ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০১ এপ্রিল ২০২৫, ১৮ চৈত্র ১৪৩১

চুরি ডাকাতি ছিনতাই চাঁদাবাজি রোধে ব্যবস্থা গ্রহণ

ঈদের ছুটিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ব্যাপক প্রস্তুতি

শংকর কুমার দে

প্রকাশিত: ০০:২২, ৩০ মার্চ ২০২৫

ঈদের ছুটিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ব্যাপক প্রস্তুতি

আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ব্যাপক প্রস্তুতি

আসন্ন ঈদুল ফিতর উপলক্ষে টানা নয় দিনের ছুটিতে মানুষজনের জানমালের নিরাপত্তা বিষয়ে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক রাখার বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব¡সহকারে বিবেচনায় নিয়ে ব্যাপক পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে সরকার। রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকা- রোধে সেনাবাহিনী-বিজিবি-পুলিশ ও র‌্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

এবার ঈদকেন্দ্রিক নিরাপত্তায় সর্বোচ্চসংখ্যক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকবে বলে জানিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর। ঈদকে সামনে রেখে সারাদেশে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারসহ গোয়েন্দা নজরদারি করাসহ ১১ দফা নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। সারাদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সার্বক্ষণিক মনিটরিং করা হবে। এর জন্য খোলা হয়েছে কন্ট্রোলরুম। রাজধানীতে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই প্রতিরোধে পুলিশি টহল ও চেকপোস্ট বৃদ্ধি করা হয়েছে।

র‌্যাবের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়েছে বিশেষ নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা। ঈদে মানুষের নিরাপত্তায় গোয়েন্দা কার্যক্রম ও টহল জোরদার করা হয়েছে। এ সময় ইউনিফর্মের পাশাপাশি সাদা পোশাকে র‌্যাব গোয়েন্দা বিভাগের সদস্যরা তৎপর থাকবে। ঈদে নিরাপত্তায় গোয়েন্দা, ফুট প্যাট্রল, মোবাইল প্যাট্রল, সাইবার ওয়ার্ল্ডের নজরদারির উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে এ খবর জানা গেছে।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানান, বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হচ্ছে ঈদের ছুটি। ঈদের ছুটিতে দেড় কোটি থেকে প্রায় দুই কোটি মানুষ রাজধানী ছাড়তে পারেন। ঈদের ছুটির সময়ে রাজধানী ঢাকা ফাঁকা হয়ে যায়। চুরি-ডাকাতি ও ছিনতাই বেড়ে যায়। লম্বা ছুটিতে ঘরমুখী মানুষ নানা প্রতারণা ও অপরাধের শিকার হয়। নিরাত্তা নিয়ে শঙ্কা দেখা দেয়।

সারা দেশেই আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা মোকাবিলার বিষয়টি রীতিমতো চ্যালেঞ্জ। মানুষজনের নিরাপত্তা ব্যবস্থার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ঈদের ছুটিতে সেনা বাহিনী, বিজিবি-পুলিশ ও র‌্যাবের টহল বৃদ্ধিসহ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানান, আসন্ন ঈদুল ফিতর উপলক্ষে ঘরমুখো মানুষের যাতায়াত নিরাপদ ও স্বাচ্ছন্দ্যময় করাসহ সার্বিক আইনশৃঙ্খলা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে যেসব নির্দেশনাসমূহ দেওয়া হয়েছে তা বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রাজনৈতিক-২ শাখার সিনিয়র সহকারী সচিব মো. জিয়াউল হক মীর স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এই অনুরোধ জানানো হয়েছে।

নির্দেশনায় বলা হয়েছে, আসন্ন ঈদুল ফিতরের প্রাক্কালে দেশব্যাপী সার্বিক আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক রাখার বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করতে হবে। চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকা- রোধে ইউনিফর্মধারী পুলিশের পাশাপাশি গোয়েন্দা সংস্থার সদস্য মোতায়েন, বিশেষ বিশেষ রাস্তায় ও মোড়ে চেকপোস্ট স্থাপন, টাকা স্থানান্তরে মানি এস্কর্ট প্রদান, জাল টাকার বিস্তার রোধ ও শনাক্তকরণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে।

