
নাড়ির টানে বাড়ি ফিরছে মানুষ। গ্রামের বাড়িতে পরিবারের সঙ্গে ঈদ উদ্যাপনে বাড়ির পথে সাধারণ মানুষ
ঈদ যত ঘনিয়ে আসছে মহাসড়কে বাড়ছে যানবাহনের চাপ। তবে গত কয়েক বছরের তুলনায় এবার ঈদযাত্রার চিত্র অনেকটাই ভিন্ন। ঢাকা থেকে উত্তরের পথে যানবাহনের চাপ থাকলেও নেই যানজট। এ ছাড়া কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন এবং সদরঘাট নৌ টার্মিনাল থেকে যাত্রীরা নির্দিষ্ট গন্তব্যে এবার স্বস্তিতে ঘরে ফিরতে পারছেন।
প্রশাসনের কঠোর নিরাপত্তা ও প্রযুক্তির সঠিক প্রয়োগ এবার উত্তরের পথে ঈদযাত্রায় ঘরমুখো মানুষকে স্বস্তি দিচ্ছে বলে জানা গেছে। সেনাবাহিনী, র্যাব, হাইওয়ে পুলিশ ও এপিবিএন সদস্যরা রাতদিন মহাসড়কে নিরাপত্তা দিচ্ছেন। ব্যবহার করা হচ্ছে ড্রোন ও সিসিটিভি ক্যামেরা। মহাসড়কের পাশে বসানো হয়েছে ওয়াচ টাওয়ার। প্রস্তুত রাখা হয়েছে অ্যাম্বুলেন্স, রেকার ও ফায়ার সার্ভিস। যমুনা সেতুতে বাড়ানো হয়েছে লেন।
যানবাহনের চাপ বাড়ায় সেতুর আয়ও বেড়েছে কয়েকগুণ। এদিকে, সাধারণ জনগণ এবার স্বস্তিতে ও নির্বিঘেœ ঈদযাত্রা করতে পারছে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী (অব.)। শনিবার দুপুরে রাজধানীর গাবতলী বাস টার্মিনাল পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে তিনি এ কথা জানান। উপদেষ্টা বলেন, সরকারের বিভিন্ন জনমুখী উদ্যোগ ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার কারণে জনগণ এবার স্বস্তিতে ঈদযাত্রা করতে পারছে।
তিনি বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে আমরা সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি যাতে জনগণ নির্বিঘেœ ও ভালোভাবে ঈদযাত্রা করতে এবং ঈদ শেষে নিরাপদে ঢাকায় ফিরতে পারে। তিনি বলেন, রাজধানীর নিñিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।
পরিদর্শনকালে উপদেষ্টা রাজধানীর বাস টার্মিনালগুলো, প্রবেশ ও বহির্গমন পয়েন্টসমূহ যানজটমুক্ত রাখতে ট্রাফিক বিভাগকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেন। তা ছাড়া তিনি নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত বাসভাড়া আদায়ের কোনো অভিযোগ পেলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্দেশ দেন।
শনিবার বিকেল পর্যন্ত যমুনা সেতু পশ্চিম মহাসড়কে যানজটপ্রবণ এলাকা কড্ডার মোড়, মুলিবাড়ি চেকপোস্ট, নলকা সেতু, হাটিকুমরুল গোলচত্বর ও চান্দাইকোনা কোথাও যানজট দেখা যায়নি। তবে প্রতিনিয়ত মহাসড়কে যানবাহনের চাপ বাড়লেও ভোগান্তি ছাড়াই স্বস্তিতে বাড়ি ফিরছেন উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের ২২ জেলার মানুষ। যাত্রীবাহী যানের পাশাপাশি ট্রাক, পিকআপ ও মোটরসাইকেলেও ফিরছেন ঘরমুখো মানুষ।
দেশের অর্থনৈতিক লাইফলাইন খ্যাত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লা অংশে প্রতিবছর ঈদযাত্রায় তীব্র যানজটে ভোগান্তি থাকলেও এবারের চিত্র পুরোপুরি ভিন্ন। মহাসড়কটির এই অংশে নেই চিরচেনা সেই যানজট।
এদিকে ঈদযাত্রা নির্বিঘœ রাখতে হাইওয়ে পুলিশের পাশাপাশি অপরাধ দমনে চেকপোস্ট বসিয়ে সড়কে রয়েছে সেনাবাহিনী। তাদের সহযোগিতা করছে কমিউনিটি পুলিশিং, রোভার স্কাউট ও আনসার সদস্যরা। এ ছাড়া মহাসড়কের কুমিল্লার অংশে রাতে যানবাহনে ডাকাতি ও ছিনতাই বন্ধ করতে পুলিশের নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। যাত্রীদের নিরাপত্তা দিতে ২৪ ঘণ্টা টহল অব্যাহত রেখেছে হাইওয়ে পুলিশ। রাতে মহাসড়কে কাউকে সন্দেহ হলেই জিজ্ঞাসাবাদ করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী।
