
ড. মুহাম্মদ ইউনূস
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেওয়ার আট মাসের মাথায় দুটি দেশ সফর করেছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সফর দুটিকে দেশের কূটনীতিতে শতভাগ সফল বলে মনে করছেন সাবেক রাষ্ট্রদূত, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক এমনকি রাজনীতিবিদরাও।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের মতে, কূটনৈতিক সফলতা যে কোনো দেশের জন্যই সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তবে গণতান্ত্রিক সরকার না হয়েও স্বল্প সময়ে অন্তর্বর্তী সরকার দেশের জন্য যতটুকু সফলতা নিয়ে এসেছে, তা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার।
কূটনৈতিক সূত্রে জানা যায়, প্রধান উপদেষ্টার চীন সফরে একটি চুক্তিসহ ১৫টি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। তাছাড়া ২.১ বিলিয়ন ডলার সহায়তার আশ্বাস বাংলাদেশের জন্য কূটনৈতিক সফলতারও ইঙ্গিত বহন করে।
কূটনৈতিক সূত্রে জানা যায়, চীন সফর শেষে গত মাসে বিমসটেক সম্মেলনে অংশ নেয় বাংলাদেশ। সেখানে বাংলাদেশ সরকার ছয়টি দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে সাইডলাইনে বৈঠকে মিলিত হয়। বৈঠকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকটি হয় প্রতিবেশী দেশ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে। যে বৈঠকটির জন্য বাংলাদেশ সরকার ভারতকে চিঠি দেয়।
জবাবে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর সেখানকার গণমাধ্যমে সরাসরি বৈঠকের ব্যাপারে অসম্মতি জানায়। সম্মেলন শুরুর কয়েক ঘণ্টা আগে ভারত সরকার বৈঠকটির বিষয়ে নিশ্চিত করে। সেখানে প্রায় ৫০ মিনিট বৈঠক হয়। বৈঠকে বাংলাদেশের ইচ্ছাগুলো ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কাছে উপস্থাপন করা হয়। যদিও নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশের প্রত্যাশাগুলোর ব্যাপারে কোনো সদুত্তর দেয়নি বা দিতে পারেনি।
দুই দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের এ বৈঠকের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের (আইআর) অধ্যাপক ড. মাইনুল আহসান জনকণ্ঠকে বলেন, প্রধান উপদেষ্টার বৈঠকটি বাংলাদেশের জন্য নিঃসন্দেহে বড় অর্জন। ভারত যেখানে বৈঠক করতে রাজি না, সেখানে নরেন্দ্র মোদি ২৭ মিনিট অপেক্ষা করে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকটি করেছেন। সে বৈঠকটি ৫০ মিনিটেরও বেশি সময় স্থায়ী ছিল, যেটাকে কূটনৈতিক সফলতা বলা যেতে পারে।
তিনি বলেন, ড. ইউনূস অন্য প্রোগ্রামে ব্যস্ত থাকায় নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে নির্ধারিত বৈঠকে হাজির হতে বিলম্ব হয়। সকল অতিথি সেখানে অপেক্ষায় থাকেন। ড. ইউনূস বৈঠকে হাজির হলে দাঁড়িয়ে তাকে সম্মান করাটা বাংলাদেশের ইতিহাসে বিরল।
এই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক বলেন, ছাত্র-জনতার বিপ্লবের পর প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কে ভাটা পড়েছে। বৈঠকের মাধ্যমে কূটনৈতিক, বাণিজ্যিকসহ দু’ দেশের সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার দুয়ার উন্মুক্ত হলো।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চীনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ উল্লাহ জনকণ্ঠকে বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার হিসেবে বর্তমান সরকারের সফর কূটনৈতিকভাবে কিছুটা হলেও দেশের জন্য সফলতা বহন করে। বিশেষ করে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকটি নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জন্য কূটনৈতিক সফলতা তা অস্বীকার করার উপায় নেই।
নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠকের বিষয়ে সাবেক এ রাষ্ট্রদূত বলেন, ভারত প্রতিবেশী দেশ। ভারতকে উপেক্ষা করে কিছু আশা করা বোকামি ছাড়া কিছুই নয়। প্রতিবেশী দেশ হিসেবে দু’দেশের ছাড় দেওয়ার মনমানসিকতা থাকা খুবই প্রয়োজন। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে নরেন্দ্র মোদির বৈঠক ভবিষ্যৎ সম্পর্কের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
বৈঠকটির মাধ্যমে উভয় দেশের সম্পর্ককে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা প্রয়োজন। বিশেষ করে ভারতের তাদের মনোভাব পরিবর্তন করার প্রয়োজন। তবে বাংলাদেশকেও কীভাবে তাদের সঙ্গে সকল ধরনের সম্পর্ক বজায় রাখা যায় সে পরিবেশ তৈরিতে অগ্রগামী হতে হবে।
