ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ০৭ এপ্রিল ২০২৫, ২৪ চৈত্র ১৪৩১

কবিয়াল সম্রাট রমেশ শীল এর প্রয়াণ দিবসে অতল শ্রদ্ধা

শরিফুল রোমান,মুকসুদপুর,গোপালগঞ্জ

প্রকাশিত: ১৮:৩৪, ৬ এপ্রিল ২০২৫

কবিয়াল সম্রাট রমেশ শীল এর প্রয়াণ দিবসে অতল শ্রদ্ধা

ছবি: সংগৃহীত

রমেশ শীল বা কবিয়াল রমেশ  শীল বা রমেশ মাইজভান্ডারী বাংলা কবিগানের অন্যতম রূপকার কবিয়াল সম্রাট। কবিগানের লোকায়ত ঐতিহ্যের সাথে আধুনিক সমাজ সচেতনতার সার্থক মেলবন্ধন ঘটিয়ে তিনি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন।

তিনি ছিলেন মাইজভান্ডারী গানের কিংবদন্তি সাধক। জনপ্রিয় এই গণসঙ্গীত শিল্পী ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনে এবং সেই সাথে ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন পরবর্তী নুরুল আমিন বিরোধী আন্দোলনে তিনি প্রত্যক্ষভাবে অংশ নেন। যা আজও ইতিহাস হয়ে রয়েছে।

১৮৯৭ সালের কথা। চট্টগ্রামের মাঝিরঘাটে কবিগান পাগল বন্ধুদের সাথে জগদ্ধাত্রী পূজায় গান শুনতে গিয়েছিলেন বালক রমেশ শীল। দুই প্রবীণ কবিয়াল মোহন বাঁশি চিন্তাহরণের কবিগানের আসর। আসরে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন কবিয়াল চিন্তাহরণ। গলা বসে গেল, পদ আর শোনা যায় না। তখন মাইকের ব্যবহার ছিল না। শ্রোতাদের মধ্যে দেখা দেয় চরম উত্তেজনা প্রচন্ড বিশৃঙ্খলা।

আয়োজকরা ঘোষণা দিলেন, আসরে কোনো কবি থাকলে মঞ্চে আসার জন্য। বন্ধুরা মিলে জোর করেই রমেশ শীলকে উঠিয়ে দিলেন আসরে।

ভয়ে কাঁপা পায়ে আসরে উঠলেন রমেশ শীল। পরিচয় পর্বে প্রতিপক্ষ প্রবীণ-কেঁন্সসুলি মোহন বাঁশি পুঁচকে ছোঁড়া, নাপিত বলে অশোভন ভাষায় আক্রমণ শুরু করেন রমেশ শীলকে।

উত্তরে রমেশ শীলের প্রথম পদ ছিল- ‘উৎসাহ আর ভয়,লজ্জাও কম নয়,কেবা থামাইবে কারে? পুঁচকে ছোঁড়া সত্য মানি, শিশু ধ্রুব ছিল জ্ঞানী,চেনা-জানা হোক না এই আসরে

শুরু হল লড়াই। প্রবীণ-বিজ্ঞ মোহন বাঁশির সাথে জীবনের প্রথম কবিগানেই লড়াই চলল একটানা ১৮ ঘণ্টা। কেউ কাউকে হারাতে পারছেন না। শেষতক আপোষ জোঁকের ব্যবস্থা করলেন আয়োজকেরা।

গান শুনতে গিয়ে ২১ বছর বয়সেই রমেশ হয়ে গেলেন কবিয়াল। তাঁর পরিচয় হলনতুন কবির সরকার’। কবিগান পাগল রমেশ শীল পরে হয়ে উঠলেন কবিগানের সম্রাট বঙ্গের সেরা কবিয়াল।

১৮৭৭ সালের মে চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলায় শীলপাড়ার অতিসাধারণ এক হীন-গরিব ঘরে রমেশ শীলের জন্ম। ১১ বছর বয়সে তৃতীয় শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় পিতৃহারা হন। তাঁর উপর নেমে আসে পরিবারের ছয় সদস্যের ভার।

জীবিকার তাগিদে চলে যান বার্মায় (মিয়ানমার) কিন্তু তাঁর মন-প্রাণে মিশে আছে যে বাংলার সোঁদা গন্ধ। তাই, ১৮ বছর বয়সে ফিরে আসেন মাতৃভূমিতে।

জীবিকার প্রয়োজনে রমেশ শীলকে পেশা হিসেবে তাঁকে বেছে নিতে হয়েছে পৈতৃক পেশা ক্ষৌরকর্ম, স্বর্ণশিল্পী, মুদি-চালের গুদামে চাকরি, শল্য-কবিরাজি-হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা, কবিগান গণসংস্কৃতি চর্চা।

রমেশ শীল আজীবন গেয়েছেন- এদেশের মাটি মানুষের জয়গান। দেশের প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে তাঁর কথা, সুর, গান লেখনি ছিল রণতূর্যের মতো। কণ্ঠ ছিল রুদ্রবীণা, আগ্নেয়গিরির মতো।

১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা আন্দোলনে পাক-হানাদার বাহিনী এদেশীয় দোসরেরা তাঁর বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দেয়। তাঁর অনেক কবিতা, গান, লেখা সৃষ্টি পুড়িয়ে ধ্বংস করে ফেলে। আজও তাঁর অসংখ্য সৃষ্টিকর্ম অযত্নেঅবহেলায় বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে। দেশ স্বাধীনতার পড়ে সরকারের ঊর্ধ্বতন মহল থেকে রমেশ সমাধিকে বেশ কয়েকবার কমপ্লেক্স করার ঘোষণা দেয়া হলেও সেই ঘোষণা আজও বাস্তবায়িত হয়নি।

১৯৯৩ সালে বাংলা একাডেমি ৫৩৫ পৃষ্ঠাররমেশ শীল রচনাবলীপ্রকাশ করে। ২০০২ সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে একুশে পদকে ভূষিত করেন। বাংলাদেশের কবিয়াল সম্রাট-লোককবি রমেশ শীল ১৯৬৭ সালের এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেন।

আজ বাংলাদেশের বিখ্যাত কবিয়াল সম্রাট রমেশ শীল এর প্রয়াণ দিবসে অতল শ্রদ্ধা।

মেহেদী হাসান

×