ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৮ এপ্রিল ২০২৫, ২৫ চৈত্র ১৪৩১

বিশ্বে তেলের দাম চার বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন

স্টাফ রিপোর্টার

প্রকাশিত: ২৩:২৭, ৭ এপ্রিল ২০২৫

বিশ্বে তেলের দাম চার বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন

তেলের দামে ধস নেমেছে

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার বাণিজ্য অংশীদারদের ওপর ব্যাপক পাল্টা শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত নেওয়ায় সোমবার তেলের দামে ধস নেমেছে। মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন এ খবর জানিয়েছে। 
বিশ্ববাজারে ব্রেন্ট ক্রুড অয়েলের দাম ৩.৫ শতাংশ কমে ব্যারেলপ্রতি ৬৩.৩০ ডলারে লেনদেন হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের মানদণ্ড ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েট (ডব্লিউটিআই) তেলও ৩.৫ শতাংশ কমে ব্যারেলপ্রতি ৫৯.৮৪ ডলারে নেমে এসেছে। দুটি তেলই এখন এমন এক দামে লেনদেন হচ্ছে যা ২০২১ সালের শুরু থেকে দেখা যায়নি। 
তেলের এই দামপতনের পেছনে অন্যতম কারণ হলো, বিশ্বের শীর্ষ তেল উৎপাদকদের জোট ওপেক প্লাস গত সপ্তাহে বিনিয়োগকারীদের চমকে দিয়েই পূর্বঘোষিত পরিকল্পনার চেয়ে অনেক বড় পরিমাণে তেল সরবরাহ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সৌদি আরব, রাশিয়া এবং ওই জোটের আরও ছয়টি সদস্য দেশ মে মাস থেকে পূর্বঘোষিত তুলনায় অনেক বেশি তেল উৎপাদন বাড়াতে সম্মত হয়েছে।
চীন আরোপিত শুল্ক ॥ এদিকে ট্রাম্পের বাণিজ্যযুদ্ধ এবং চীনের পাল্টা প্রতিক্রিয়াকে আরোপিত উচ্চ শুল্কের জেরে বৈশ্বিক শেয়ারবাজারে শুরু হওয়া ধস আরও গভীর হয়েছে। সোমবার এশিয়ার শেয়ারবাজারে বড় ধরনের পতন হয়েছে। জাপানের বেঞ্চমার্ক নিকেই ২২৫ সূচক ৭.৯ শতাংশ কমেছে। আর বৃহত্তর টপিক্স সূচক পড়েছে ৭.৭ শতাংশ। 
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আমদানি হওয়া সব পণ্যের ওপর ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন। কিছু দেশের ক্ষেত্রে তা আরও বেশি নির্ধারণ করা হয়েছে। তার জবাবে চীনও আমেরিকান পণ্যে নতুন শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেয়। এমন প্রেক্ষাপটে বৈশ্বিক বাণিজ্যযুদ্ধ আরও তীব্র হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এর প্রভাবে বিশ্বব্যাপী শুক্রবার অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম প্রায় ৭ শতাংশ কমে। 
আন্তর্জাতিক বাজার আদর্শ ব্র্রেন্টের দাম কমেছে ৪ ডলার ৫৬ সেন্ট বা ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। প্রতি ব্যারেলের মূল্য স্থির হয়েছে ৬৫ ডলার ৫৮ সেন্টে। এদিন মার্কিন বাজার আদর্শ ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েটের (ডব্লিউটিআই) দাম ৪ ডলার ৯৬ সেন্ট বা ৭ দশমিক ৪ শতাংশ কমে ব্যারেলপ্রতি মূল্য নেমেছে ৬১ ডলার ৯৯ সেন্টে। শুক্রবার লেনদেন চলাকালে ব্রেন্টের দাম সর্বনিম্ন ব্যারেলে ৬৪ ডলার ৩ সেন্ট ও ডব্লিউটিআই ৬০ ডলার ৪৫ সেন্টে নেমে আসে।
বিশ্বের শীর্ষ জ্বালানি তেল আমদানিকারক দেশ চীন ঘোষণা দেয়, ১০ এপ্রিল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সব পণ্যের ওপর অতিরিক্ত ৩৪ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হবে। এছাড়া বিশ্বের অন্যান্য দেশও তার জবাবে পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। বর্ধিত এ বাণিজ্যযুদ্ধের প্রভাবে বিনিয়োগকারীরা বিশ্বমন্দার আশঙ্কা আরও জোরালোভাবে বিবেচনায় নিচ্ছেন।
