
ছবিঃ সংগৃহীত
দিল্লির রাত ঘনিয়ে এসেছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কার্যালয়ে জ্বলছে মৃদু আলো। তার টেবিলে ছড়িয়ে আছে শিলিগুড়ি করিডরের মানচিত্র—ভারতের কৌশলগত চিকেনস নেক। সেই সরু গলার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া তিস্তা নদীর রেখায় এখন ভেসে উঠেছে অনিশ্চয়তা। মোদীর চোখে আতঙ্কের ছায়া, কপালে দুঃশ্চিন্তার গভীর ভাঁজ। তার সামনে গোয়েন্দা রিপোর্টের এক মোটা ফাইল।
রিপোর্ট বলছে, তিস্তা নদী ঘিরে বাংলাদেশের নতুন প্রকল্পে চীনের সক্রিয় উপস্থিতি রয়েছে। সীমান্তের খুব কাছেই চীনা প্রকৌশলী, শ্রমিক এবং সম্ভবত গোয়েন্দারা অবস্থান নিতে চলেছেন। তিস্তার ঢেউ যেন ভারতের কণ্ঠে দড়ি পরাতে উদ্যত। জানালার দিকে তাকিয়ে মোদীর কানে যেন ভেসে এলো একটি গর্জন—চীনের নিশব্দ পদচারণা, যা ভারতের নিরাপত্তাকে নড়বড়ে করে দিতে পারে।
তিস্তা নদী বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের জীবনরেখা। ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই নদী সিকিম থেকে উৎপন্ন হয়ে পশ্চিমবঙ্গ হয়ে প্রবেশ করে বাংলাদেশে। দীর্ঘদিন ধরে ভারত এ নদীর পানি নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। গজলডোবা বাঁধে শুষ্ক মৌসুমে পানি আটকে রেখে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলকে খরার মুখে ঠেলে দেয়, আর বর্ষায় অতিরিক্ত পানি ছেড়ে দেয় বন্যায়।
২০২৩ সালে তিস্তার বন্যায় রংপুর ও কুড়িগ্রামে ১৮ হাজার হেক্টর ফসল নষ্ট হয়। ২০২৪ সালের গ্রীষ্মে পানির অভাবে হাজার হাজার হেক্টর জমি অনাবাদি থাকে। দীর্ঘদিন ধরে ভারতের এই একতরফা নিয়ন্ত্রণ বাংলাদেশকে জিম্মি করে রেখেছে।
১৯৮৩ সালে প্রথম পানি বণ্টনের খসড়া চুক্তি হলেও তা আর বাস্তবায়িত হয়নি। ২০১২ সালে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরোধিতায় বাতিল হয় আরেকটি সমঝোতা। ভারতের প্রতিশ্রুতি থেকে যায় শুধু কথার ফানুস হিসেবে।
সেই প্রেক্ষাপটে এবার বাংলাদেশ নিজস্ব সীমানায় পাল্টা প্রকল্পের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। বাঁধ, জলাধার, আর সেচ ব্যবস্থাসহ একটি পূর্ণাঙ্গ নদী ব্যবস্থাপনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যেখানে সহায়তায় এগিয়ে এসেছে চীন।
বিশেষজ্ঞ ড. আব্দুল মতিন জানান, এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের ভারতের ওপর পানি নির্ভরতা ৬০ শতাংশ কমে আসবে। ৫০০ কিলোমিটার তিস্তা নদী সংস্কারের মাধ্যমে বন্যা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে। ২০১৯ সালে চীন এই প্রকল্পে ১ হাজার মিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ প্রস্তাব দেয়। সম্প্রতি প্রফেসর মো. ইউনূস বেইজিং সফরে চীনা প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে পান তিস্তায় বাংলাদেশের পাশে থাকার আশ্বাস।
এটি শুধু একটি প্রকল্প নয়, বরং বাংলাদেশের আত্মমর্যাদার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তবে ভারতের জন্য বিষয়টি কৌশলগতভাবে দুঃস্বপ্ন। শিলিগুড়ি করিডর বা ‘চিকেনস নেক’ তিস্তা নদী থেকে মাত্র ৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এই ২২ কিলোমিটার দীর্ঘ করিডর ভারতের মূল ভূখণ্ডকে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্যের সাথে সংযুক্ত করে। তিস্তা প্রকল্পে চীনের সরাসরি উপস্থিতি মানেই এই অঞ্চলে চীনা প্রকৌশলী, শ্রমিক এবং গোয়েন্দাদের পদচারণা—যা ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য সরাসরি হুমকি।
টাইমস অব ইন্ডিয়া এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, তিস্তা প্রকল্পে চীনের উপস্থিতি ভারতের শিলিগুড়ি করিডরের স্থিতিশীলতাকে বিপন্ন করতে পারে। ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা দাবি করেছে, চীনের গোয়েন্দা সংস্থা বিশ্বের সবচেয়ে কার্যকর, কিন্তু সবচেয়ে কম আলোচিত সংগঠনগুলোর একটি।
ইন্ডিয়া টুডে রিপোর্টে বলা হয়, তিস্তায় যদি চীনা গোয়েন্দারা অবস্থান নেয়, তবে শিলিগুড়ি অঞ্চলের সেনা চলাচল এবং রাডার সিস্টেম সংক্রান্ত তথ্য চীনের হাতে চলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
২০২৩ সালে নেপালে চীনা প্রকল্পে গোয়েন্দাদের উপস্থিতির ঘটনা সামনে আসে। ভারতের ২০২৪ সালের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের রিপোর্টে বলা হয়েছে, যদি শিলিগুড়ি করিডরে কোনরকম বিঘ্ন ঘটে, তাহলে উত্তর-পূর্ব ভারতের সাথে মূল ভূখণ্ডের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে।
এছাড়াও অর্থনৈতিক দিক থেকেও ভারতের জন্য এটি চ্যালেঞ্জ। তিস্তায় চীনের প্রকল্প ভারতের উত্তরাঞ্চলের জলবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলোকে প্রভাবিত করতে পারে।
মারিয়া