
ছবি: সংগৃহীত
গাজা ইস্যুতে ফুঁসে উঠেছে বিশ্ববিবেক। বিক্ষুব্ধ পৃথিবীর মানুষ। পৃথিবীজুড়ে চলছে প্রতিবাদপ্রতিরোধের ডাক এসেছে মানবিক বিশ্বের নানা দেশ থেকে। আমাদের দেশেও এর ব্যাত্যয় ঘটেনি। প্রতিবাদী জনতার ঢল নেমেছে রাজপথে।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি ও তার অঙ্গসংগঠনগুলো পূর্বনির্ধারিত সমস্ত কর্মসূচি স্থগিত করেছে। ছাত্রদল, যুবদলসহ অন্যান্য অঙ্গসংগঠনও প্রতিবাদে মুখর। ইসলামের প্রথম ক্বিবলাহ, রাসুলের (সা.) মিরাজের স্থান এই ফিলিস্তিনের পবিত্র ভূমি এবং এর অধিবাসী নির্যাতিত মুসলিমদের প্রতি আমাদের অপরিসীম ভালোবাসা।
অতীত ইতিহাসের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় বাংলাদেশের সাবেক শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান অসীম ভালোবাসায় ফিলিস্তিনের প্রতি দৃঢ অবস্থান নিয়েছেন। বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা এই রাষ্ট্রনায়ক মুসলিম বিশ্বেও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন তাঁর ঈমানী চেতনা ও অপরাপর মুসলিম রাষ্ট্রের প্রতি সহানুভূতির কারণে। মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধকে তিনি দেশ থেকে দেশে ছড়িয়ে দিয়েছেন। বিশেষত বিপণ্ন ফিলিস্তিনের প্রতি তাঁর হৃদয়ে ছিল অন্তহীন ভালোবাসা। বাংলার রাখালরাজা তাই মুসলিমবিশ্বের সাথে স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে দ্বিপাক্ষিক আলাপকালে কেবল নিজদেশের জন্য নয়,অপরাপর মুসলিম রাষ্ট্রের কল্যাণের কথাও ভুলে যেতেন না।
১৯৮০ সালের ২১শে আগস্ট শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের অনুমোদনে মসজিদুল আল-আকসা ও একজন স্বাধীনতাকামী যোদ্ধার ছবি সংবলিত একটি ইংরেজি ও আরবি স্মারক ডাকটিকেট প্রকাশিত হয়েছিল।
Mr. Ahmed F. Karim এর ডিজাইনে তৈরি এই ডাকটিকিটের মুল থিম ছিলো -“T0 THE WELFARE OF THE FAMILIES OF MARTYRS AND COMBATANTS OF PALESTINE”
মুসিলম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের মানুষের সবসময়ই সহানুভূতি-ভালবাসা ছিল ফিলিস্তিন এবং তার জনগণের জন্য। এ সম্পর্কের আরেক মাইলফলক উম্মোচিত হয় ১৯৮০ সালে জিয়াউর রহমানের আমলে। এসময় ফিলিস্তিনীদের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থন জানিয়ে তা স্মরণীয় করে রাখতে সরকার প্রকাশ করে একটি স্মারক ডাকটিকেট যেখানে একজন ফিলিস্তিনী যোদ্ধাকে দেখা যায় অস্ত্র হাতে এবং তার পেছনে কাঁটাতারে ঘেরা মসজিদুল আকসার ডোম অব রক বা কুব্বাত আসসাখরা অংশ। এই ডাকটিকেটে ইংরেজিতে লেখা হয়, 'আমরা বীর ফিলিস্তিনী স্বাধীনতাকামী যোদ্ধাদের স্যালুট/সালাম জানাই'।
১৯৮১ সালে রাষ্ট্রীয় আমন্ত্রণে বাংলাদেশে প্রথমবারের মত সফরে আসেন পিএলও প্রধান ইয়াসির আরাফাত। মুসলিম বিশ্বে খুব কম সময়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পাওয়া বাংলাদেশী প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান নিজে উপস্থিত থেকে লাল গালিচা সংবর্ধনা জানান ফিলিস্তিনী এই নেতাকে। বাংলাদেশের মানুষের আবেগ-ভালবাসা এবং ফিলিস্তিন নিয়ে উৎকণ্ঠা দেখে অভিভূত হোন ইয়াসির আরাফাত। রাজনৈতিক নেতা এবং রাষ্ট্রীয় বড়-বড় পদের কর্মকর্তারা তাকে যথেষ্ট সম্মান এবং সমাদর করেন।
