ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৮ এপ্রিল ২০২৫, ২৫ চৈত্র ১৪৩১

বড় বাধা আরাকান আর্মি ও খোদ রোহিঙ্গারা

রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন নিয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জে ঢাকা

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ

প্রকাশিত: ২৩:১৭, ৭ এপ্রিল ২০২৫

রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন নিয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জে ঢাকা

বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গার সংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ

সরকারি পরিসংখ্যানে যা-ই থাকুক না কেন বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গার সংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ। এ ছাড়া মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা আরও নতুন নতুন রোহিঙ্গা যোগ হচ্ছে এ তালিকায়। নতুনদের ক্ষেত্রে বিজিবি (বর্ডার গার্ড পুলিশ) সদস্যরা পুশব্যাক প্রক্রিয়া চালিয়ে থাকে সত্য, তবে এরা দালালদের মাধ্যমে নদী, স্থল এবং সাগর পথে পুনরায় সীমান্ত পেরিয়ে এসে থাকে।

রাখাইন রাজ্যে বিদ্রোহী আরাকান আর্মির (এএ) চলমান ভয়াবহ পরিস্থিতিতে সেখানকার অপেক্ষাকৃত দরিদ্র রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সদস্যরাই মূলত প্রাণ বাঁচাতে এবং জীবিকার টানে বাংলাদেশমুখী হচ্ছে। ফলে বাংলাদেশের মানবিকতা বিষফোঁড়া হয়ে আছে বহু আগে থেকেই। 
আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মধ্যে এক লাখেরও বেশি শরণার্থীর মর্যাদায় রয়েছে। অবশিষ্ট প্রায় ১৪ লাখ উদ্বাস্তু। এদের বিশাল অংশকে মিয়ানমার থেকে বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত হিসেবে রেকর্ড করা হয়েছে। এসব রোহিঙ্গার নিজ দেশে প্রত্যাবাসন নিয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জে রয়েছে বাংলাদেশ। কয়েক দফায় ফেরানোর জন্য মিয়ানমারপক্ষ সম্মতি জানিয়ে চুক্তিবদ্ধ হলেও তা কার্যকর হয়নি। এ প্রক্রিয়ায় রোহিঙ্গাদের অনিচ্ছাও বড় একটি বিষয় ছিল।

কিন্তু বর্তমানে রাখাইন রাজ্যের ৮০ শতাংশের বেশি এলাকা সে দেশের বিদ্রোহী আরাকান আর্মির দখল ও নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ায় প্রত্যাবাসন ইস্যুটি বড় ধরনের জটিল অবস্থার কবলে পড়েছে। মিয়ানমারের জান্তা সরকার চাইলে আরাকান আর্মির সম্মতি ব্যতিরেকে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া মোটেই যে সম্ভব নয় তা সহজে অনুমেয়। এ অবস্থায় তৃতীয় কোনো পক্ষের সমঝোতা ছাড়া রোহিঙ্গাদের রাখাইন রাজ্যে ফিরে যাওয়া মোটেই সম্ভব নয়। অপরদিকে রয়েছে, আশ্রিত রোহিঙ্গারা ফিরে যেতে চায় কিনা।

রোহিঙ্গা নেতারা আগে থেকে দাবি দিয়ে রেখেছে নাগরিকত্ব প্রদান ছাড়া তারা ফিরে যাবে না। এ কথা সত্য যে, অতীতে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিকত্ব ছিল। কিন্তু জান্তা সরকার তাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়েছে। বর্তমান মিয়ানমার সরকার প্রত্যাবাসনের বিষয়ে মুখ খুললেও রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব প্রদানের বিষয়ে মুখে কুলুপ এঁটে রেখেছে। ফলে বিষয়টি জটিল রূপ নিয়েছে। এ অবস্থায় মিয়ানমার পক্ষের প্রত্যাবাসন শুরুর বিষয়টি বিভিন্ন বিশ্লেষক ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের মতোই বলছেন।