শুল্কের প্রভাব ॥ শুল্কের প্রভাবে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল ছাড়াও প্রাকৃতিক গ্যাস, সয়াবিন ও স্বর্ণের দামও কমেছে। একই সঙ্গে বিশ্ববাজারের শেয়ারদরেও তীব্র পতন দেখা গেছে। বিনিয়োগ ব্যাংক জেপি মর্গান জানায়, ২০২৫ সালের মধ্যে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার আশঙ্কা বর্তমানে ৬০ শতাংশ, আগে যা ছিল ৪০ শতাংশ। এদিকে সপ্তাহ ভিত্তিতে ব্রেন্টের দাম ১০ দশমিক ৯ শতাংশ কমেছে। 
ইউনাইটেড আইক্যাপের এনার্জি স্পেশালিস্ট স্কট শেলটন বলেন, ‘বর্তমান দামই হয়তো ‘ন্যায্যমূল্যের’ কাছাকাছি। তবে প্রকৃতপক্ষে চাহিদা ঠিক কতটা কমেছে তা বোঝা গেলে আরও স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাবে।’
চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যযুদ্ধ নতুন মাত্রা পাওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে শুক্রবার তেলের দাম এক লাফে ৭ শতাংশ কমে গেছে, যা গত তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে বিনিয়োগকারীরা বৈশ্বিক মন্দার আশঙ্কা আরও জোরালোভাবে মূল্যায়ন করছেন।
এ ছাড়া, তেলের দামে আরও চাপ তৈরি করেছে ওপেক প্লাস-এর উৎপাদন বৃদ্ধির ঘোষণা। সংস্থাটি মে মাসে প্রতিদিন ৪ লাখ ১১ হাজার ব্যারেল উৎপাদন বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যেখানে আগে পরিকল্পনা ছিল ১ লাখ ৩৫ হাজার ব্যারেল।
রাশিয়ার আদালত কাস্পিয়ান পাইপলাইন কনসোর্টিয়ামের (সিপিসি) ব্যাক সি রপ্তানি টার্মিনাল বন্ধ না করার রায় দিয়েছে, যা কাজাখস্তানের তেল সরবরাহে সম্ভাব্য সংকট এড়াতে সহায়ক হবে এটিও দাম হ্রাসে ভূমিকা রেখেছে।
এইচএসবিসিও ২০২৫ সালের বৈশ্বিক তেলের চাহিদা বৃদ্ধির পূর্বাভাস কমিয়ে ১০ লাখ ব্যারেল থেকে ৯ লাখ ব্যারেলে নামিয়ে এনেছে। তাদের মতে, শুল্ক আরোপ এবং ওপেক প্লাসের সিদ্ধান্তই এর মূল কারণ।
ইউনাইটেড আইক্যাপের জ্বালানি বিশেষজ্ঞ স্কট শেলটন বলেন, ‘আমার দৃষ্টিতে এটি এখন সম্ভবত অপরিশোধিত তেলের ন্যায্য মূল্য। তবে আমরা এখনো জানি না, আসলে চাহিদা কতটা কমেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার ধারণা, সামনের দিনগুলোতে ডব্লিউটিআই-এর দাম ৫০ ডলারের মাঝামাঝি বা তার কিছু ওপরে ঘোরাফেরা করবে। বর্তমান বাজার পরিস্থিতিতে চাহিদা কমতে বাধ্য।’
অ্যাঙ্গোলা, আলজেরিয়া, ইরাক, ইরান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, নাইজিরিয়া, ভেনেজুয়েলা, লিবিয়া, সৌদি আরব, গ্যাবন, ইকুয়েটোরিয়াল গিনি- এই ১২ দেশ নিয়ে গঠিত জোট ওপেকের ওপর মূলত নির্ভর করে বিশ্ববাজারে তেলের দাম কতটা বাড়বে বা কমবে।
দামের ওঠানামা ॥ ২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে পশ্চিমারা রাশিয়ার তেল বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা দেয়। ব্যাহত হয় তেল সরবরাহ ও উৎপাদন। এর জেরে সে বছর অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের ব্যারেলপ্রতি দাম সর্বোচ্চ ১৩৯ মার্কিন ডলারে উঠে যায়।
জ্বালানি তেলের দামের সঙ্গে অনেক কিছুর সম্পর্ক আছে। সে জন্য তেলের দাম বাড়লে পরিবহন ব্যয় এবং শিল্প, কৃষি ও বিদ্যুৎ- সবকিছুর উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যায়। কেবল বাংলাদেশই নয়, জ্বালানি তেল ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির কারণে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোও বিপদে পড়েছিল। ২০২২ সালে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যস্ফীতি ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে ওঠে। যদিও তারা নীতি সুদহার বাড়িয়ে ধারাবাহিকভাবে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে, বাংলাদেশ যা পারছে না।

×