম

ছবি: সংগৃহীত

শত বাধা পেরিয়ে সাফল্যের চূড়ায় জাসমা আজম। না, খুব সহজে তিনি সাফল্যের চূড়ায় পা রাখতে পারেননি। প্রবল ইচ্ছা শক্তি ও স্বামী মাহাবুবুল আজমের অনুপ্রেরণায় বৈষম্য ভেঙে আজ তিনি সফল উদ্যোক্তা।

এখনও প্রতি মুহূর্ত, প্রতিদিন কঠোর পরিশ্রম করে ও শত বাধা পেরিয়ে চলতে হয়। ভোর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত নিজের হাতে গড়ে তোলা সন্তান সমতুল্য প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন মাতৃস্নেহে।

রাজবাড়ী সদর ও গোয়ালন্দ উপজেলার সীমান্তবর্তী নবুওছিমদ্দিন পাড়া এলাকার গৃহবধূ জাসমা আজম। বাবা-মায়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে নবম শ্রেণিতে পড়াকালীন বিয়ের পিঁড়িতে বসেন জাসমা। স্বামীর সংসারে গিয়ে এসএসসি পাস করেন। না, আর পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। অপ্রাপ্ত বয়সে লেখাপড়া ছেড়ে বাবা-মায়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে করায় অনুশোচনায় ভুগছিলেন তিনি।

কীভাবে সততা বজায় রেখে সফলতার সিঁড়িতে পা দেওয়া যায়, এই ভাবনা প্রতি মুহূর্ত জাসমাকে তাড়িয়ে বেড়াতো, ঠিকমত ঘুমোতে দিতো না। সংসারের কাজকর্ম শেষে অবসরে মোবাইলের মাধ্যমে ইন্টারনেট দুনিয়ায় ঘুরতে থাকেন। দেখতে থাকেন নিজ কর্মে সফলতা পাওয়া নারী-পুরুষের জীবনকাহিনী।

একদিন জাসমা হঠাৎ ছুটে গেলেন উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার অফিসে, তাঁর পরামর্শ ও সহযোগিতার প্রয়োজনে। গোয়ালন্দ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোঃ খোকন উজ্জামানের কাছ থেকে সুপরামর্শ ও সার্বক্ষণিক সহযোগিতার আশ্বাস এবং উৎসাহ নিয়ে আসেন তিনি।

অবশেষে নিজের ইচ্ছা শক্তি ও মনোবল কাজে লাগান ২০২১ সালের শুরুতে। স্বামী মাহাবুবুল আজম থেকে নেন ৩০ হাজার টাকা। নিজের জমিয়ে রাখা ২০ হাজারসহ মোট ৫০ হজার টাকা মূলধন নিয়ে বাড়ির আঙিনায় শুরু করেন ভার্মি কম্পোস্ট ও জৈব সার উৎপাদন।

নিজের তৈরি জৈব সার বিক্রি করতে কৃষকের দ্বারে দ্বারে যাওয়া শুরু করেন জাসমা আজম। কোনো সাড়া পাচ্ছিলেন না স্থানীয় কৃষকের। তবুও ভেঙে পড়েননি জাসমা আজম। আবারও ছুটে যান উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার অফিসে, নিজের তৈরি সার কীভাবে বিক্রি করবেন সে পরামর্শের জন্য।

সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন কৃষি কর্মকর্তা, তখনই জাসমা আজমের তৈরি প্রায় ২৭ মণ জৈব সার বিক্রি করার ব্যবস্থা করেন তিনি (মোঃ খোকন উজ্জামান)। জাসমা আজমের প্রবল ইচ্ছা শক্তি দেখে কৃষি কর্মকর্তা তাঁকে একটি প্রজেক্ট দিলেন।

তিনি জাসমার জন্য জৈব সার তৈরির ঘর, রিং ও মেশিনের ব্যবস্থা করেন। কাজের উৎসাহ পেলেন জাসমা আজম। নিজের তৈরি জৈব সার বিক্রির চিন্তা বাদ দিয়ে পুরোদমে উৎপাদন শুরু করলেন। অল্প কিছু দিনের মধ্যে রাজবাড়ী সদর ও গোয়ালন্দ উপজেলার কৃষকদের আস্থার জায়গা তৈরি হলো জাসমা আজম ও তাঁর তৈরি করা জৈব সার।

চিত্র: নিজের প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন জাসমা আজম

গ্রামীণ পরিবেশে জাসমা আজমের ভার্মি কম্পোস্ট তৈরি ফার্মের জৈব সার এখন জেলার সাধারণ কৃষকের আস্থা। রাজবাড়ী জেলার সদর ও গোয়ালন্দ উপজেলার মাঝে নবুওছিমদ্দিন পাড়ার গৃহবধূ জাসমা আজম নিজ উদ্যোগ ভার্মি কম্পোস্ট ও জৈব সার তৈরির মাধ্যমে কৃষিক্ষেত্রে এনেছে এক নতুন সম্ভাবনা।

জাসমা আজমের উদ্যোগ এখন শুধু নিজের পরিবারের জন্য নয়, বরং জেলার অনেক কৃষকের জন্যও একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। তাঁর এই উদ্যোগ পরিবেশ সুরক্ষার পাশাপাশি স্থানীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখছে। কর্মসংস্থান হয়েছে অনেক নারী-পুরুষের।

