ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৭ এপ্রিল ২০২৫, ৪ বৈশাখ ১৪৩২

মূল্য নির্ধারণে আজ বৈঠক ডেকেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়

ভোজ্যতেল নিয়ে ফের কারসাজি

এম শাহজাহান

প্রকাশিত: ০০:৫৬, ৯ এপ্রিল ২০২৫

ভোজ্যতেল নিয়ে ফের কারসাজি

ভোজ্যতেল নিয়ে ফের কারসাজি

সরকারিভাবে মূল্য নির্ধারণের আগেই ফের বেড়ে গেছে সব ধরনের ভোজ্যতেলের দাম। মূল্যবৃদ্ধি কার্যকর করতে ভোজ্যতেলের সরবরাহ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে মঙ্গলবার ঢাকার অনেক বাজারে চাহিদামতো বোতলজাত ও খোলা সয়াবিন তেল পাওয়া যায়নি। যারা তেল কিনেছেন তাদের বাড়তি টাকা গুনতে হয়েছে। ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে ফের অস্থির ভোজ্যতেলের বাজার।

এ অবস্থায় মঙ্গলবার বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে জরুরি বৈঠকে বসেন। কিন্তু সেই বৈঠকে দাম বাড়ানোর বিষয়ে ভোজ্যতেলের মিলমালিক, আমদানিকারক ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ঐকমত্যে পৌঁঁছতে পারেনি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। ভোক্তাদের স্বার্থে ভোজ্যতেলের দাম সহনীয় রাখতে চায় সরকার, অন্যদিকে ব্যবসায়ীরা চায় নিজেদের ইচ্ছেমতো দাম বাড়াতে।
এতে করে দু’পক্ষের রশি টানাটানিতে শেষ পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই বৈঠক শেষ করা হয়। ভোজ্যতেলের দাম নিয়ে আজ বুধবার আবারও বৈঠকে বসবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। আশা করা হচ্ছে, আজকের বৈঠকে ভোজ্যতেলের নতুন দাম নির্ধারণ করা সম্ভব হবে। তথ্যমতে, ভোজ্যতেলের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে একটি শক্তিশালী অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট। হাতেগোনা এই সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের হাতে জিম্মি বাজার।

ফলে রমজান মাসের বেশির ভাগ সময় দাম বেশি নিয়েই ভোজ্যতেল বিক্রি করেছে ব্যবসায়ীরা। ওই সময় প্রতিলিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল প্রায় ১৯০-২০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। তবে ঈদের সপ্তাহখানেক আগে বাজারে ভোজ্যতেলের সরবরাহ স্বাভাবিক হয়ে আসে। ফলে দামও সেই সময় কিছুটা কমে এসেছিল। কিন্তু বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে দাম নিয়ে বৈঠকের মধ্যেই বাজার তেলের সংকট তৈরি হয়েছে।

মিলমালিক থেকে শুরু করে খুচরা পর্যায়ে ভোজ্যতেল মজুত করা হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এ কারণে বেড়ে গেছে ভোজ্যতেলের দাম।  সরকারি বাজার নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্যমতে, মঙ্গলবার সয়াবিন তেল প্রতিলিটারের বোতল ১৭৫-১৭৬, সয়াবিন তেল পাঁচ লিটারের ক্যান ৮৪৫-৮৫০, সয়াবিন তেল খোলা ১৫৭-১৬৬, পামওয়েল খোলা প্রতিলিটার ১৪৪-১৫০, সুপার পামওয়েল প্রতিলিটার ১৫০-১৫৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে।

এ ছাড়া সংস্থাটি জানিয়েছে, বাজারে সয়াবিন তেলের দাম প্রতিলিটারে ১ টাকা বেড়েছে। তবে বাজার ঘুরে দেখা গেছে, সরকার নির্ধারিত আগের মূল্যের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে সব ধরনের ভোজ্যতেল। সর্বশেষ গত বছরের ৯ ডিসেম্বর বাড়ানো হয়েছিল বোতলজাত সয়াবিনের দাম। তখন লিটারপ্রতি মূল্য নির্ধারণ করা হয় ১৭৫ টাকা। খুচরা ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, এপ্রিলের প্রথম থেকে ভোজ্যতেলের সরবরাহ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। এতে করে দাম বেড়ে গেছে। 
উল্লেখ্য, ইতোমধ্যে প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিনের দাম ১৯৩ টাকা নির্ধারণ করার প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন। সেই হিসাবে লিটারে মূল্য বাড়ছে ১৮ টাকা। এ ছাড়া পাঁচ লিটারের বোতলজাত সয়াবিনের দাম ৯৩৫ টাকা নির্ধারণ করার প্রস্তাব করা হয়। খোলা সয়াবিন এবং খোলা পাম তেলের দাম লিটারপ্রতি ১৭০ টাকা নির্ধারণ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।

