
ছবি: সংগৃহীত।
সীমান্ত দিয়ে দেশে অবৈধ বিদেশিদের অনুপ্রবেশ বন্ধ হয়নি। অবৈধ বিদেশিদের অবস্থান নিয়ে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিলেও ঠেকানো যাচ্ছে না অনুপ্রবেশ। আর এসব অনুপ্রবেশের রুট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে ফেনীর পরশুরাম-বিলোনিয়া সীমান্ত।
গত ৫ মাসে এই সীমান্তে আটক হয়েছেন ৬ জন বিদেশি নাগরিক। যাদের সকলেই আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে আসা। তারা বাংলাদেশ ও ভারতের মানব পাচারচক্রের যোগসাজশে সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে প্রবেশ করেছেন। কি কারণে, কেন-ই-বা তারা অবৈধভাবে প্রবেশ করছেন—তার সঠিক তথ্য জানে না পুলিশ প্রশাসন।
গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, এখন পর্যন্ত বিজিবির হাতে আটককৃত কারো কাছে বৈধ কোনো কাগজপত্র পায়নি প্রশাসন। আটক বিদেশি নাগরিকদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন এমন একজন পুলিশ কর্মকর্তা (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) জানান, তাদের যখন আটক করা হয়, তখন পাসপোর্ট ও কাগজপত্র হারিয়ে যায়, মোবাইলফোন নষ্ট থাকে। জিজ্ঞাসাবাদে তারা এমন সব কথা বলে থাকেন। আদালতে মানবপাচারকারী ও আইনজীবীদের শিখিয়ে দেওয়া এসব কথাই তারা বলেন। মূলত এমন সব তথ্য আদালতে উপস্থাপন করা হলে তারা সহজে মুক্তি পেয়ে যান। যোগাযোগের জন্য তারা বিভিন্ন দেশের নম্বরের হোয়াটসআপ ব্যবহার করে থাকেন।
ফেনী ব্যাটালিয়নের (৪ বিজিবি) সূত্রে জানা যায়, ফেনীর পরশুরাম সীমান্তে গত বছরের ১ নভেম্বর থেকে চলতি বছরের ৭ এপ্রিল পর্যন্ত ৬ জন বিদেশি নাগরিককে অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রমের সময় আটক করা হয়েছে।
রবিবার (৬ এপ্রিল) রাত সাড়ে ৮টার দিকে অবৈধভাবে ভারতে অনুপ্রবেশের সময় তানজানিয়ার নাগরিক আমিনা শাহবানী (৩৩) নামে এক নারীকে আটক করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)।
পাসপোর্ট ও ভিসা ব্যতীত অবৈধভাবে অনুপ্রবেশের দায়ে উপজেলার মির্জানগর ইউনিয়নের নিজ কালিকাপুর সীমান্ত থেকে তাকে আটক করা হয়। তিনি তানজানিয়ার নায়মাঙ্গানা প্রদেশের বাসিন্দা। নিজকালিকাপুর গ্রামের আবদুল মোতালেব ও সুমন ভারতে পাচারের উদ্দেশে ফেনীর মহিপাল থেকে সিএনজিতে করে নিজকালিকাপুর নিয়ে যান। এ ঘটনায় ৭ জনকে আসামি করে পরশুরাম মডেল থানায় মামলা করা হয়েছে ।
গত বছরের ৭ নভেম্বর পরশুরাম সীমান্তের নিজকালিকাপুর বিওপি এলাকা দিয়ে অবৈধভাবে বাংলাদেশ থেকে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে যাওয়ার সময় ইথিওপিয়ান নাগরিক ইসরাত উমর হাজিকে (৬৭) আটক করা হয়। গত ২৯ ডিসেম্বর অবৈধভাবে ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশকালে নাইজেরীয় নাগরিক এমিকা গিলবার্ট আপিহকে (৪৫) আটক করে নিজকালিকাপুর বিওপি।
এছাড়া চলতি বছরের ২০ জানুয়ারি সুদানি নাগরিক ইসলামকে (২৬) অবৈধভাবে ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশকালে আটক করা হয়। নাইজেরীয় নাগরিক- নওসু ইজুচুকউ ক্যালিস্টাসকে (২৭) গত ১৯ মার্চ অবৈধভাবে বাংলাদেশ থেকে ভারতে প্রবেশকালে আটক করা হয়।
