
ছবি: সংগৃহীত
আওয়ামী লীগের পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের শিকার বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ও সাবেক সংসদ সদস্য আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর রায়ের পর ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ৬ মার্চ টানা সাত দিন যৌথবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে দেশব্যাপী গণহত্যা চালায় আওয়ামী লীগ। সে সময় শিশু ও সাধারণ নারী পুরুষসহ কমপক্ষে ১৬০ জন গুলিতে নিহত হন।
এই গণহত্যার একযুগ পার হলেও এখন পর্যন্ত কোনো বিচার কাজ শুরু হয়নি। সে সময় মৃত্যুর ঘটনা আড়াল করতে ‘সাঈদীকে চাঁদে দেখা গেছে’ গুজব ছড়ায় আওয়ামী লীগ। স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতনের পর এখন পর্যন্ত আর্ন্তজাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে একটি অভিযোগ পড়েছে। নিহত পরিবারের পক্ষ থেকে কিছু কিছু জেলায় মামলা হলেও সে মামলার কোনো অগ্রগতি হয়নি। কিছু মামলার অগ্রগতি হলেও তদন্তে উলটো প্রতিবেদন দেওয়া হয় নিহতের পরিবারের বিরুদ্ধে। শেখ হাসিনার পতনের পর নিহত পরিবারের সদস্যদের যোগাযোগ রাখছেন আল্লামা সাঈদীর পরিবারের সদস্যরা।
চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতন হলেও এই ঘটনা কোনো আলোচনা নেই জামায়াতের মাঝেও।
জামায়াতের আইনজীবীরা বলছেন, সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সাংগঠনিকভাবে কোনো মামলা করবে না জামায়াত তবে নিহতের পরিবারের সদস্যরা মামলা করতে চাইলে তারা সহযোগিতা করা হবে।
কোনো প্রকার প্রটোকল না মেনে ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি গণ-জাগরণমঞ্চের পরিকল্পিত চাপে আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায় দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। সে সময় রায়ের প্রতিবাদে অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠে সারাদেশ। রায় ঘোষণার পর থেকেই সারাদেশে নিরস্ত্র নিরীহ বিক্ষুব্ধ আল্লামা সাঈদী ভক্তদের ওপর ইতিহাসের বর্বর নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালায় পুলিশ ও সরকারের পেটোয়া বাহিনী। ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ৬ মার্চ সারা দেশে চালানো হয় গণহত্যা। প্রথম দিনেই পুলিশের গুলিতে নিহত হয় ৭০ জনের অধিক।
সে সময় পরিকল্পিতভাবে আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে দেওয়া ফাঁসির আদেশের বিরুদ্ধে সমালোচনা তৈরি হয় বিশ্বব্যাপি। বিশেষ করে রায় পরবর্তী চালানো সরকারি বাহিনীর নৃশংস হত্যাকাণ্ড নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে জাতিসংঘ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থা।
গত ২ মার্চ রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী গুয়েন লুইস ও বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী কার্যালয়ের সিনিয়র মানবাধিকার উপদেষ্টা হুমা খান সাক্ষাৎ করতে আসেন প্রধান উপদেষ্টা উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে যেখানে উঠে আসে মাওলানা সাঈদীর রায় পরবর্তী সময়ের হত্যাকাণ্ডের ইস্যুটি।
যেখানে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর রায়কে ঘিরে দেশে যে হত্যাকাণ্ড ঘটেছে সেটিকে নথিভুক্ত করতে জাতিসংঘকে অনুরোধ করেন প্রধান উপদেষ্টা।
