
ছবিঃ সংগৃহীত
পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের জন্য শুধু পরিবেশগত সমস্যা নয়, বরং এটি আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা, ভৌগলিক অখণ্ডতা ও সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য এক ভয়াবহ অস্তিত্ব সংকটে পরিণত হয়েছে।
ঢাকার ডিফেন্স সার্ভিসেস কমান্ড অ্যান্ড স্টাফ কলেজে (DSCSC) “জাতীয় নিরাপত্তার ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব” শীর্ষক এক বক্তৃতায় তিনি বলেন, “ভাবুন তো, যদি বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশ পানির নিচে চলে যায়... বাকি দুই-তৃতীয়াংশ, যেখানে আগে থেকেই জনসংখ্যার চাপ আছে, তাদের কাঁধে এসে পড়বে খাদ্য ও আশ্রয়ের বিশাল দায়িত্ব। তখন স্থিতিশীলতা আর থাকবে না — অস্থিরতাই হয়ে উঠবে স্বাভাবিক।”
তিনি বলেন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়া, উপকূলরেখার হারিয়ে যাওয়া এবং জলবায়ুজনিত বাস্তুচ্যুতির ফলে বাংলাদেশকে আগামী কয়েক দশকের মধ্যে তার মানচিত্রই নতুন করে আঁকতে হতে পারে।
এক মিটার সমুদ্রপৃষ্ঠ উচ্চতা বৃদ্ধি — যা এই শতাব্দীর মধ্যভাগে হবার সম্ভাবনা প্রবল — বাংলাদেশের ২১টি উপকূলীয় জেলা সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে পানির নিচে চলে যেতে পারে, ফলে লাখ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হবে এবং লবণাক্ততার কারণে আমাদের নদীগুলো, যা কৃষি ও মৎস্যখাতের প্রাণভোমরা, ধ্বংস হয়ে যাবে।
“জলবায়ু পরিবর্তনের কথা বললে আমরা শুধু মিষ্টি পানি লবণাক্ত হয়ে যাওয়ার কথা বলছি না,” তিনি বলেন। “আমরা বলছি সার্বভৌমত্বের আত্মসমর্পণ, জাতীয় ভূখণ্ড হারানো, এবং গোটা গোটা সম্প্রদায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার কথা।”
রিজওয়ানা বলেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে জলবায়ু পরিবর্তন কেবল প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়, এটি একটি ‘সংকট বর্ধক’ (instability multiplier)। খরা, বন্যা, ঘূর্ণিঝড় আমাদের প্রতি বছর জিডিপির প্রায় ১ শতাংশ ক্ষতি করছে, এবং ২০৫০ সালের মধ্যে এটি দ্বিগুণ হয়ে যেতে পারে। এর সাথে যোগ হচ্ছে ফসলহানি, পানির সংকট ও গণপর্যায়ে বাস্তুচ্যুতি — যা সীমিত সম্পদের জন্য সংঘাতকে অনিবার্য করে তুলবে।
তিনি সমালোচনা করেন তেল-সমৃদ্ধ দেশগুলোর কৌশলগত অবহেলা ও প্যারিস চুক্তির মতো স্বেচ্ছাধীন উদ্যোগের দুর্বলতাকে। “বিশ্বের ৮০ শতাংশ কার্বন নির্গমন করে জি-২০ দেশগুলো, আর সেই বোঝা বইছে বাংলাদেশ — যাকে জলবায়ু বিপদের তালিকায় সপ্তম স্থানে রাখা হয়েছে।”
তিনি বলেন, ২০২৪ ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে উষ্ণ বছর; মহাসাগরের উষ্ণায়ন ও হিমবাহ গলনের হার দ্বিগুণ হয়েছে। “বিশ্ব যেভাবে নিষ্ক্রিয় আছে, তা আমাদের মতো দেশের জন্য মৃত্যু পরোয়ানার শামিল।”
পরিবেশ উপদেষ্টা বাংলাদেশের জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনার (National Adaptation Plan) উল্লেখ করে বলেন, এই পরিকল্পনায় ১১টি জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল চিহ্নিত করা হয়েছে এবং ২০৫০ সালের মধ্যে টিকে থাকতে প্রয়োজন $২৩০ বিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থায়ন। কিন্তু তিনি জোর দিয়ে বলেন, টাকা থাকলেই হবে না।
“আমাদের উন্নয়ন মডেলটাই পুনর্বিবেচনা করতে হবে,” বলেন তিনি। “ফসিল ফুয়েলের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে আমাদের আঞ্চলিক পুনর্নবীকরণযোগ্য জ্বালানির দিকে যেতে হবে, যেমন— নেপাল থেকে জলবিদ্যুৎ আমদানি। আর্কিটেকচারে প্রাকৃতিক বাতাস ও আলোকে গুরুত্ব দিতে হবে, এয়ার কন্ডিশনের বদলে প্রকৃতির সাথে খাপ খাওয়ানো দরকার।”
তিনি বলেন, পরিবেশ আইন বাস্তবায়নে দুর্নীতি ও জনবল সংকট বড় বাধা। “আমি যখন কোনো কারখানায় অভিযান চালাতে বলি, তখন কর্মকর্তারা বলেন, সারা দেশের জন্য তাদের মাত্র ৬ জন ম্যাজিস্ট্রেট আছে।”
বক্তৃতায় উঠে এসেছে উপকূলীয় নারীদের লবণাক্ত পানির কারণে ত্বকের ক্ষত, কৃষকদের অকালবৃষ্টির বিরুদ্ধে দোয়া করার বাস্তবতা।
তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর দুর্যোগ প্রতিক্রিয়ার প্রশংসা করেন, বিশেষ করে কুড়িগ্রামে নদীভাঙনের সময়। তবে বলেন, এখন সময় এসেছে দীর্ঘমেয়াদি পুনর্বাসন কৌশল গ্রহণের।
“সেনাবাহিনীর ভূমিকা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার গণ্ডি ছাড়িয়ে যাবে — তারা ভবিষ্যতে জলবায়ু শরণার্থী ব্যবস্থাপনা ও আন্তঃসীমান্ত নদীর পানি বণ্টন চুক্তিতেও যুক্ত হবে।”
শেষ কথায় রিজওয়ানা বলেন, “এটা গাছ বাঁচানোর কথা নয়। এটা দেশ বাঁচানোর কথা। আমরা যদি ব্যর্থ হই, তাহলে আগামী প্রজন্ম এমন একটা বাংলাদেশ পাবে, যা আজকের মানচিত্রে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।”
উক্ত অনুষ্ঠানে ডিএসসিএসসি'র কমান্ড্যান্ট মেজর জেনারেল চৌধুরী মোহাম্মদ আজিজুল হক হাজারী, ডেপুটি কমান্ড্যান্ট কমোডোর মুস্তাক আহমেদ, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ মেহেদী হাসান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
মারিয়া