ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৫ এপ্রিল ২০২৫, ২ বৈশাখ ১৪৩২

হাজার বছরের বিবর্তন পেরিয়ে যেভাবে পহেলা বৈশাখ হলো বাঙালির নববর্ষ

মেহেদী কাউসার

প্রকাশিত: ১৯:৫০, ১৩ এপ্রিল ২০২৫

হাজার বছরের বিবর্তন পেরিয়ে যেভাবে পহেলা বৈশাখ হলো বাঙালির নববর্ষ

ছবি: প্রতীকী

নতুন বছর মানেই নতুন স্বপ্ন, নতুন সম্ভাবনা। আর বাঙালির এই নতুন বছরের সূচনা ঘটে পহেলা বৈশাখে। গ্রীষ্মের শুরুতে ঝড়ো হাওয়ার মাঝেই যখন প্রকৃতি নেয় নতুন রূপ, তখনই বাঙালি আপন ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিতে রঙ ছড়ায় বাংলা নববর্ষের আয়োজনে।

১৪ এপ্রিল, পহেলা বৈশাখ— বাংলাদেশসহ বিশ্বের বাঙালিদের কাছে শুধু একটি দিন নয়, এক বিশাল আবেগ, এক সাংস্কৃতিক জাগরণের নাম। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এই দিনটি পরিণত হয় এক সর্বজনীন উৎসবে।

বাংলা নববর্ষের ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, এর উৎপত্তি কিন্তু বাংলায় নয়, বরং প্রাচীন ভারতে। খ্রিস্টপূর্ব ৫৭ অব্দে রাজা বিক্রমাদিত্য প্রবর্তন করেন বিক্রমী পঞ্জিকা। পরবর্তীতে এ পঞ্জিকার প্রভাব পড়ে ভারতের পূর্বাঞ্চলে, যেখানে নিছক ঋতুভিত্তিক উৎসব হিসেবে পালিত হতো পহেলা বৈশাখ।

বাংলার মাটিতে বাংলা সনের গোড়াপত্তন ঘটে ৭ম শতকে, গৌড়েশ্বর রাজা শশাঙ্কের সময়কালে। তবে বাংলা বর্ষপঞ্জিকে প্রশাসনিকভাবে কার্যকর রূপ দেন মুঘল সম্রাট আকবর। কৃষি নির্ভর অর্থনীতিতে চন্দ্র বছরের অমিলের কারণে চাষাবাদের সাথে রাজস্ব আদায়ে জটিলতা তৈরি হতো।

এ সমস্যা সমাধানে ১৫৮৫ সালে আকবর প্রবর্তন করেন ‘তারিখ-এ-এলাহী’ নামক একটি সৌরনির্ভর বর্ষপঞ্জি। এর গণনা শুরু হয় ১৫৫৬ সালের ৫ নভেম্বর, আকবরের সিংহাসনে আরোহনের দিন থেকে। এই পঞ্জিকার রূপদানে ভূমিকা রাখেন জ্যোতির্বিদ আমীর ফতুল্লাহ সিরাজি। পরবর্তীতে এই বর্ষপঞ্জি ‘ফসলি সন’ এবং পরে ‘বঙ্গাব্দ’ নামে পরিচিতি লাভ করে।

বাংলা মাসের নাম ও দিনপঞ্জির মূল উৎস সংস্কৃত গ্রন্থ সূর্য সিদ্ধান্ত। ভারতের পশ্চিমবঙ্গসহ বিভিন্ন অঞ্চলে আজও এই চান্দ্রসৌর পঞ্জিকা অনুসরণ করে পহেলা বৈশাখ পালিত হয় ১৫ এপ্রিল।

বাংলাদেশে বাংলা বর্ষপঞ্জির আধুনিকীকরণ ঘটে ১৯৬৬ সালে, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে গঠিত কমিটির মাধ্যমে। ১৯৮৭ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করা হয় এই সংস্কারকৃত পঞ্জিকা, যাতে ১৪ এপ্রিলই নির্ধারিত হয় বাংলা নববর্ষের দিন হিসেবে। পরবর্তীতে ২০১৯ সালে আরও একবার ক্যালেন্ডার সংশোধন করা হয়। এতে বৈশাখ থেকে আশ্বিন পর্যন্ত প্রথম ছয় মাসে ৩১ দিন এবং ফাল্গুন বাদে বাকি মাসগুলোতে ৩০ দিন রাখা হয়। ফাল্গুন মাস অধিবর্ষে ৩০ দিন ধরা হয়।

সম্রাট আকবরের রাজস্ব সংস্কারের সঙ্গে জন্ম নেয় বাঙালির আরেক ঐতিহ্য— হালখাতা। পুরনো হিসাব গুটিয়ে নতুন খাতা খোলার রীতি গড়ে ওঠে তখন থেকেই। ঢাকার সুবেদার ইসলাম খান চিশতি ১৬১০ সালে এই উপলক্ষে প্রজাদের মাঝে মিষ্টি বিতরণের আয়োজন করতেন। ব্রিটিশ আমলেও ঢাকায় রূপলাল হাউস ও ভাওয়াল রাজার কাচারিবাড়িতে চলত পুণ্যাহ উৎসব। ব্যবসায়ীরা বাকিতে পণ্য বিক্রি করতেন, নববর্ষে লেনদেন হতো পরিশোধের মাধ্যমে। হালখাতার খাতা থাকত লাল সালুর মোড়কে বাঁধা— যেন এক বছরের আর্থিক ইতিহাসের নিঃশব্দ সাক্ষ্য।

১৯৬৭ সালে পাকিস্তানি শাসনামলে রমনার বটমূলে ছায়ানট আয়োজন করে বাংলা নববর্ষকে স্বাগত জানিয়ে সংগীতানুষ্ঠান। এটি হয়ে ওঠে বাঙালির সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের প্রতীক। এরপর ১৯৮৬ সালে যশোরের চারুপীঠ বের করে প্রথম শোভাযাত্রা, যার প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে দেশজুড়ে। ১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট আয়োজন করে বর্ণাঢ্য আনন্দ শোভাযাত্রা— মঙ্গল শোভাযাত্রার পূর্বসূরি। ১৯৯৬ সাল থেকে এই শোভাযাত্রা ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নামে পরিচিতি লাভ করে, যা ২০১৬ সালে ইউনেস্কোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি পায়।

আজ বাংলা নববর্ষ শুধু একটি দিন নয়— এ এক পরিচয়, এক সংস্কৃতি, এক জাতিসত্তার পুনর্জাগরণ। বৈশাখী মেলাগুলো, হালখাতা, রমনার বটমূল কিংবা মঙ্গল শোভাযাত্রা— সবই মিলেমিশে জানিয়ে দেয়, বাঙালির নববর্ষ কেবল উৎসব নয়, বরং ইতিহাস আর ঐতিহ্যের গর্বিত উত্তরাধিকার। কালবৈশাখীর ঝড়েও যে উদ্যমে বাঙালি নববর্ষ উদযাপন করে, তা প্রমাণ করে, এই উৎসব বাঙালির প্রাণের স্পন্দন।

এম.কে.

×