ফিলিস্তিনের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয় শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সময়। এ সময় ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা সংগ্রামের সমর্থনে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশ সোচ্চার ভূমিকা পালন করে। ঢাকার ফিলিস্তিনি দূতাবাসের তথ্য অনুযায়ী ফিলিস্তিনের অবিসংবাদিত নেতা ইয়াসির আরাফাত ১৩ বার রাষ্ট্রীয় সফরে বাংলাদেশে আসেন। এর মধ্যে ৯ বার এসেছিলেন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শাসনামলে। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শাহাদতের পর তিনি গভীর হতাশা ও দুঃখ প্রকাশ করেন। দুই নেতা বহু আন্তর্জাতিক ফোরামে একসাথে কাজ করেছেন। জিয়াউর রহমান ছিলেন আলকুদস কমিটির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। এই কমিটির অন্য সদস্যদের মধ্যে ছিলেন মরক্কোর বাদশাহ দ্বিতীয় আল হাসান এবং সৌদি আরবের বাদশাহ ফয়সাল। ফিলিস্তিন সমস্যা সমাধানে আল কুদস কমিটির নেতৃত্বে জিয়াউর রহমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এ ছাড়া জিয়াউর রহমান ইসলামি উন্নয়ন ব্যাংকের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। ইসলামি উন্নয়ন ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আহমেদ মোহাম্মদ আলী ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় আমাকে জানিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের পরামর্শে ইসলামিক উন্নয়ন ব্যাংক ফিলিস্তিনের জনগণের আর্থসামাজিক উন্নয়নে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে।
জিয়াউর রহমান বরাবরই ফিলিস্তিনি জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের পক্ষে ছিলেন। ১৯৭৮ সালে ইসলামিক সম্মেলন সংস্থা (ওআইসি)-এর অধিবেশনে তিনি ফিলিস্তিন ইস্যুকে গুরুত্বের সঙ্গে উপস্থাপন করেন এবং ফিলিস্তিন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও)-কে স্বীকৃতি দিয়ে তাদের প্রতিনিধিদের বাংলাদেশে স্বাগত জানান। তাঁর আমলেই বাংলাদেশে পিএলও-র পূর্ণাঙ্গ কূটনৈতিক মিশন প্রতিষ্ঠিত হয়। ফিলিস্তিনি নেতা ইয়াসির আরাফাতের সঙ্গে শহীদ জিয়ার সুসম্পর্ক, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ এবং রাজনৈতিক সমর্থন ছিল অত্যন্ত দৃঢ়।
জিয়াউর রহমান মুসলিম উম্মাহ-র সংহতির একজন প্রবল সমর্থক ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, মুসলিম বিশ্বে ঐক্য ও সংহতি ছাড়া কোনো রাষ্ট্র এককভাবে টিকে থাকতে পারবে না। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই তিনি ফিলিস্তিনসহ মুসলিম বিশ্বের নিপীড়িত জাতিগুলোর প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করতেন এবং আন্তর্জাতিক পরিসরে তাঁদের ন্যায্য অধিকারের পক্ষে অবস্থান নিতেন।
শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ফিলিস্তিনের সঙ্গে সুসম্পর্ক কেবল কূটনৈতিক ছিল না, ছিল আদর্শিক ও নৈতিক সমর্থনের বহিঃপ্রকাশ। একদিকে তিনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের মর্যাদা বৃদ্ধি করেছেন, অন্যদিকে মুসলিম বিশ্বের নিপীড়িত জাতির পাশে দাঁড়িয়ে একজন দূরদর্শী ও মানবিক রাষ্ট্রনায়কের পরিচয় দিয়েছেন। ফিলিস্তিনের সংগ্রামকে বাংলাদেশের জনসাধারণের হৃদয়ের কাছে পৌঁছে দেওয়ার কৃতিত্বের বড় একটি অংশ তাঁর কৌশলী ও সাহসী নেতৃত্বের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়।
মেহেদী হাসান