গত ২২ মার্চ আবদিওয়ালি মোহাম্মদ আলী (২৪) নামে এক সোমালীয় নাগরিককে মির্জানগর ইউনিয়নের সীমান্ত পিলারের কাছ থেকে ১৫০ গজ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশের সময় আটক করা হয়। আটক ব্যক্তিদের পরশুরাম মডেল থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে বলে জানা যায়।
গণমাধ্যমের অনুসন্ধানে জানা গেছে, পরশুরামের মির্জানগর ইউনিয়নের ভারত সীমান্তবর্তী গ্রাম নিজকালিকাপুর ও পৌর এলাকার বাউরপাথর গ্রামের মীরপাড়া ও বিলোনিয়া সীমান্ত মানবপাচার ও চোরাচালানির নিরাপদ রুট মনে করে মানবপাচারকারীরা।
অভিযোগ রয়েছে, এই চক্রে স্থানীয় লোকজন জড়িত রয়েছেন। মানবপাচারের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ২০২৪ সালের ২৫ নভেম্বর মির্জানগর ইউনিয়নের উত্তর কাউতলির রাজু (৩৫) ও নিজ কালিকাপুর গ্রামের মোহাম্মদ ইব্রাহিম (৫০) নামে দুই ব্যক্তিকে আটক করে ভারতের বিলোনিয়া পুলিশ।
এ বছর ২১ জানুয়ারি সুদানের একজন নাগরিককে পাচারের সঙ্গে জড়িতের অভিযোগে নিজ কালিকাপুর গ্রামের মো. এমরান (৫০) নামে এক ব্যক্তিকে আটক করে পরশুরাম মডেল থানা পুলিশ। অবৈধভাবে বাংলাদেশ ও ভারতের একটি চক্রের যোগসাজশের মাধ্যমে দেশের একই সীমান্ত দিয়ে মানবপাচার হচ্ছে।
পরশুরাম মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ নুরুল হাকিম বলেন, সিন্ডিকেটের মাধ্যমে একটি চক্র বিদেশিদের পারাপার করে থাকে। মানবপাচারের সাথে কারা জড়িত পুলিশ তদন্ত করছে।
পুলিশ ও স্থানীয়দের ধারণা, এসব বিদেশি নাগরিক ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় পেতে চেষ্টা করে। অনেকে দালালের মাধ্যমে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার কার্ড তৈরি করে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করেন। সোমালিয়ান নাগরিক আবদেয়ালি মোহাম্মদ আলীর কাছে জাতিসংঘের একটি রিফিউজি কার্ড পাওয়া যায়। যেটি তিনি ভারতে জাতিসংঘের (ইউএনএইচসিআর) রিফিউজি এজেন্সি থেকে সংগ্রহ করেছেন।
এ প্রসঙ্গে বিজিবি ফেনী ব্যাটালিন (৪ বিজিবি) অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মোশারফ হোসেন বলেন, অবৈধ অনুপ্রেবেশকারীরা আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের নাগরিক। গত ৫ মাসে অবৈধ অনুপ্রবেশ করায় চলতি বছর ৬ আফ্রিকান নাগরিককে আটক করে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। তবে অনুপ্রবেশের জন্য কেন ফেনী সীমান্তকে বেছে নিয়েছেন তারা—তা অজানা। যদিও তাদের আটকের পর পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। পুলিশ তদন্ত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়।
ফেনীর পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমান বলেন, বিদেশি নাগরিকদের দেশে অবৈধ অনুপ্রবেশের সুষ্পষ্ট কারণ এখনো নিশ্চিত নয়। জিজ্ঞাসাবাদে তারা পরশুরাম সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশের কারণ সম্পর্কে বিভিন্ন জন বিভিন্ন রকম তথ্য দিয়ে থাকেন। অবৈধভাবে বিদেশিদের প্রবেশের সঙ্গে একটি চক্র জড়িত রয়েছে। এ চক্রের দুই সদস্যের নাম পেয়েছি। তাদের আটকের মাধ্যমে জ্ঞিাসাবাদে বিস্তারিত জানা যাবে।
তিনি বলেন, অনুপ্রবেশকারীদের রিমান্ডে নিলেও তারা এ ব্যাপারে কোনো তথ্য দেয় না। পরে আদালতের মাধ্যমে জামিনে মুক্ত হয়ে তারা বাংলাদেশের ভিসা পায় বলে জানান পুলিশ সুপার।
সূত্র: ইউএনবি
সায়মা ইসলাম