ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৩ এপ্রিল ২০২৫, ১৯ চৈত্র ১৪৩১

আব্দুল্লাহ ইবনে মাসুদের বয়স এখন ১১ বছর!

নিজস্ব সংবাদদাতা, বাউফল 

প্রকাশিত: ০০:৩৭, ২ এপ্রিল ২০২৫

আব্দুল্লাহ ইবনে মাসুদের বয়স এখন ১১ বছর!

ছবিঃ ড.শফিকুল ইসলাম মাসুদকে দেখতে তার সাত দিনের সন্তানকে নিয়ে গিয়েছিলেন স্ত্রী ডা. জাকিয়া ফারহানা

নুমায়ির বয়স এখন ১১ বছর। যখন মায়ের কোলে চড়ে বাবাকে জেল হাজতে দেখতে গিয়েছিলেন তখন তার বয়স ছিল ৭ দিন। নুমায়ির পুরো নাম আব্দুলাহ ইবনে মাসুদ।

বর্তমানে নুমায়ির তার বাবা বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সেক্রেটারি ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদের সাথে পবিত্র  কাবা শরীফে রয়েছেন। ওমরা হজ্ব করেছেন।

২০১৪ সালে তাকে নিয়ে একটি আবেগঘন লেখা লিখে ছিলেন বাংলাদেশ ছাত্র শিবিরে কেন্দ্রীয় কমিটির তৎকালীন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক  মো. সিরাজুল ইসলাম। 

তার এ লেখাটি পাঠকের জন্য হুবহু তুলে ধরা হলো।

আমার ডাক নাম নুমায়ির। আমার বয়স মাত্র ৭ দিন। বাবা আমার নাম না রাখতে পারলেও আমার একটি নাম দেয়া হয়েছে- আব্দুল্লাহ ইবনে মাসুদ। প্রখ্যাত সাহাবীর নামেই আমার এ নাম। মাসুদ আমার বাবা। আমি উনাকে দেখেছিলাম না। আজ দেখেছি। সাধারণত ছেলে সন্তান জন্মের পরে সন্তানের কানের পাশে নাকি আযান দেয়া হয়। সচরাচর পিতাই আনন্দে আবেগাপ্লুত হয়ে আযান দিয়ে থাকেন। আমার বাবাও সেরকমই স্বপ্ন দেখেছিলেন। কিন্তু পারেননি। কারণ উনি বাসায় ছিলেন না।

এক দিন, দুই দিন করে করে ছয়টি দিন পার হয়ে গেল। কিন্তু বাবা আসছিলেন না। অনেকেই বাসায় আসলেন। আমাকে কোলে নিলেন। আমাকে সবাই কেন যেন একটু বেশী করে আদর করছেন। কিন্তু জানেন, আমার সব আদরের পরেও কেন যেন একটি অতৃপ্তি কাজ করছিল। কি সেটা আমি বুঝতে পারছিলাম না। আমি ছোট তো, তাই কাউকে জিজ্ঞাসাও করতে পারছিলাম না।

সবাই আমার ছবি তুললেন। আদর করে ফেসবুকেও আমার ছবি পোস্ট করলেন চাচ্চুরা, খালামনিরা। যারা আমাদের বাসায় আসতে পারেননি, তারাও আমাকে দেখলেন। কমেন্টে অনেকেই অনেক দোয়া করেছেন। অনেকে নাকি আমাকে দেখে চোখের পানিও ফেলেছেন। আল্লাহর কাছে আমার জন্য অনেক দোয়া করেছেন।

আজ এক সপ্তাহ পরে মামনি আমাকে নিয়ে বাইরে গেলেন। ঘিঞ্জি রাস্তা দিয়ে চলতে চলতে এক সময় একটি বড় দালানের কাছে পৌঁছলাম আমরা। কী জানি কোথায় যাচ্ছি আমরা! তবে এক ধরনের অজানা ভাল লাগা আমার মধ্যে কাজ করছিল। আমিতো আসলে জানিনা, আমরা কোথায় যাচ্ছি। 

