
ছবি: সংগৃহীত
আনসার হাওলাদার রিকশা চালাতেন, গরু পালতেন-সব বিক্রি করে ছেলের চিকিৎসা করিয়েছেন। সেই ছেলে হৃদয়, যে একদিন দেশের জন্য নিজের জীবনটা দিয়ে দিলো, আজ তার নিথর দেহ পড়ে রইল গ্রামের স্কুল মাঠে। জানাজায় ছিল না কোনো রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধি, ছিল না প্রশাসনের কেউ, ছিল না ঢাকায় কোনো বিদায়ী শ্রদ্ধা। ফেসবুকে অভ্যুত্থানের যোদ্ধাদের কোনো শোরগোল দেখা গেল না। জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশনের কোটি টাকার গল্প শুধু গল্পই থেকে গেল, সেই টাকা দিয়ে হৃদয়রা চিকিৎসার মুখ দেখতে পারলো না।
বাবার কাঁধে সন্তানের লাশ-পৃথিবীর সবচেয়ে ভারী জিনিস। জানাজা শেষে অচেতন হয়ে পড়লেন আনসার হাওলাদার। শোক আর গর্বের এক মিশ্র গাঢ় রক্তিম ছবি এঁকে গেলো সেই সকালটা।
জুলাই অভ্যুত্থানের নামে যারা আজ নেতৃত্বের মঞ্চে, শত গাড়ির বহরে, কোটি টাকার মালিক-তাদের অনেকেই একদিন ধার করে চলতেন। অথচ যারা জীবন দিয়েছে, যারা রক্ত দিয়েছে, তাদের জায়গা হলো কেবল গ্রামে একটা নির্জন কবর। এটাই কি নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত? শহীদদের নেই রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি, নেই পারিবারিক নিরাপত্তা, নেই ন্যায্য সম্মান। শুধু কিছু ‘লাভবান’ মুখ জিতে নেয় সব ইতিহাসের কৃতিত্ব। বুক চিতিয়ে যারা সামনে দাঁড়িয়েছিল, তারা আজ বিস্মৃত; আর জুলাইয়ের রক্তের দাগ না শুকাতেই তারা আজ নেতৃত্বে। তাঁরা পিচঢালা পথে রাজনৈতিক দলের স্লোগান দিতে ব্যস্ত।
সামনে নির্বাচন হবে, ভোট পেতে হবে মানুষের। তার জন্য মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরছে তাঁরা। অথচ তাঁরা এটা জানে না যে শুধুমাত্র হাসপাতালের বারান্দায়ও যদি তাঁরা পড়ে থাকতো, তাহলে এতদিনে মানুষই তাঁদেরকে ডেকে বলতো "তোমরা নির্বাচনে আসো" মানুষ ব্যস্ত হয়ে যেতো নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত দেখার জন্য। কিন্তু যে অপরিসীম দেশপ্রেম এবং সাহস নিয়ে তাঁদের লড়াইটা শুরু হয়েছিল, তা থেকে এখন দূরে সরে গেছে সবাই। ক্ষমতার স্বাদ পেতে শুরু করেছে, ক্ষমতার স্বাদকে দীর্ঘায়িত করতে মরিয়া অনেকেই।
বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও কেন যেন ভুল পথে হাটছে। যে অভ্যুত্থানের রক্ত মাড়িয়ে এই সরকারের সূচনা হয়েছিল। সেই ম্যান্ডেটটা সরকার একদমই ভুলে গেছে। সরকার আওয়ামী লীগ দমনে জিরো টলারেন্স দেখাবে বলে ধারণা করেছিলাম কিন্তু আওয়ামী লীগের লোকেরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে, মিছিল করতে সাহস পাচ্ছে। এই সরকারের নমনীয়তা তাদেরকে এই সুযোগ দিয়েছে। এই সরকার আহতদের চিকিৎসা ও নিহত পরিবারের সহায়তাও সঠিকভাবে করে উঠতে পারেনি।
সরকার কেন যেন উন্নয়নের দিকে নজর দিচ্ছে। সরকারের উন্নয়নের গল্প বলার জন্য কিছু মানুষও ইতিমধ্যে তৈরি হয়ে গেছে।
রাজনৈতিক দলগুলোরও অবশ্যই এই বিষয়ে অনেক দায়িত্ব আছে। দায়িত্ব অনেকেই পালন করেও যাচ্ছে। কিন্তু আমাদের অভ্যুত্থানের যোদ্ধারা এভাবে তাঁদের পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে যাবে তা আশা করিনি। এটা আমাদের দেশীয় রাজনৈতিক পরিবেশের একটা চরম উদাহরণ। এভাবে তাঁদের এত দ্রুতই স্খলন হতে থাকবে তা আমরা আশা করিনি। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন নামে যে প্লাটফর্ম, তারা কিন্তু চাইলেই শহীদ পরিবার আর আহত যোদ্ধাদের নিয়েই সারাদিন মনে থাকতে পারতো। কিন্তু তাঁরা নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের কথা বলে শুধু করে দিয়েছে পুরাতন বন্দোবস্তই!
হৃদয়রা কি শুধু রাজনৈতিক দলের ভিত্তিপ্রস্তর হবার জন্য জন্মায়? তারা কি এভাবে বিস্মৃত হবার জন্য জীবন দেয়? আল্লাহ, তাঁর বাবাকে সেই সহ্যশক্তি দাও, যা সন্তানের লাশ বয়ে নেওয়ার মতো কঠিন শোক সইতে পারে। হৃদয়, তোমার রক্ত একদিন এই মাটি মনে রাখবে তো? নাকি ইতিহাসের পাতায় তোমার নামটুকু মুছে দেবে কারও রাজনৈতিক জয়ের উল্লাস?
মেহেদী হাসান