রাজধানীর কূটনৈতিক এলাকা, গুরুত্বপূর্ণ স্থানসহ দেশের অন্যান্য বড় বড় শহর ও বন্দরে সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ ও র‌্যাবের টহল বৃদ্ধি করতে হবে। গার্মেন্টস ও অন্যান্য শিল্পের মালিক পক্ষ অর্থাৎ বিজিএমইএ, বিকেএমইএ এবং শিল্প পুলিশ একত্রে বসে ঈদের পূর্বেই শ্রমিকদের বেতন-ভাতাদি, বোনাস ইত্যাদি পরিশোধের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য অনুরোধ জানানো হচ্ছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় বলা হয়েছে, সাধারণ জনগণের ঈদ উপলক্ষে নির্বিঘেœ কেনাকাটা নিশ্চিত করতে পোশাকধারী পুলিশের পাশাপাশি নারী পুলিশ ও সাদা পোশাকে পুলিশ সদস্য মোতায়েন করতে হবে। মার্কেটগুলোতে বিশেষ রাত্রিকালীন নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে এবং সব মার্কেট সিসি ক্যামেরার আওতায় আনার ব্যবস্থা করতে হবে।

ঈদ উপলক্ষে ঘরমুখো মানুষের যাতায়াত নিরাপদ নিশ্চিতকল্পে বাস, ট্রেন ও লঞ্চে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় না করা, লঞ্চ, ফেরি ঘাটসমূহে অনিয়ম ও অবৈধ সিরিয়াল প্রদানের মাধ্যমে অতিরিক্ত টাকা আদায় না করা, অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন না করা এবং পরিবহনে চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে অনুরোধ জানানো হচ্ছে। পবিত্র ঈদুল ফিতরকে কেন্দ্র করে রাজধানীসহ সারাদেশে যানজট নিরসনের লক্ষ্যে যথাযথ ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
যমুনা সেতু, পদ্মা সেতু এবং ফ্লাইওভারসহ টোলপ্লজাসমূহে যানজট নিরসনে ইটিসিসহ (ইলেক্ট্রনিক টোল কালেকশন) দ্রুত টোল আদায়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। যানজট নিরসনে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ কর্তৃক চিহ্নিত ১৫৫ স্পটে আইপি, সিসি ক্যামেরা স্থাপনপূর্বক ঈদুল ফিতরের পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী সময় মনিটরিং জোরদার করতে হবে।

প্রয়োজনে অধিক গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ড্রোনের মাধ্যমে মনিটরিং করার জন্য অনুরোধ জানানো হচ্ছে। যানজট নিরসনে লক্ষ্যে ঈদের পূর্বের ৭ দিন ও পরের ৭ দিন সুনির্দিষ্ট পূর্ব তথ্য ব্যতীত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক সড়কের ওপরে মোটরযান তথা যানবাহন থামানো যাবে না।
অত্যাবশ্যকীয় পণ্য পরিবহনকারী বা যাত্রীবাহী যানবাহন ব্যতীত স্থলবন্দর ও নৌবন্দরসহ যেকোনো জায়গা থেকে ছেড়ে আসা নির্মাণ সামগ্রী বহনকারী ও লম্বা যানবাহনসমূহ ঈদের পূর্বের ৩ দিন এবং পরের ৩ দিন যেন মহাসড়কে চলাচল করতে না পারে বা নৌ-রুটে ফেরি পারাপার করতে না পারে সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

ঈদের আগে ৫ দিন ও পরে ৫ দিন নদীতে বাল্কহেড চলাচল বন্ধ রাখতে হবে। বিভিন্ন সড়ক, মহাসড়ক ও নৌ-পথে আকস্মিক দুর্ঘটনায় উদ্ধারকার্য পরিচালনায় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের টিম, রেসকিউ বোট, ডুবুরি, অগ্নিনির্বাপণ সরঞ্জামাদিসহ অ্যাম্বুলেন্স প্রস্তুত রাখার জন্য নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। প্রয়োজনে কোস্টগার্ডের সহযোগিতা গ্রহণ করতে হবে।

দুর্ঘটনা কবলিত অথবা রাস্তা ও ব্রিজে কোনো গাড়ি নষ্ট হলে দ্রুত দুর্ঘটনা কবলিত ও অকেজো গাড়ি অপসারণ ও রেকারিং করে পার্শ্ববর্তী খালি জায়গায় স্থানান্তর করতে হবে। যমুনা ও পদ্মা সেতুসহ যানজট প্রবণ এলাকায় প্রয়োজনীয়সংখ্যক রেকারের ব্যবস্থা রাখতে হবে। ঈদের সময় সার্বিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষার পাশাপাশি সড়কের শৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশ অধিদপ্তর এবং অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক কন্ট্রোলরুম স্থাপন করতে হবে।

