ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৮ এপ্রিল ২০২৫, ২৪ চৈত্র ১৪৩১

ফলোআপ

বাগেরহাটে বাণিজ্যিক ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে নিহত ১, আহত ৪২

স্টাফ রিপোর্টার, বাগেরহাট

প্রকাশিত: ২০:২৭, ৭ এপ্রিল ২০২৫

বাগেরহাটে বাণিজ্যিক ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে নিহত ১, আহত ৪২

ছবি: সংগৃহীত

বাগেরহাটের চিতলমারীতে সোমবার (৭ এপ্রিল) সকালে 'মাইশা টাওয়ার' নামের একটি ৫ তলা বাণিজ্যিক ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। আগুনে শ্বাসরোধ হয়ে অনিতা রায় (৪০) নামে এক নারীর মৃত্যু হয়েছে, আহত হয়েছেন ৪২ জন।

অবস্থা গুরুতর হওয়ায় আহতদের মধ্যে ৪ জনকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। জেলা প্রশাসক আহমেদ কামরুল হাসান আগুনের খবর পেয়ে তাৎক্ষণিক ঘটনাস্থলে যান।

অগ্নিকাণ্ডের খবর পেয়ে চিতলমারী ফায়ার সার্ভিসও ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। একে একে বাগেরহাট, গোপালগঞ্জ ও খুলনার ৮টি ইউনিট অগ্নিনির্বাপণ ও উদ্ধার কাজে অংশ নেয়। এর সাথে যোগ দেয় সেনাবাহিনী ও পুলিশ সদস্যরা। প্রায় ৪ ঘণ্টার সম্মিলিত চেষ্টায় তারা আগুন নেভাতে সক্ষম হয়।

তবে এই সময়ের ভবনের নিচে থাকা এমআরএম ফ্যাশনসহ কয়েকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পুড়ে ভস্মীভূত হয়ে যায়। ভবনের তৃতীয় তলায় থাকা সুস্বাস্থ্য ও পরিচর্যা ক্লিনিকের রোগীসহ অন্তত ৪২ নারী-পুরুষ আহত হন। আহতসহ প্রায় ৮০ জনকে উদ্ধার করে সেনাবহিনী, পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও স্থানীয় বাসিন্দারা। তবে ভবনের দ্বিতীয় তলায় থাকা ব্যাংকের শাখাগুলোর তেমন কোন ক্ষতি হয়নি বলে জানিয়েছে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।

সোনালী ব্যাংক চিতলমারী শাখার ব্যবস্থাপক মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, 'আগুনে ভবনের অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হলেও ব্যাংকের তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি। তবে ব্যাংক কার্যালয় এখনও আমরা বুঝে নেইনি। সেনাবাহিনী ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা ব্যাংকের শাখাগুলো নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন।'

অগ্নিকাণ্ডে নিহত অনিতা রায় চিতলমারী উপজেলার শিবপুর-কাটাখালী এলাকার দেবদাসের স্ত্রী। তিনি দীর্ঘদিন ধরে ডা. তাপস পোদ্দারের গৃহপরিচালিকা হিসেবে কাজ করতেন।

এমআরএম ফ্যাশনের মালিকের দুলাভাই শামীম শেখ বলেন, 'উপজেলার সব থেকে বড় পোশাক ও জুতার শোরুম ছিল এটি। এখানে আমাদের প্রায় ২০ কোটি টাকার বিনিয়োগ ছিল। এই শোরুমের আয় থেকে আমাদের কয়েকটি পরিবার চলত। আগুনে আমাদের সব শেষ হয়ে গেছে। আমরা নিঃস্ব হয়ে গেলাম।'

এই ভবনের আন্ডারগ্রাউন্ডে আরএফএলের শোরুম, প্রথম তলায় এমআরএম ফ্যাশন হাউজসহ কয়েকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, দ্বিতীয় তলায় সোনালী ব্যাংক, কৃষি ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া, আইএফআইসিসহ চারটি ব্যাংকের শাখা, একটি বিমা কোম্পানির অফিস, তৃতীয় তলায় সুস্বাস্থ্য ও পরিচর্যা নামের একটি বেসরকারি ক্লিনিক, চতুর্থ ও পঞ্চম তলায় ছিল বাসা-বাড়ি।