কারণ জান্তা সরকার ভালোই জানে তাদের হাতছাড়া হয়ে যাওয়া রাখাইন রাজ্যের দখল ও নিয়ন্ত্রণ আরাকান আর্মির হাতে। এ বিদ্রোহী গোষ্ঠী রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মোটেই ইচ্ছুক নয়। এছাড়া নাগরিকত্বসহ সাত দফা দাবি মানা না হলে আশ্রিত রোহিঙ্গারাও ফিরে যাবে না। ফলে প্রত্যাবাসনের পক্ষে মত দেওয়া মিয়ানমারের বড় একটি চাল বলেই আলোচিত হচ্ছে। তারা বহির্বিশ^কে দেখাতে চায়- প্রত্যাবাসনে তারা ইচ্ছুক। এদিকে, মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের আমদানি রপ্তানি কার্যক্রমের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে আরাকান আর্মি। তাদের অলিখিত নানা আবদার মেটাতে হচ্ছে বাণিজ্যিক কার্যক্রমে জড়িতদের। 
উখিয়া ও টেকনাফের স্থানীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে, রাখাইন রাজ্য থেকে আরও রোহিঙ্গা ইতোমধ্যে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। ফাঁকফোকরে আরও আসার চেষ্টায় তৎপর। তবে রাখাইনে বাপ-দাদার রেখে যাওয়া ভিটা ছাড়তে নারাজ ধনাঢ্যরা। যারা গরিব তারাই বাংলাদেশে আশ্রয় ক্যাম্পে পালিয়ে আসতে আগ্রহী। 
জানা গেছে, রাখাইনে বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের মধ্যে দু’ধরনের পরিবার রয়েছে। প্রত্যাবাসিত রোহিঙ্গা ও স্থায়ী বসবাসকারী রোহিঙ্গা। অর্থাৎ ইতোপূর্বে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা ও পরবর্তীতে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সিদ্ধান্ত অনুসারে প্রত্যাবাসন হওয়া রোহিঙ্গা পরিবার। আর যারা কখনো বাংলাদেশ বা পাশর্^বর্তী কোনো দেশে উদ্বাস্তু না হয়ে রাখাইনে স্থায়ীভাবে বসবাসকারী রোহিঙ্গা পরিবার। সেখানে বসবাসকারী রোহিঙ্গা ধনাঢ্যরা সহজে বাংলাদেশে আসতে রাজি নয় মোটেও।

রাখাইনে যাদের আয়-রোজগার নেই, মূলত তারাই বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে উদ্যোগী হয়ে উঠেছে। অতি উৎসাহী হত-দরিদ্র ওই রোহিঙ্গাদের মধ্য থেকে গত কয়েক মাসে প্রায় লাখের কাছাকাছি বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। ওই রোহিঙ্গারা উখিয়া-টেকনাফের বিভিন্ন আশ্রয় ক্যাম্পে ঢুকে পড়েছে। তাদের পরিবারে মাথাপিছু সবাইকে তালিকাভুক্ত করে নিচ্ছে ইউএনএইচসিআর। তারা বর্তমানে পূর্বেকার রোহিঙ্গাদের মতো রেশন তথা ত্রাণ সামগ্রীও ভোগ করছে।

এই রোহিঙ্গাদের জন্য উখিয়ার ১৪ নম্বর ক্যাম্পে নতুন করে আবাসন তৈরি করা হচ্ছে। বাহারছড়া সমুদ্র পয়েন্ট ও টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ পয়েন্ট দিয়ে ইঞ্জিনচালিত বোট নিয়ে লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছে। বিজিবি জানিয়েছে, ইতিপূর্বে যেসব রোহিঙ্গা পরিবার অনুপ্রবেশ করেছিল, তাদের পুশব্যাক করা হয়েছে। স্থানীয়রা বলছেন, বিজিবি অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের একপথে পুশব্যাক করলে দালালের মাধ্যমে ওইসব রোহিঙ্গা ভিন্ন পথ ধরে ফের ঢুকে পড়ে বাংলাদেশে।
আরও জানা গেছে, রাখাইন রাজ্যে যেকোনো এনজিও প্রতিনিধিদের প্রবেশাধিকার নিষেধ থাকলেও ইউএনএইচসিআরের প্রবেশাধিকারের অনুমতি রয়েছে মিয়ানমার সরকারের। সেখানে আশ্রয় ক্যাম্পে যেসব রোহিঙ্গা আশ্রিত তাদের ভরণপোষণ ও ত্রাণসামগ্রী চালিয়ে নিচ্ছে এই সংস্থা। স্থানীয় পালংখালী ইউপি চেয়ারম্যান এম গফুর উদ্দিন চৌধুরী জানিয়েছেন, নতুন করে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের জন্য ঘর তৈরি করতে ১৪ নম্বর আশ্রয় ক্যাম্পে সামাজিক বনায়নের হাজার হাজার গাছ নিধন ও পাহাড় কাটা হচ্ছে নির্বিচারে।

