ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৭ এপ্রিল ২০২৫, ৩ বৈশাখ ১৪৩২

বাংলাদেশ-ভারত সময়সীমা সমন্বয়ে বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরায় নতুন নিষেধাজ্ঞা

আঃ রহিম গাজী, রাঙ্গাবালী সংবাদদাতা: (পটুয়াখালী) 

প্রকাশিত: ১২:১৪, ৮ এপ্রিল ২০২৫; আপডেট: ১৬:০০, ১৬ এপ্রিল ২০২৫

বাংলাদেশ-ভারত সময়সীমা সমন্বয়ে বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরায় নতুন নিষেধাজ্ঞা

ছবি: সংগৃহীত

বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের সামুদ্রিক জলসীমায় মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞার সময়সীমা ৬৫ দিন থেকে কমিয়ে ৫৮ দিন নির্ধারণ করেছে সরকার। শুধু সময়সীমাই নয়, এবার প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে প্রায় একই সময়ে নিষেধাজ্ঞার সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এতে দেশের লাখো উপকূলবাসীর দীর্ঘদিনের দাবি পূরণ হয়েছে, সেই সঙ্গে রক্ষা পাবে সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদ।

নিষেধাজ্ঞার সময়সীমা:
গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে প্রতিবছর ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত ৬৫ দিন সামুদ্রিক মৎস্য আহরণে নিষেধাজ্ঞা জারি থাকত। এই সময় মাছের প্রজনন মৌসুম হওয়ায় মৎস্যসম্পদ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। তবে একই সময়ে ভারতের জলসীমায় নিষেধাজ্ঞার সময় ছিল ১৫ এপ্রিল থেকে ১৪ জুন—মোট ৬১ দিন।

এই অসামঞ্জস্যতার সুযোগে, বাংলাদেশের জেলেদের অভিযোগ ছিল যে, যখন তারা মাছ ধরতে পারেন না, তখন ভারতীয় ট্রলার ও জেলেরা বাংলাদেশের জলসীমায় প্রবেশ করে নির্বিচারে মাছ শিকার করে নিয়ে যায়। এতে দেশের লাখো জেলে যেমন আয় হারায়, তেমনি দেশের সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদও হুমকির মুখে পড়ে।

জেলেদের অভিযোগ, নিষেধাজ্ঞার সময় তারা ক্ষতিপূরণ বা বিকল্প জীবিকার সুযোগ না পেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করেন, অথচ পাশের দেশের জেলেরা সেই সময় মাছ ধরে লাভবান হন। এই অসম প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের উপকূলীয় জেলেরা দীর্ঘদিন ধরে নিষেধাজ্ঞার সময়সীমা ভারতের সঙ্গে সামঞ্জস্য করার দাবি জানিয়ে আসছিলেন।

সরকারের নতুন সিদ্ধান্ত:
এই বাস্তবতা বিবেচনায় রেখে সরকার চলতি বছরের ১৬ মার্চ এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে নতুন নিষেধাজ্ঞার সময়সীমা ঘোষণা করেছে। এখন থেকে প্রতিবছর ১৫ এপ্রিল থেকে ১১ জুন পর্যন্ত ৫৮ দিন বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের জলসীমায় সব ধরনের সামুদ্রিক মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকবে। একই সময়ে ভারতের জলসীমায়ও থাকবে নিষেধাজ্ঞা—যা শেষ হবে ১৪ জুন। ফলে দুই দেশের নিষেধাজ্ঞার সময় প্রায় একই, বাংলাদেশে এটি শেষ হবে ভারতের নিষেধাজ্ঞা তিন দিন আগে।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, নিষেধাজ্ঞার এই পুনর্বিন্যাস সামুদ্রিক মাছের প্রজনন, টেকসই আহরণ এবং উপকূলীয় জেলেদের জীবনমান রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

মৎস্য অধিদপ্তরের পটুয়াখালী অঞ্চলের সিনিয়র সহকারী পরিচালক প্রদীপ কুমার সরকার বলেন, “আমাদের দেশীয় জেলেরা দীর্ঘদিন ধরেই এ বিষয়ে দাবি জানিয়ে আসছিলেন। সরকার সেই দাবি আমলে নিয়ে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা অত্যন্ত সময়োপযোগী এবং বাস্তবভিত্তিক।”

জেলেদের স্বস্তি:
সরকারি এই সিদ্ধান্তে খুশি জেলে ও মৎস্য ব্যবসায়ীরা। পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার জেলে হারুন মাঝি বলেন, “আগে নিষেধাজ্ঞার সময় আমরা মাছ ধরতে পারতাম না, অথচ ভারতীয় ট্রলারগুলো দিব্যি মাছ ধরে নিয়ে যেত। এবার অন্তত আমরা সবাই একসাথে বিরত থাকব। এতে লস কম হবে।”

গবেষকদের মতে এটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত:
মৎস্যবিজ্ঞানী ও গবেষকরাও সরকারের এই সিদ্ধান্তকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন। শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকুয়াকালচার বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মীর মোহাম্মদ আলী বলেন, “দুই দেশের সময়সীমা এক হলে মৎস্যসম্পদের সুরক্ষা আরও কার্যকর হবে। এতদিন আমরা নিষেধাজ্ঞা দিয়ে অন্য দেশকে সুযোগ করে দিচ্ছিলাম। এখন তা আর হবে না। প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সমন্বয় করে সামুদ্রিক নীতিমালা তৈরির এই পদক্ষেপ দীর্ঘমেয়াদে দেশের অর্থনীতি, প্রাণিজ সম্পদ এবং উপকূলীয় জীবিকার জন্য বড় অর্জন হয়ে থাকবে।"

তিনি আরও বলেন, "নিষেধাজ্ঞার সময়সীমা সমন্বয়ের পাশাপাশি এটিকে কার্যকর করতে প্রয়োজন কঠোর নজরদারি, কোস্টগার্ড ও নৌবাহিনীর তৎপরতা, এবং জেলেদের জন্য বিকল্প আয়ের উৎস। নিষেধাজ্ঞার সময় উপকূলীয় পরিবারগুলো যাতে খাদ্য ও নগদ সহায়তা পায়, সে দিকেও নজর দিতে হবে সরকারকে।"

বাংলাদেশের জলসীমায় নিষেধাজ্ঞার সময়সীমা কমিয়ে ভারতের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা শুধু মৎস্য সেক্টরের উন্নয়ন নয়, বরং একটি পরিপক্ব ও সমন্বিত নীতির প্রতিফলন। এর মাধ্যমে যেমন মৎস্যসম্পদ সংরক্ষণ সহজ হবে, তেমনি উপকূলীয় অঞ্চলের জেলে পরিবারগুলোর অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাও নিশ্চিত হবে—এমনটাই প্রত্যাশা সংশ্লিষ্ট মহলের।

আবীর

×