তিশা পরিবহনের যাত্রী আব্দুস সালাম বলেন, এবারের ঈদযাত্রা স্বস্তিদায়ক বলা যায়। ঢাকা থেকে কুমিল্লায় এসেছি মাত্র আড়াই ঘণ্টায়। অন্যান্য বছর যানজটের কারণে ৬-৭ ঘণ্টা সময় লাগত। পুরো সড়কে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর তৎপরতা ছিল প্রশংসনীয়। এতে বোঝা যায় প্রশাসন চাইলে সবকিছুই সম্ভব। স্টারলাইন পরিবহনের যাত্রী আবু সুফিয়ান সুমন বলেন, পরিবার নিয়ে ঢাকা থেকে ফেনীর উদ্দেশে রওনা হলাম। দুশ্চিন্তায় ছিলাম কখন বাড়ি পৌঁছাব। শুকরিয়া সকল শঙ্কা কাটিয়ে স্বস্তিতেই বাড়ি ফিরছি।
মনে হচ্ছে ৩ ঘণ্টায় ফেনী যাব। ভোগান্তি ছাড়া এটাই আমার প্রথম ঈদযাত্রা। কুমিল্লা রিজিয়ন হাইওয়ে পুলিশ সুপার এডিশনাল ডিআইজি (সুপারনিউমারি) মো. খাইরুল আলম বলেন, মহাসড়কে ঈদযাত্রায় যাত্রীদের বিড়ম্বনা কমাতে কুমিল্লা রিজিয়নে হাইওয়ে সেক্টরের তত্ত্বাবধানে ২২টি চেকপোস্ট, দিন-রাত ৭২টি টহল টিম, যানবাহন চেকিং টিম ২২, ট্রাফিক জ্যাম নিয়ন্ত্রণ টিম ৩৮টি, বাসস্ট্যান্ডগুলোতে চেকিং টিম ১৩টি, কুইক রেসপন্স টিম ২২টি, একটি কন্ট্রোলরুম ও অস্থায়ী কন্ট্রোলরুম ৬টি এবং একটি স্ট্রাইকিং রিজার্ভ ফোর্স কাজ করছে।
এ ছাড়া দুর্ঘটনাকবলিত যানবাহন দ্রুত সরাতে সার্বক্ষণিক ২২টি রেকার টিম এবং হতাহতদের উদ্ধারে ২৩টি অ্যাম্বুলেন্স প্রস্তুত রাখা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, হাইওয়ে পুলিশের পাশাপাশি সেনাবাহিনী, কমিউনিটি পুলিশিং, রোভার স্কাউট ও আনসার সদস্যরা সহযোগিতা করে যাচ্ছেন। গত কয়েকদিনে কুমিল্লা রিজিয়নের হাইওয়ে পুলিশ অভিযান চালিয়ে ১০ জন ডাকাত, ৯ জন ছিনতাইকারী এবং ৪ জন চোর গ্রেপ্তার করে। এ সময় তাদের কাছ থেকে ২টি রামদা, একটি চাইনিজ কুড়াল, বিভিন্ন সাইজের ১১ পিস ছুরি এবং ১০টি লোহার রড জব্দ করা হয়। এ ছাড়া ছিনতাই হওয়া ৪১ হাজার টাকা উদ্ধার করে পুলিশ।
গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার চন্দ্রায় ও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের ভোগড়া ও চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় শুক্রবার রাত থেকে থেমে থেমে যানজট হয়েছে। তবে শনিবার সকাল থেকে দুই মহাসড়কে স্বস্তি নিয়েই বাড়ি ফিরছে ঘরমুখো মানুষ। অতিরিক্ত যানবাহন ও মানুষের ভিড়ের কারণে চন্দ্রা ও চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় কিছুটা জটলা আছে। শিল্প ও হাইওয়ে পুলিশ জানায়, শিল্প অধ্যুষিত গাজীপুরে ২ হাজার ১৭৬টি নিবন্ধিত কলকারখানা। এর মধ্যে ১ হাজার ১৫৪টি পোশাক কারখানা।
এসব কারখানায় কাজ করেন কয়েক লাখ কর্মী। শুক্রবার পর্যন্ত ১ হাজার ৪৭৯টি কারখানা ছুটি হয়েছে। এসব কারখানা ছুটি হওয়ার পর শ্রমিকেরা বাড়ি ফিরতে শুরু করেছেন। শনিবার সকালে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ঘুরে দেখা যায়, পুলিশ কোথাও কোনো পরিবহনকে দুই থেকে তিন মিনিটের বেশি অবস্থান করতে দিচ্ছে না। ফলে পরিবহনগুলো যাত্রী নিয়ে দ্রুত অবস্থান পরিবর্তন করছে। তবে চন্দ্রা ত্রিমোড় এলাকায় অতিরিক্ত যাত্রী ও গাড়ি থাকায় সেখানে যানবাহনের কিছুটা ধীরগতি।
জয়দেবপুর রেলওয়ে জংশনের স্টেশন মাস্টার আবুল খায়ের চৌধুরী বলেন, সাধারণ সময়েও জয়দেবপুর জংশনে যাত্রীদের চাপ থাকে। অধিকাংশ কারখানা ছুটি হওয়ায় চাপ বহুগুণ বেড়েছে। এ ছাড়া ঢাকা-টাঙ্গাইল-যমুনা সেতু মহাসড়কে নেই চিরচেনা যানজট। স্বাভাবিক গতিতেই চলাচল করছে যানবাহন। এতে স্বস্তি নিয়ে যাতায়াত করছেন যাত্রীরা। চালক ও যাত্রীরা জানিয়েছেন, মহাসড়কে যানবাহনের চাপ থাকলেও এ বছর যানজটের সৃষ্টি হয়নি। এতে স্বস্তিতে গন্তব্যে যেতে পারছে মানুষজন।