এই ভবনের মালিক প্রবাসী মোঃ আনিসুর রহমান থাকেন ব্রুনাইয়ে। আনিসুর রহমানের বোন রুমানা আক্তার বলেন, 'এই ভবনই আমাদের একমাত্র সম্বল। আমাদের সব স্বপ্ন ছিল এই ভবনকে ঘিরে। ফ্যাশন হাউজ পুড়ল, অনেকে আহত হয়েছে। ভাইয়া আগুনের খবরে বিদেশে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।' এমন বিপদে যেন কেউ না পড়ে বলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন তিনি।

চিতলমারী উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. শর্মী রায় জানান, 'আগুনে আহতদের মধ্যে ৪৪ জন চিকিৎসা নিয়েছেন চিতলমারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। এদের মধ্যে ৪ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।'

হাসপাতালে চিকিৎসাধীন স্থানীয় সবুর মিয়া বলেন, 'আগুনের খবর পেয়ে আমরা সবাই ছুটে যাই। ক্লিনিকে ভর্তি রোগীদের উদ্ধারের চেষ্টা করেছি। অনেককে সিঁড়ি দিয়ে নামিয়েছি, আবার রং করার জন্য একটি সিঁড়ি ছিল, সেটি দিয়েও অনেককে নামিয়েছি। কয়েকজনকে নামানোর পরে আমি নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়ি। এখন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছি।' 

এদিকে আগুন নেভানোর সুবিধার্থে ৯টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত ভবনের সামনের চিতলমারী প্রধান সড়কটি বন্ধ ছিল। এছাড়া আগুনের খবরে উপজেলা সদরের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। পৌনে ৫টায় বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক করে পল্লী বিদ্যুৎ।

চিতলমারী থানার ওসি এস এম শাহদাৎ হোসেন জানান, 'চার তলার সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় মারা যাওয়া নারীর মরদেহ হাসপাতালে রয়েছে। তারা জেলা প্রশাসকের কাছে ময়নাতদন্ত ছাড়াই মরদেহ হস্তান্তরের আবেদন করেছেন। সেখান থেকে যে সিদ্ধান্ত আসবে সে অনুযায়ী, আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করব।'

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স খুলনা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মতিয়ার রহমান জানান, 'আগুন নেভাতে খুলনা, বাগেরহাট ও গোপালগঞ্জের আটটি ইউনিট ৪ ঘণ্টা পানি ছিটিয়ে দুপুরের দিকে আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে এনেছে। ভবনের নিচতলার একটি পোশাকের দোকান থেকে বিদ্যুতের শর্ট সার্কিট থেকে আগুন লেগেছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে।'

বাগেরহাট সেনা ক্যাম্পের ক্যাপ্টেন মো. রায়হান জানান, 'আগুনে ভবনে থাকা ক্লিনিকে ভর্তি রোগী এবং আবাসিকে কিছু মানুষ আটকে পড়ে। সেনা সদস্যরা তাদের নিরাপদে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। সব মিলিয়ে অন্তত ৮০ জনকে আমরা নিরাপদে সরিয়ে এনেছি। এর মধ্যে যারা অসুস্থ ছিলেন তাদের হাসপাতালে ভর্তি করেছি।'

বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক আহমেদ কামরুল আহসান বলেন, 'আমি ঘটনাস্থলে রয়েছি। আগুন এখন নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ব্যাংকগুলো মোটামুটি অক্ষত আছে। এক নারীর মৃত্যু হয়েছে, এটা ধোঁয়ার কারণে হতে পারে। আগুন নির্বাপণ ও উদ্ধার কাজে সেনাবাহিনী, পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও স্থানীয় বাসিন্দারা কাজ করছে। প্রাথমিকভাবে আগুন লাগার প্রকৃত কারণ ও ক্ষয়ক্ষতির সঠিক পরিমাণ নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে কাজ চলছে।'

রাকিব

×