তিনি বলেন, একটি দেশের কূটনীতিতে অন্যদেশের সঙ্গে সফর স্বাভাবিক ব্যাপার। এটা হতেই পারে। স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনা হবে এটাও স্বাভাবিক। তবে যে কোনো দেশই নির্বাচিত সরকারের সঙ্গে তাদের পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো প্রত্যাশা করে থাকে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সেটা আলাদা। নির্বাচিত সরকার না হয়েও আন্তর্জাতিকভাবে আগানো অনেক কঠিন কাজ।
বিমসটেক সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিমসটেক বাংলাদেশেরই অর্জন। সেখানে বাংলাদেশ তাদের মতামত প্রকাশ করার সুযোগ পায়নি, যা দেশের জন্য কষ্টের ছিল। তবে এবার বাংলাদেশ চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পাওয়ায় সে কষ্টকে কাজের মাধ্যমে বুঝিয়ে দিতে পারলে অতীতের মনোভাব পোষণ করতে পারবে না। সেটা শুধু ভারত নয়, কোনো দেশই পারবে না। সভাপতির দায়িত্ব পাওয়া মানে দায়িত্ব বেড়ে যাওয়া। সেখানে বর্তমান সরকার তাদের যোগ্যতার যথার্থ স্বাক্ষর রাখতে পারলে সেটা হবে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অর্জন।
উল্লেখ্য, বিমসটেক মহাসচিব ইন্দ্রমনি পান্ডে প্রধান উপদেষ্টার ‘ইয়ুথ ফেস্টিভ্যাল’ আইডিয়াটি গ্রহণ করেছেন এবং তিনি এগুলো চমৎকার আইডিয়া হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি প্রধান উপদেষ্টার দেখানো আইডিয়া অনুসারে ভারত কাজ করবে বলেও কথা দেন।
বিমসটেক মহাসচিব বলেন, আমরা আমাদের পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে এসব আইডিয়া নিয়ে কাজ করব।
প্রধান উপদেষ্টা বিমসটেক মহাসচিবকে আরও ভালো ফলাফলের জন্য পরিকল্পিত সভার বার্ষিক ক্যালেন্ডার প্রস্তুত করারও নির্দেশ দেন।
গত শুক্রবার ব্যাঙ্ককে ষষ্ঠ বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে সাতটি সদস্য দেশের নেতারা অংশ নেন। থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী পেতাংতার্ন সিনাওয়াত্রা সম্মেলন শেষে ড. ইউনূসের কাছে বিমসটেকের সভাপতিত্ব হস্তান্তর করেন।
প্রধান উপদেষ্টার কাছে সফরের সফলতা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেন, বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেওয়ার আট মাসের মধ্যে দুটি দেশ সফর করেছেন। দুটি সফরই বাংলাদেশের জন্য সফলতা নিয়ে এসেছে বলে আমরা বিশ্বাস করি।
প্রধান উপদেষ্টার দুটি দেশ সফরের কূটনৈতিক সফলতা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার জনকণ্ঠকে বলেন, অল্প সময়ের মধ্যে দুটি দেশের সফরই অন্তর্বর্তী সরকারের কূটনৈতিক সফলতার ইঙ্গিত বহন করে। বিশেষ করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠকটি প্রশংসার দাবিদার। আমরা এটিকে সফলতার প্রাথমিক ধাপ হিসেবেই দেখছি।
তিনি বলেন, প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারত আমাদের সহযোগিতা করবে, আমরা ভারতকে সহযোগিতা করব, সেটাই হবার কথা। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য যে, প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না।
প্রধান উপদেষ্টার সফর নিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, বিমসটেক সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির যে বৈঠক হয়েছে, তা দুই দেশের সম্পর্কে আশার আলো তৈরি করেছে। এর মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যকার যে তিক্ততা, তা কমে আসবে।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে মির্জা ফখরুল বলেন, বিমসটেকে দুই দেশের প্রধানদের বৈঠক আনন্দের। আমরা মনে করি ভূরাজনীতি ও বিশ্ব রাজনীতির বর্তমান প্রেক্ষাপট এবং বাংলাদেশ ও ভারতের এ অঞ্চলের যে প্রেক্ষাপট, সেই প্রেক্ষাপটে আমাদের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বৈঠক আমাদের সামনে একটা আশার আলো তৈরি করেছে। বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কের মধ্যে যে বিটারনেস (তিক্ততা) তৈরি হয়েছিল, সেটা যেন আর সামনে না যায় অথবা এটা যেন কমে আসে এ বৈঠকের মাধ্যমে তার একটি সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
তিনি বলেন, আমি যতটুকু দেখেছি এ বিষয়ে দুজনেই আন্তরিক ছিলেন। যা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের মানুষকে এবং ভারতের মানুষদের উপকার করবে।
এদিকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. ইউনূসের বৈঠককে বিএনপি ইতিবাচক হিসেবে দেখছে।
মির্জা আব্বাস বলেন, বৈঠকে যদি দেশের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট আলোচনা হয়, তবে সেটা ভালো। সামনে ড. ইউনূস আরও ভালো কিছু বয়ে আনবেন বলে প্রত্যাশা করি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ভারতে থেকে শুধু শেখ হাসিনাকে ফেরত পাঠালেই হবে না। তার সঙ্গে তার সহযোগীদেরও পাঠাতে হবে। শেখ হাসিনার ফেরতের পর তার বিচার হতে হবে।