জাসমা এখন কৃষকের দ্বারে দ্বারে ছুটে যান না, কৃষকেরা ছুটে আসেন তাঁর জৈব সার নিতে। দুই উপজেলার সাধারণ কৃষকদের ৫০ শতাংশ জৈব সারের যোগান দিচ্ছেন তিনি। মাত্র ৩ বছর বয়সী এই প্রতিষ্ঠানে এখন জাসমা আজমসহ ৫/৬ জন নারী শ্রমিক কাজ করেন। হোম ডেলিভারি দেওয়ার জন্য রয়েছে একজন পুরুষ শ্রমিক।

চিত্র: নিজের প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন জাসমা আজম

জাসমা শুধু ভার্মি কম্পোস্ট ও জৈব সার উৎপাদন করেন না। তিনি এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অসহায় নারীদের বিনা পারিশ্রমিকে প্রশিক্ষণও দিচ্ছেন। ভার্মি কম্পোস্ট ও জৈব সার তৈরি করার জন্য তিনি পরামর্শও দিয়ে থাকেন। জেলার কৃষকরা যেমন তাঁর কাছে সারের প্রয়োজনে ছুটে আসেন, তেমনি অনেকে দেখতে আসেন তাঁর তৈরি ফার্ম ও সার উৎপাদন প্রক্রিয়া।

ঘরের চার দেয়ালে আটকে না রেখে প্রতিটি পরিবারের নারীকে কাজ করার সুযোগ দেওয়া উচিত বলে মনে করেন সফল উদ্যোক্তা জাসমা আজম। তাঁর প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘এই প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার সবচেয়ে বড় অবদান আমার স্বামীর। শুধু অর্থ দিয়ে নয়, আমার মনোবল শক্ত রাখার জন্য আমার স্বামী সার্বক্ষণিক আমার পাশে দাঁড়িয়েছেন। সুতরাং তাঁর সহযোগিতা না থাকলে হয়তো এই পর্যন্ত আসতে পারতাম না।’

যেকোনো নারী তাঁর প্রতিস্থানে বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ নিতে পারবেন জানিয়ে জাসমা আজম আরও বলেন, ‘আমি কাউকে প্রতিযোগী মনে করবো না বরং সার্বিক সহযোগিতা করবো।’ সরকারিভাবে গ্রামীণ নারীদের নিয়ে আরও ভাবলে কোনো নারী ঘরে বসে থাকবে না, নারীর হাত বেঁধে না রেখে কাজের হাতে রূপান্তর করতে হবে বলে মনে করেন তিনি।

সার তৈরির প্রশিক্ষণ নিতে আসা জাসমার পাশের বাড়ির সুমনা নামের এক নারী বলেন, ‘১৫ বছর হলো আমার বিয়ে হয়েছে। আমি এসএসসি পাস করেছি। সামর্থ থাকার পরও ঘরের চার দেয়ালের বাইরে কিছু করতে পারিনি। যেকারণে স্বামীর পকেটের দিকে তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে। আমরা যেটা পারিনি, জাসমা সেটা পেরেছে। জাসমা এখন আমাদের অনুপ্রেরণা হয়ে দাঁড়িয়েছে।’

এলাকার একাধিক কৃষক বলেন, তারা এখন রাসায়নিক সারের উপর নির্ভরশীল নয়। সকল প্রকার ফসলের জন্য তারা ছুটে যান জাসমার তৈরি জৈব সার নিতে। জাসমা আজম তাদের আস্থার জায়গা হয়ে উঠেছে।

জাসমার স্বামী মাহাবুবুল আজম বলেন, ‘আমার স্ত্রীর কাজকে আমি শ্রদ্ধা করি। কারণ মেধাকে ঘরে সাজিয়ে না রেখে বিকশিত হতে দেওয়া উচিত। এতে শুধু পরিবারের আয়ের উৎস নয়, তা দেশেরও অনেক কাজে লাগে। এটা ভেবেই আমি আমার স্ত্রীর কাজে সার্বিক সহযোগিতা করি।’

প্রাথমিকভাবে জাসমা আজমের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া গোয়ালন্দ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোঃ খোকন উজ্জামান জানান, ‘জাসমা আজম গোয়ালন্দ উপজেলার নারীদের অনুপ্রেরণা হয়েছেন। তাঁকে অনেক নারী-পুরুষ অনুসরণ করছেন। এই জাসমা একদিনে এখানে আসেননি। তিনি তাঁর ইচ্ছা শক্তি কাজে লাগিয়ে শত বাধা পেরিয়ে আজ আলোর পথে।’

কৃষি কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘জাসমা আজম এখন উপজেলার সফল উদ্যোক্তাদের মধ্যেও সফল। তিনি আমার পক্ষ থেকে সকল প্রকার সহযোগিতা ও পরামর্শ পাবেন। তাঁকে দেখে, অনুসরণ করে উপজেলার অনেক নারী স্বাবলম্বী হতে পারবেন।’

শফিকুল ইসলাম শামীম/রাকিব

আরো পড়ুন  

×