সকল কন্ট্রোল রুমকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কেন্দ্রীয় জয়েন্ট অপারেশন সেন্টারের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতে হবে। জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ এর সাথে কন্ট্রোল রুমের সংযোগ স্থাপনপূর্বক সড়কের শৃঙ্খলা রক্ষায় সমন্বয় জোরদার করতে হবে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. নাসিমুল গনি সচিবালয়ে সংবাদ ব্রিফিংয়ে বলেছেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আগের চেয়ে আরও অনেক উন্নতি হয়েছে। তবে ঈদকে সামনে রেখে সারাদেশে নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সার্বক্ষণিক মনিটরিং করার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা নিয়োজিত রয়েছেন।
যাত্রী  কল্যাণ সমিতির মতে, এবার ঢাকা ও ঢাকার আশপাশের জেলা থেকে কমপক্ষে দেড় কোটি মানুষ ঈদের সময় যার যার এলাকায় যাবেন। লম্বা ছুটি হওয়ার কারণে এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। এই ঈদে শুধু ঢাকা নয়, সারাদেশেই আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ আছে। 
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী জানিয়েছেন, মহাসড়কের নিরাপত্তা এবার নড়বড়ে। মহাসড়কে এমনিতেই ডাকাতি হচ্ছে। পর্যাপ্ত নিরাপত্তা না থাকলে একার ডাকাতের কবলে পড়ার আশঙ্কা আছে। আর লম্বা ছুটির কারণে ঢাকা থেকে ধাপে ধাপে মানুষ ঢাকার বাইরে যাবে।

যেভাবে ছিনতাই হচ্ছে তাতে ঈদের ঘরমুখী মানুষ বাসা থেকে বাস, রেল বা লঞ্চ স্টেশন পর্যন্ত নিরাপদে যেতে পারেন কী না তাও আশঙ্কার বিষয়। এর বাইরে ঈদের সময় অজ্ঞান পার্টি, প্রতারক দল, টানা পার্টি, মলম পার্টিসহ নানা ধরনের অপরাধীরা সক্রিয় থাকে।       
ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী বলেছেন, জোর তৎপরতায় রাজধানীর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অনেকটাই উন্নতি হয়েছে। ডিএমপি সদর দপ্তরে সমন্বয় সভায় তিনি বলেছেন, পুলিশি তৎপরতায় ছিনতাই ও চাঁদাবাজির মতো ঘটনা অনেকাংশে কমে গেছে। ঢাকার সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, যাত্রীদের যাতায়াত নির্বিঘœ রাখা, সুষ্ঠুভাবে ঈদের নামাজ সম্পন্ন করা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে সভা করা হয়েছে। 
ঢাকা মহানগর পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, রাজধানীতে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে চুরি, ছিনতাই ও ডাকাতি প্রতিরোধে পুলিশি টহল ও চেকপোস্ট বৃদ্ধি করেছে। র‌্যাবের পক্ষ থেকেও নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ঈদে মানুষের নিরাপত্তায় গোয়েন্দা কার্যক্রম ও টহল জোরদার করা হয়েছে। এ সময় ইউনিফর্মের পাশাপাশি সাদা পোশাকে র‌্যাব গোয়েন্দা বিভাগের সদস্যরা তৎপর থাকবে। র‌্যাব জানিয়েছে, ঈদে নিরাপত্তায় গোয়েন্দা, ফুট প্যাট্রল, মোবাইল প্যাট্রল, সাইবার ওয়ার্ল্ডের নজরদারি থাকবে।
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর বলেছেন, ঈদকে সামনে রেখে পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট হাইওয়ে পুলিশ, শিল্প পুলিশ ও রেলওয়ে পুলিশকে বিশেষভাবে সক্রিয় করা হয়েছে। সারাদেশেই গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।

মহাসড়কে ডাকাতি রোধে বিশেষভাবে নজর দেওয়া হচ্ছে। আর চুরি, ডাকাতি ও ছিনতাই প্রতিরোধেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। যাত্রী ও জনগণকে সতর্ক করা হচ্ছে। একই সঙ্গে এই সময়ে প্রতারক চক্র অনেক বেশি সক্রিয় হয়। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য পুলিশের বিশেষ নজর রাখার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

×