সম্প্রিত একটি অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, ২০১৩ সাল ছিল আওয়ামী লীগের গুম ও খুনের এক মহোৎসব। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ১৬০ জনকে হত্যা করা হয়েছিল। তা ঢাকতে ‘সাঈদীকে চাঁদে দেখা গেছে’ সামনে এনে নজর ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
তৎকালীন গণমাধ্যমের সংবাদে প্রথম দিনে নিহত ৫৯ জনের নামসহ প্রকাশ করা হয়। প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর অনুযায়ী দেখা যায় ২০১৩ সালের ২৮ ফ্রেবুয়ারি পুলিশের গুলিতে ঢাকায় ৩, সাতক্ষীরায় ১৪, ঠাকুরগাঁওয়ে ৭, রংপুরে ৭, গাইবান্ধায় ৩ পুলিশ ও ৩ জামায়াত কর্মী, নোয়াখালীতে ৪, চাঁপাইনবাবগঞ্জে ২, কক্সবাজারে ২, দিনাজপুরে ২, চট্টগ্রামের লোহাগাড়ায় ১ কনস্টেবলসহ ৩, বাঁশখালীতে ১, নাটোরে ১. সিরাজগঞ্জে ২, মৌলভীবাজারে ২, রাজশাহীতে ১ ও বগুড়ায় ১ জন, রাজশাহীর চারঘাটে ১ জন নিহত হয়। পরবর্তী সাত দিনে (১- ৭ মার্চ পর্যন্ত) নিহত হন আরও ১০০ জনেরও অধিক সাঈদী বক্ত।
আল্লামা সাঈদীর রায়ের পর সিরাজগঞ্জে নৃশংস হত্যাযজ্ঞের শিকার হন ৪ জন। সে ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করেন নিহতের পরিবার ও স্থানীয় জামায়াতের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। সে সময় স্থানীয়রা থানায় মামলার আবেদন করলে মামলা নিতে নিষেধ করেন তৎকালীন সিরাজগঞ্জ পলিশ সুপার ইমরান হোসেন। থানায় মামলা না নেওয়ায় নিহতের পরিবারের সদস্যরা তখন আদালতে দুটি মামলা করেন। আদালত মামলা নিলেও সেই মামলার প্রতিবেদনে উল্টো নিহতদের পরিবারকেই চাপে রাখা হয়। একটা সময় থেমে যায় তদন্ত।
মামলার অগ্রগতি বিষয়ে জানতে চাইলে সিরাজগঞ্জ জেলার বর্তমান জেলা সেক্রেটারি জাহিদুল ইসলাম জণকণ্ঠকে বলেন, শেখ হাসিনার পতনের পর থেকেই আমরা চেষ্টা করছি মামলাগুলোর অগ্রগতির বিষয়ে জানার। আশা করছি দ্রুতই মামলার কার্যক্রম নতুনভাবে শুরু হবে। আমরা সঠিক বিচার পাব।
সাঈদীর রায়ের পর আওয়ামী প্রশাসন এবং দলীয় নেতাকর্মীরা সবচেয়ে বেশি ধ্বংসযজ্ঞ চালায় সাতক্ষীরায়। রায়ের পর জেলাতে অনেকেই প্রাণ হারান। শুধু গুলি করে মানুষ হত্যা নয় সে সময় পুরো সাতক্ষীরায় বুলডোজার চালায় আওয়ামী লীগ ও প্রশাসন। পরবর্তীতে মামলা করতে গেলে পালটা মামলা দেওয়া হয় ক্ষতিগ্রস্তদের বিরুদ্ধে। গত একযুগে বিচার না পালেও ভুক্তভোগীদের আশা তারা এই ঘটনায় ক্ষতিপূরণসহ ন্যায় বিচার পাবেন।
সাতক্ষীরার জেলার বর্তমান জেলা সেক্রেটারি আজিজুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, আল্লামা সাঈদীর রায়ের দিন থেকে পরবর্তী ৭দিন টানা ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয় সাতক্ষীরাতে। নির্বিচারে গুলি চালিয়ে শুধু মানুষ হত্যা নয় ঘুরিয়ে দেওয়া হয় অনেকের বসতবাড়ি। আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হয় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। লুটপাট চালানো হয় মাছের ঘেরসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে।
তিনি বলেন, স্বৈরাচার হাসিনার পতনের পর আমরা চেষ্টা করেছি নিহত পরিবারের সদস্যদের নিয়ে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এই ঘটনায় একটি মামলা আমরা করেছি। আরো কিছু মামলার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। আমরা ন্যায় বিচার চাই। যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তারা ক্ষতিপূরণ পাবে এই আশা করছি।