বর্তমানে সরকার নির্ধারিত দাম লিটারপ্রতি ১৫৭ টাকা। এ হিসাবে খোলা সয়াবিন ও পাম তেলের দাম বাড়বে লিটারপ্রতি ১৩ টাকা। এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আমদানি ও অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য (আইআইটি) দপ্তরের অতিরিক্ত সচিব আব্দুর রাজ্জাক জনকণ্ঠকে বলেন, ভোজ্যতেলের দাম নিয়ে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করা হয়েছে। তারা (ব্যবসায়ীরা) দাম বৃদ্ধির যে প্রস্তাবনা দিয়েছে সেই বিষয়টি সরকারের পক্ষ থেকে পর্যালোচনা করা হয়।

পুরো বিষয়টি অধিকতর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পরই নতুন দাম নির্ধারণ করা হবে। আর এক্ষেত্রে ভোক্তা স্বার্থ সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে। আশা করছি, আজকের বৈঠকে ভোজ্যতেলের যৌক্তিক দাম নির্ধারণ করা হবে। এদিকে, মঙ্গলবারের বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন, বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন, বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান, বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এম হায়দার হোসেন, বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মইনুল খান, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আমদানি ও অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য (আইআইটি) দপ্তরের অতিরিক্ত সচিব আব্দুর রাজ্জাক, সিটি, মেঘনা ও টিকে গ্রুপের প্রতিনিধিরা।

তবে মঙ্গলবারের বৈঠকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে সয়াবিন তেলের দাম বাড়ানোর ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়নি। ঈদের আগে সয়াবিন তেলের দাম প্রতি লিটারে এক লাফে ১৮ টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব করেছেন ভোজ্যতেল পরিশোধন কারখানার মালিকরা। ঈদের ছুটির আগে শেষ কর্মদিবস ২৭ মার্চ বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনকে বিষয়টি লিখিত জানিয়েছে বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন। মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দাম বাড়ছে কি না এ সিদ্ধান্ত ছাড়ায় বৈঠক শেষ হয়েছে। 
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ভোজ্যতেলের শুল্ককরে যে রেয়াতি সুবিধা দেওয়া হয়েছিল তার মেয়াদ শেষ হয়েছে গত ৩১ মার্চ। সরকার নতুন করে এর মেয়াদ বাড়াবে কিনা তা এখনো সুস্পষ্ট নয়।  কিন্তু এর আগেই সয়াবিনের দাম লিটারে ১৮ টাকা এবং খোলা সয়াবিনের দাম লিটারে ১৩ টাকা বাড়ানোর কথা বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনকে লিখিতভাবে জানিয়েছে।

গত ১ এপ্রিল থেকে এই দর কার্যকরেরও  ঘোষণা দেয় সংস্থাটি।  যদিও দাম সহনীয় রাখতে আমদানি পর্যায়ের অব্যাহত শুল্ক-কর রেয়াত ৩০ জুন পর্যন্ত বাড়ানোর সুপারিশ করেছিল বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যানের কাছে এ সংক্রান্ত চিঠি দেওয়া হয় সংস্থাটির পক্ষ থেকে। তবে এখন পর্যন্ত শুল্ককরের সুবিধা অব্যাহত রাখার বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি এনবিআর।

মিলাররা জানিয়েছেন, শুল্ক-কর রেয়াত সুবিধার মেয়াদ বাড়ানো হলে দাম বাড়ানো থেকে সরে আসবেন তারা। এ বিষয়ে মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের (এমজিআই) উপ-মহাব্যবস্থাপক তসলিম শাহরিয়ার বলেন, শুল্ক ছাড়ের এ সুবিধা উঠে গেলে কোম্পানিগুলো লোকসানে পড়বে। কারণ বিশ্ববাজারে সয়াবিন তেলের দাম বেশি। এছাড়ও দামের এ ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা আরও কয়েক মাস থাকবে। যে কারণে তেলের দাম বাড়ানো প্রয়োজন।

এদিকে, শুল্ককর অব্যাহতির মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় মূল্য সমন্বয়ের কথা বলেছেন ব্যবসায়ীরা। তাদের মতে, ১ এপ্রিল থেকে ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিয়ে সয়াবিন ও পাম তেল বাজারজাত করতে হচ্ছে। এ অবস্থায় মূল্য সমন্বয় করে পাম ও সয়াবিনের দাম নির্ধারণের দাবি করে বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন।

×