
ছবি: জনকণ্ঠ
সুন্নতে খতনা কিংবা আকিকার মতো ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান এখনো গ্রামীণ জনপদের মানুষের কাছে এক ধরনের উৎসব হিসেবেই বিবেচিত হয়। এসব অনুষ্ঠান বেশ গুরুত্বের সঙ্গেই উদযাপিত হয়। ছাপানো হয় দাওয়াতকার্ড, অতিথিদের আমন্ত্রণ জানানো হয়, আর আমন্ত্রিতরাও নির্ধারিত দিনে সময়মতো উপস্থিত হয়ে উপহারসামগ্রী ও নগদ অর্থ প্রদান করে থাকেন।
যে শিশু বা শিশুদের কেন্দ্র করে এসব আয়োজন, তাকে নতুন পোশাকে সাজিয়ে তোলা হয়। বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়, শিশুর নানার পক্ষ থেকে উপহার হিসেবে একটি গবাদি পশু দেওয়া হয়, যেটি রঙ করে অনুষ্ঠানস্থলে নিয়ে যাওয়া হয়। গ্রামের মানুষ উৎসুক দৃষ্টিতে দেখতে চায়—শিশুর নানা কী উপহার দিয়েছেন। এটি যেন এক অলিখিত সামাজিক রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অনুষ্ঠানে কে কত টাকা দিল, তা মাইকে প্রচার করা হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে উচ্চস্বরে বলা হয় ‘মারহাবা’। আগে এসব আয়োজন ছিল ঘনঘন, এখন হয় মাঝে মাঝে। বিশেষ করে ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা কিংবা জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে থাকলে এসব অনুষ্ঠান কিছুটা বেড়ে যায়। অনেকেই বলে থাকেন, লোভ বা সম্ভাব্য লাভের আশাতেই তখন এসব আয়োজন বেশি হয়। কারণ, সে সময় স্থানীয় নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বীরা আমন্ত্রিত থাকেন এবং উপহার কিংবা অর্থ দিয়ে উপস্থিতি জানান দেন।
এমনকি আয়োজক পরিবারও খেয়াল রাখে—কোন প্রার্থী কত টাকা দিলেন বা কী উপহার দিলেন। এতে বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখে পড়েন অনেক প্রার্থী, তবু সামাজিক চাপে উপস্থিত না থেকে উপায় থাকে না।
এখন আর আগের মতো নিয়মিত হয় না এসব অনুষ্ঠান, তবে থেমেও যায়নি। অনুষ্ঠানের আগে দাওয়াত পর্ব সেরে ফেলা হয়, ডেকোরেটর ভাড়া করে তৈরি করা হয় প্যান্ডেল। দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অতিথিদের খাবার পরিবেশন করা হয়। প্যান্ডেলের কাছেই মাইকে উচ্চস্বরে ঘোষণা করা হয়—কে কত টাকা উপহার দিলেন। এতে উপস্থিত সবাই শুনতে পান, আর কেউ কেউ বাহবা জানান।
এইসব আয়োজন আজও গ্রামীণ সমাজব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ রীতিতে পরিণত হয়েছে। শিশুসহ গ্রামের নারী-পুরুষ, তরুণ-তরুণী সবাই অংশগ্রহণ করেন। যেন একটি মিলনমেলায় পরিণত হয় আয়োজন। কেউ কেউ আবার অনুষ্ঠান শেষে গভীর রাত পর্যন্ত হিসাব মেলাতে বসেন—খরচ কত হলো, আয় কত হলো, লাভ হলো না লোকসান—এমন ভাবনারও কমতি নেই।
তবু যাই হোক, গ্রামীণ মানুষ এসব আয়োজনকে সামাজিক বন্ধন ও ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে ধরে রেখেছে। বিশেষ করে শুকনো মৌসুমে এ ধরনের অনুষ্ঠান বেশি দেখা যায়। কলাপাড়ার প্রতিটি ইউনিয়নের মানুষ এখনও এসব আয়োজনকে গ্রামীণ উৎসব হিসেবেই দেখে। প্রবীণদের মতে, বাবা-দাদার আমলে যেমন আয়োজন হতো, এখনো সেই ধারাবাহিকতা বজায় আছে, শুধু কিছু পরিবর্তন এসেছে আয়োজন পদ্ধতিতে—যেমন, ডেকোরেটর ভাড়া করা, বড় পরিসরের খাওয়ার আয়োজন ইত্যাদি।
ফলে বিনোদনের একটি উপাদান হিসেবেও এসব আয়োজন আজও টিকে আছে গ্রামীণ জনপদে, যা গ্রামবাংলার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির এক অনন্য বহিঃপ্রকাশ।
সায়মা ইসলাম