সার্বিক বিষয় নিয়ে আল্লামা সাইদীর পুত্র শামীম সাঈদী জণকণ্ঠকে বলেন, শহিদ আল্লামা দেলোয়ার হোসাইন সাঈদী তার জীবনে সব সময় মানুষের পাশে থেকেছেন। মানবতার পাশে থেকেছেন। মানবতাবিরোধী বলে তাকে কলঙ্কিত করার চেষ্টা করা হয়েছিল। যা সাধারণ মানুষ মেনে নেয়নি। এই ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে সারাদেশ এবং বিদেশে লাখো মানুষ রাস্তায় নেমে আন্দোলন করেছে। যা মানতে পারেনি ফ্যাসিস্ট সরকার। মানুষকে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করেছিল তারা। তাতেও যখন কাজ হয়নি তখন রায় পরিবর্তন করতে বাধ্য হন ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকার। ফাঁসির রায় পরিবর্তন করে আল্লামা সাঈদীকে তখন আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া হয়। শেষ পর্যন্ত স্বৈরাচার সরকার যখন বুঝতে পেড়েছে তারা ক্ষমতায় থাকতে পারবে না তখন মাওলানা সাঈদীকে চিকিৎসার নাম করে হাসপাতালে এনে ২০২৩ সালের ১৪ আগস্ট তাকে হত্যা করা হয়েছে। শুধু আমার বাবার হত্যাকাণ্ড নয়, রায়কে কেন্দ্র করে যারা প্রাণ হারিয়েছেন সকল হত্যাকাণ্ডের দায়ভার শেখ হাসিনাকে নিতে হবে। আমি শেখ হাসিনার সেই মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সুষ্ঠু বিচার দাবি করছি।
শামীম সাঈদী বলেন, যারা শহিদ এবং আহত হয়েছিলেন আমি তাদের তথ্য সংগ্রহ করছি। অনেক পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি। তাদের খোঁজ খবর নিয়েছি। সাঈদী পরিবারের দরজা সব সময় শহিদ-আহত পরিবারের সদস্যদের জন্য খোলা আছে যে কেউ চাইলে আমাদের সঙ্গে স্বাক্ষাৎ করতে পারবে।
প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসকে ধন্যবাদ জানিয়ে শামীম সাঈদী বলেন, জাতিসংঘ প্রতিনিধিকে প্রধান উপদেষ্টা যে নির্দেশনা দিয়েছেন তাতে করে আশা করছি আমরা সঠিক বিচার পাব। শুধু মাওলানা সাঈদীর রায়কে ঘিরে নয় এ পর্যন্ত যত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে সব হত্যাকাণ্ডের বিচার চেয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা।
মাওলানা সাঈদীর রায়ের দিন ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ৪ মার্চ পর্যন্ত শুধু ছাত্রশিবিরের ১৮ জন নেতাকর্মী মারা যান। এ হত্যাকাণ্ডের বিচার পেতে ছাত্রশিবির সাংগঠনিকভাবে মামলা করবে কিনা জানতে চাইলে সংগঠনের বর্তমান সভাপতি জাহিদুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, শুধু ১৮ জনই নায় ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর থেকে শুরু করে জুলাই গণঅভ্যুত্থান পর্যন্ত সকল হত্যা ও গুমের বিচার আমরা চাই৷ সংগঠনের জায়গা থেকে প্রতিটি ভিকটিম পরিবারকে মামলা ও যাবতীয় আইনি সহায়তার মাধ্যমে ন্যায়বিচার প্রাপ্তিতে সহায়তা করা হবে।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি আইনজীবী মুয়াজ্জেম হোসেন হেলাল জনকণ্ঠকে বলেন, ১৩ সালের পর থেকে যে হত্যাকণ্ড হয়েছে সে সব বিষয়ে আমরা কাজ করছি। সে সময় প্রশাসন জামায়াতের যেসব নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা করেছিল সেগুলো তদন্তাধীন ছিল। সে সব মামলা শেষ করার চেষ্টা চলছে। একই সঙ্গে সাঈদী সাহেবের রায়ের পর যারা শহিদ হয়েছেন তাদের পরিবারের পক্ষ থেকেও কিছু মামলা হয়েছিল সেগুলো নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। নিহতের পরিবারের কোনো সদস্য নতুন করে মামলা করতে চাইলে জামায়াত সার্বিক সহযোগিতা করবে।
মেহেদী হাসান