ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০১ এপ্রিল ২০২৫, ১৮ চৈত্র ১৪৩১

মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিনদের মানবেতর জীবন-যাপন

কামরুজ্জামান বাচ্চু, নিজস্ব সংবাদদাতা, বাউফল, পটুয়াখালী

প্রকাশিত: ১৯:২৬, ২৯ মার্চ ২০২৫

মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিনদের মানবেতর জীবন-যাপন

ছবি: মসজিদে আজানরত মুয়াজ্জিন

মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিনদের কষ্টের খবর কেউ রাখে না । সমাজে সম্মানজনক স্থানে থাকলেও তাদের রয়েছে আর্থিক দীনতা। ৪-৫ হাজার টাকার বেশি তারা বেতন পান না। তাও ২-৩ মাস পর এক মাসের বেতন পান।

মুসল্লিদের চাঁদার টাকায় তাদের বেতন হয়। অনেক মুসল্লি আছেন যারা আবার নিয়মিত চাঁদার টাকা শোধ করেন না। মুয়াজ্জিনরা মুসল্লিদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে এ চাঁদার টাকা নিয়ে আসেন। কোনো মুসল্লি টাকা দেন, আবার কোনো মুসল্লি পরের মাসে দেবেন বলে মুয়াজ্জিনকে ফিরিয়ে দেন। 

ইমাম ও মুয়াজ্জিনরা মুসল্লিদের নামাজ আদায় করানোর পাশাপাশি আজান দেওয়া, ইসলামি শিক্ষা প্রদান, জন্ম, বিয়ে ও মৃত্যুর মতো গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ভূমিকা রাখেন। তবে তাদের বেতন-ভাতা অত্যন্ত কম এবং অনিয়মিত। ফলে পরিবার নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন তারা।

মসজিদের ভিন্নতা ও আয়কৃত অর্থের ওপর নির্ভর করে ইমাম-মুয়াজ্জিনদের বেতন নির্ধারিত হয়। সরকারি কোনো নির্ধারিত বেতন কাঠামো নেই, যার ফলে অধিকাংশ মসজিদের ইমাম ও মুয়াজ্জিন অল্প সম্মানীর বিনিময়ে দায়িত্ব পালন করেন।

বাউফল সরকারি কলেজ মসজিদের ইমাম আলহ্জ্ব মাওলানা মোহাম্মাদ শাহজাহানের জানান, তিনি দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে সরকারি কলেজ মসজিদে ইমামতি করেন। পরিবারের স্ত্রী-সন্তানসহ বর্তমানে তার ৫ সদস্যের সংসার। তার হাদিয়া বা সম্মানি ভাতা ৭ হাজার টাকা। পাশাপাশি সামান্য বেতনে একটি মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন তিনি। তিনি বলেন, সরকারি কলেজ মসজিদ বলা হয় কিন্তু বাংলাদেশে সরকারি কলেজের যত মসজিদ, তার ইমাম- মুয়াজ্জি কারো বেতনই সরকারিভাবে দেওয়া হয় না।

উপজেলার কালাইয়া ইউনিয়নের বায়তুন নাজাত জামে মসজিদের ইমাম মাওলানা মোঃ রিয়াজুল ইসলাম বলেন, 'আমি যৌথ পরিবারে বসবাস করি, আমার পরিবারে সদস্য ২৬ জন। আমি ৫ হাজার টাকা সম্মনী পাই। পাশাপাশি সামান্য বেতনে বাসায় বাসায় গিয়ে ছাত্রদের পড়াই। এক বছরে হয়েছে আমি বিয়ে করেছি। মাস শেষে যখন বেতন হাতে বাজার করতে যাই, তখন দেখা যায় তেল কিনলে নুন কিনতে পারি না, নুন কিনলে চাল কিনতে পারি না, চাল কিনলে ডাল কিনতে পারি না। ঈদের সময়ে অনেকেই ১৫-২০ হাজার টাকার মার্কেট করে, সেখানে আমার বেতনই ৫ হাজার টাকা। সেই বেতন দিয়ে মার্কেট করি কীভাবে?'