সেখানে নতুন করে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের কক্ষ তৈরি করে দিচ্ছে একটি এনজিও। জানা গেছে, ওইসব রোহিঙ্গাকে পাহাড় কেটে আশ্রয় দেওয়ার জন্য সরকার বলেনি। সচেতন মহল জানায়, অতিউৎসাহী হয়ে কতিপয় ক্যাম্পইনচার্জ গাছ ও পাহাড় কেটে বনজ সম্পদ ধ্বংস করে সেখানে রোহিঙ্গাদের জন্য ঘর নির্মাণের মানে কি? পরিবেশের ক্ষতি করত: নতুন করে রোহিঙ্গা আবাসনের অনুমতি কে দিল? সেটা খতিয়ে দেখার দাবি জানিয়েছেন তারা। 
সূত্র জানিয়েছে, মিয়ানমারের আরাকান তথা রাখাইন রাজ্যেই মূলত রোহিঙ্গাদের বসবাস। ইয়াঙ্গুনসহ আরও কয়েকটি রাজ্যে রোহিঙ্গা বসতি থাকলেও তা হাতেগোনা মুষ্টিমেয় কিছু পরিবার। তারা আবার ধনাঢ্যও বটে। রাখাইন রাজ্যের মহকুমা শহর হচ্ছে সিটওয়ে (আকিয়াব)। এই মহকুমা শহরের অধীনে চারটি জেলা রয়েছে। মংডু, রাচিদং, বুচিদং ও আকিয়াব।

বুচিদং শহরসহ আকিয়াবজুড়ে এখনো বসতি রয়েছে প্রায় ৬ লাখ রোহিঙ্গার। আকিয়াব ছাড়া রাখাইনের প্রায় অঞ্চল সে দেশের বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে। মিয়ানমারের তাদমাদু (সেনা বাহিনী) রাখাইনের ওইসব অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। সেখানে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন করতে গেলে প্রতিষ্ঠিত বা বৈধ সরকারের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি মোতাবেক রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন করতে হবে।

যেখানে প্রত্যাবাসন কর্যক্রম চালানো হবে (মংডু) সেটিতো আরাকান আর্মির দখলে। সে হিসেবে প্রত্যাবাসনে আগ্রহী সাধারণ রোহিঙ্গারা চেয়ে আছে সরকারের উচ্চ মহলের পদক্ষেপের ওপর। এরপর রোহিঙ্গাদের দাবিগুলো মেনে নেওয়া হলে সাধারণ রোহিঙ্গারা নিজ দেশে ফেরত যেতে রাজি বলে জানা গেছে। উল্লেখ্য, নোয়াখালীর ভাসানচর ও উখিয়া-টেকনাফে নতুন পুরনো মিলে প্রায় ১৫ লাখ রোহিঙ্গা বসবাস করছে।

তন্মধ্যে শরণার্থী রয়েছে প্রায় এক লাখ এবং বাকি সবাই উদ্বাস্তু। ওইসব উদ্বাস্তুকে শরণার্থীর মর্যাদা দিতে সরকারের কাছে প্রস্তাব পেশ করেছে ইউএনএইচসিআর। তবে সরকারের পক্ষে না বলায় তারা এখনো তদ্বির চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানা গেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের একজন হেডমাঝি জানান, রাখাইনে প্রত্যাবাসনের পক্ষে কাজ করতে দেখে আরসা ক্যাডাররা গুলি করে হত্যা করেছে মাস্টার মুহিবুল্লাকে। এরপর থেকে সাধারণ রোহিঙ্গারা প্রত্যাবাসনে রাজি বলে মুখ খোলতে নারাজ।  প্রত্যাবাসনের বিষয়ে তিনি বলেন, রোহিঙ্গারা রাখাইনে গিয়ে বসতি স্থাপন করবে কোথায়? মংডুতে যেখানে ক্যাম্প নির্মাণ করা হয়েছে, সেটি আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে।

আর রোহিঙ্গারা ফেলে আসা ভিটাবাড়ি দেশটির মিলিটারি বুলডোজার দিয়ে জমির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে। সেখানে বসানো হয়েছে রাখাইন পাড়া। মংডুতে নির্মিত আশ্রয় ক্যাম্পে রোহিঙ্গারা কখনো ফিরে যাবে না। এ ছাড়াও রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব না পাওয়া পর্যন্ত তারা বাংলাদেশে ছেড়ে রাখাইনে ফিরে যাবে না।

×