শেষ পর্যন্ত আমরা ভেতরে গেলাম। কিছুক্ষণ পরে লোহার শিকের ওপাশ থেকে একজন আমাকে ডাকলেন। আমি আধো আধো চোখ খুলে তাকালাম। খুব নজর করে খেয়াল করলাম। প্রথম দেখাতেই খুব ভাল লাগল। এক ধরনের অনুভূতি খেলা করে গেল ভেতরে। খেয়াল করলাম- উনার চোখের পানি বের হতে চাচ্ছে। কিন্তু উনি দৃঢ়তার সাথে তা আটকে রাখতে চাইছেন। মা আমাকে উচু করে ধরলেন। বললেন- দেখ, বাবাকে। আমার মনে পড়ে গেল এ কোলের জন্যই তো আমার অপেক্ষা ছিল। ইনিই আমার বাবা! বাবা, আমিতো তোমার জন্যেই অপেক্ষা করছি ক’দিন ধরে। আমি ভাবলাম, এবার বাবা আমাকে কোলে নেবেন। অতৃপ্তি বোধ হয় কিছুটা মিটবে। আমি অপেক্ষা করলাম। 

কিন্তু জানেন, বাবা আমাকে কোলে নিলেন না। কিভাবে নেবেন, কালো শিকের কারণে বোধহয় আসতে পারছেন না। বলতে চাইলাম, বাবা শিকের এপাশে আসো। আমিতো তোমার জন্য হাত বাড়িয়ে আছি...

বাবা এবার আর পারলেন না। শব্দ করে ডুকরে কেঁদে ফেললেন। মায়ের চোখের দিকে তাকিয়ে দেখি, উনার চোখেও পানি। আর বোন নামিরার দিকে খেয়াল করলাম। না, ও কিছু বুঝছেনা। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। একবার বাবার দিকে, একবার মায়ের দিকে আরেকবার আমার দিকে তাকাচ্ছে। 

কালো শিকগুলো ধরে ও শুধু ঝাকাচ্ছে। ওর বয়সও তো বেশী না। তাই শিকগুলো ও ভাংতে পারছেনা। আমি আরেকটু বড় হলে এ শিক ভেঙ্গে বাবার কাছে যেতাম। আমি বাবার চোখের পানি মুছে দিতে চাইলাম। কিন্তু আমার হাত তো ছোট। শিক পার হবেনা। তাই, বাবাই পরক্ষনে চোখ মুছে আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসলেন... বাবার হাসিটা না খুব মিষ্টি!
বাবা হাত বাড়ালেন। আমার মাথায় হাত বুলালেন। কী পরম তৃপ্তি বাবার হাতের স্পর্শে...। 

বাবা আমার দিকে তাকিয়ে আমাকে কিছু কথা বললেন। সে কথাগুলো বোধহয় বাবার এতোদিনের সংরক্ষিত অনুভূতির ফসল। উনি বললেন- "দেখে রাখ জালিমের জেলখানা, আসতে হতে পারে তোমারও, এই আন্দোলনের ডাকে সারা দিয়ে"। আমি বলতে চাইলাম- বাবা, তুমি শুধু দোয়া কর। তোমার এ আন্দোলনের পথে যেন আমিও যথাযথভাবে পা বাড়াতে পাড়ি। আমার নামের স্বার্থকতা যেন আমি রাখতে পারি। তোমার মত সাহসী যেন হতে পারি, বাবা।

চলে এলাম বাবার আদেশ মিশ্রিত নির্দেশনাকে বুকে ধারন করে। সবার কাছে দোয়া চাইছি। আমি যেন ধৈর্য ধারন করতে পারি। আর বাবা যেন খুব দ্রুত আমার কাছে চলে আসতে পারেন।

(নুমায়িরের অনুভূতি হয়তবা এমনই হবে। মাসুদ ভাইয়ের সাথে জেলখানায় তাঁর সন্তানের সাক্ষাতের ছবিটি দেখে খুব আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছি। কল্পনা করতে চেষ্টা করলাম সদ্যজাত এ নুমায়িরের অনুভূতির ব্যাপারে। সে কল্পনাকেই লিখতে চেষ্টা করেছি মাত্র।

ইমরান

×