বাউফল পৌর শহরের ৭ নং ওয়ার্ডে মুন্সি মুজাফ্ফার মসজিদের ইমাম ও মুয়াজ্জিনের দায়িত্ব পালন করেন হাফেজ মহিউদ্দিন। তার পরিবারের স্ত্রী, বাবা-মা, বোনসহ সদস্য ৫ জন। তার বাসা থেকে মসজিদের দূরত্ব ২ কিলোমিটার। তিনি ইমামতি ও মোহাজ্জিনির পাশাপাশি কাফিয়া জামাতের শিক্ষার্থী, তার মাওলানা পড়াশোনা শেষ করতে আরও ৪ বছর সময় লাগবে। মাস শেষে সম্মানী পান ৫ হাজার টাকা।

তিনি বলেন, 'সবই আল্লাহর ইচ্ছা, আল্লাহ তা'য়ালা চালাইতেছে। মসজিদের খিদমত করতেছি, এটা তো ছোটখাট বিষয় না। আল্লাহ তা'য়ালা সবাইকে দিয়ে মসজিদের খিদমত করায় না, দ্বীনের খিদমত করায় না। আল্লাহ তা'য়ালার খিদমত করতেছি, দ্বীনের খিদমত করতেছি। আমার কাছে ভালো লাগে এটা। যেটা সম্মানী পাই সেটা দিয়ে কিছুই হয় না। কিন্তু আল্লাহ তা'য়ালা চালাইতেছে। পাশাপাশি কিছু ছাত্র পড়াইতেছি, এটা দিয়েই চলতেছি।'

নাজিরপুর ইউনিয়ন পরিষদ সংলগ্ন জামে মসজিদের মুয়াজ্জিনের দায়িত্বে রয়েছেন মোঃ নাঈম হোসাইন। তিনি ফেব্রুয়ারিতে দাখিল পরীক্ষা দিয়েছেন, এখন রেজাল্টের অপেক্ষায় আছেন। মাদ্রাসার পড়ালেখার পাশাপাশি মসজিদে আজান দেওয়ার দায়িত্ব পালন করে মাসে সম্মানী পান ৩ হাজার টাকা। ৬ বছর বয়সে বাবাকে হারিয়েছে নাঈম। যা সম্মানী পান তা দিয়ে তিনি তার নিজের পড়ালেখার খরচ বহন করেন। এ সম্মানী দিয়ে পরিবারের জন্য কিছুই করতে পারেন না। তার পরিবারের মা, দাদি, ভাইসহ ৪ জন সদস্য। নাঈমের ভাই উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থী। তার মামাদের সহযোগিতায় কোনোরকমে দিন পার করছেন তারা ।

নাঈম বলেন, 'আমার পরিবার জন্য আমার অনেক কিছু করার ইচ্ছা আছে। আমি যে কয় টাকা সম্মানী পাই, ওই টাকা দিয়ে আমি পরিবারের জন্য কিছু করতে পারিনা।'

বাউফলে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ভারপ্রাপ্ত কেয়ারটেকার হাফেজ ওমর ফারুক বলেন, বাউফল উপজেলায় ১ হাজার ২৫০ টি জামে মসজিদ রয়েছে এবং ৪০০টি পাঞ্জেখানা মসজিদ রয়েছে। বিশেষ করে গ্রাম অঞ্চলের ইমামদের বেতন ৫ থেকে ৮ হাজার টাকা, মুয়াজ্জিনের বেতন ২-৩ হাজার। শহর অঞ্চল, পৌরসভায় কোনো কোনো মসজিদে সর্বোচ্চ ১০-১৫ হাজার টাকা বেতন রয়েছে। বর্তমান দ্রব্যমূল্যের বাজারে এই বেতনে ইমামদের তাদের পরিবার নিয়ে সাংসারিক কার্যক্রম পরিচালনা করা খুবই কষ্টকর হয়।

রাষ্ট্রীয়ভাবে ইমাম এবং মোয়াজ্জিনদের কল্যাণে সরকার কোনো উদ্যোগ নিলে ইমাম ও মোয়াজ্জিনরা ভালোভাবে চলতে পারবেন বলে জানান তিনি। তিনি আরও জানান, বাউফলে সরকারি কোনো জামে মসজিদ নেই, তবে বাউফল উপজেলা পরিষদ চত্বরে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অধীনে ইসলামিক ফাউন্ডেশন একটি মডেল মসজিদের নির্মাণ কাজ চলমান রেখেছে।

 

কামরুজ্জামান বাচ্চু/রাকিব

×