
প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস বৃহস্পতিবার চীনের হাইনানে বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়া (বিএফএ) সম্মেলনে ভাষণ দেন
নির্যাতনের মুখে পালিয়ে আসা বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে এশীয় নেতাদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। একইসঙ্গে তিনি উল্লেখ করেছেন, বর্তমানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বাংলাদেশের প্রতি জনসাধারণের আস্থা পুনরুদ্ধারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার শুরু করেছে। আমাদের যুবসমাজ এবং নাগরিকরা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ পুনর্নির্ধারণের জন্য ব্যতিক্রমী সংকল্প এবং শক্তি প্রদর্শন করেছে।
বৃহস্পতিবার চীনের হাইনানে বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়া (বিএফএ) সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশনে ভাষণকালে তিনি এসব কথা বলেন। চারদিনের সফরের দ্বিতীয় দিনে সম্মেলনে বক্তৃতাকালে অধ্যাপক ইউনূস উল্লেখ করেন, বাংলাদেশ গত সাতবছর ধরে ১২ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে, যারা মিয়ানমারের নাগরিক। তিনি বলেন, আমরা বিপুল সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত ব্যয় বহন করে চলেছি। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস সম্প্রতি সংহতির নিদর্শনস্বরূপ রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেছেন।
মিয়ানমারের দীর্ঘস্থায়ী সংকট আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন,
বৈশ্বিক প্রচেষ্টা মারাত্মকভাবে সঙ্কুচিত হচ্ছে কিন্তু তা অব্যাহত রয়েছে, তবে এশীয় নেতাদের অবশ্যই তাদের নিজ দেশ মিয়ানমারে নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে একত্রিত হতে হবে। তিনি বলেন, এই পরিবর্তনশীল বিশ্বে এশিয়ার দেশগুলোর ভাগ্য পরস্পরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। এক অভিন্ন ভবিষ্যৎ এবং মিলিত সমৃদ্ধির লক্ষ্যে আমাদের অবশ্যই একটি সুস্পষ্ট রূপরেখা রচনা করতে হবে। এই ফোরামে এশিয়াকে অবশ্যই চারটি মূল ক্ষেত্রে সহযোগিতা জোরদার করতে হবে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, প্রথমত, আর্থিক সহযোগিতা। এশিয়াকে অবশ্যই একটি টেকসই অর্থায়ন ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে। আঞ্চলিক এমডিবি এবং অনুরূপ প্রতিষ্ঠানগুলোর এই প্রচেষ্টায় নেতৃত্ব দেওয়া উচিত। আমাদের নির্ভরযোগ্য তহবিল প্রয়োজন, যা আমাদের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করে এবং আমাদের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণ করে। দ্বিতীয়ত, বাণিজ্য সহযোগিতা। এশিয়া সবচেয়ে কম সংহত অঞ্চলগুলোর মধ্যে একটি। এই দুর্বল একীভূতকরণ বিনিয়োগ ও বাণিজ্যকে বাধাগ্রস্ত করে।
অবিলম্বে বাণিজ্য সহযোগিতা জোরদারে কাজ করতে হবে। তৃতীয়ত, খাদ্য ও কৃষি সহযোগিতা। আমাদের অবশ্যই সম্পদ-দক্ষ কৃষি প্রচার করতে হবে। খাদ্য নিরাপত্তার জন্য দেশীয় উৎপাদন বাড়াতে হবে। আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে হবে। প্রযুক্তিভিত্তিক টেকসই কৃষি সমাধান সম্প্রসারণ এবং পুনরুৎপাদনশীল ও জলবায়ু-স্মার্ট কৃষিতে উদ্ভাবন মূল বিষয়। চতুুর্থত, প্রযুক্তি সহযোগিতা।
এশিয়াকে অবশ্যই একটি শক্তিশালী প্রযুক্তি বাস্তুতন্ত্র গড়ে তুলতে হবে, যা পুনরুদ্ধারমূলক, বিতরণমূলক এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক হওয়া উচিত। আমাদের জ্ঞান, তথ্য বিনিময় করতে হবে এবং প্রযুক্তি ইনকিউবেশন ও উদ্ভাবনে বিনিয়োগ করতে হবে। ডিজিটাল সমাধানে সহযোগিতা অগ্রগতিকে চালিত করবে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এশিয়ার সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য যার মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ভাষা, ঐতিহ্য, দর্শন ও রীতিনীতি মানব সভ্যতার স্থিতিশীলতা যা সৃজনশীলতার সাক্ষ্য বহন করে। ইসলাম, কনফুসিয়াবাদ, বৌদ্ধধর্ম এবং হিন্দু ধর্মের দর্শন বিশ্ব চিন্তাধারাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে, যা নৈতিকতা, শাসন ও মানবিক চেতনার ওপর অনন্য দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করেছে।
অধ্যাপক ইউনূস আরও বলেন, বহু শতাব্দী ধরে এশিয়ার সভ্যতা বৈচিত্র্যকে গ্রহণ করে সমৃদ্ধ হয়েছে। সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের এই গতিশীল বিনিময় শুধু এই অঞ্চলকেই নয়, পুরো বিশ্বকে প্রভাবিত করেছে। ‘আজ, এশিয়ার সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধি তার বৈশ্বিক প্রভাবকে আরও শক্তিশালী করছে। তিনি বলেন, ঐতিহ্য ও আধুনিকতার সংমিশ্রণ, প্রাচীন জ্ঞানের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতা এবং আধুনিক উদ্ভাবনের সংযুক্তি একসঙ্গে এক শক্তিশালী গতি তৈরি করেছে, যা অঞ্চলটিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এবং তার গভীর ঐতিহাসিক শিকড়কে সম্মান জানাচ্ছে।
জনগণের আস্থা ফেরাতে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার শুরু ॥ প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধারে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার কার্যক্রম শুরু করেছে। তিনি বলেন, আমাদের তরুণ প্রজন্ম ও দেশবাসী বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করতে অসাধারণ সংকল্প ও শক্তি প্রদর্শন করেছে। জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধারে আমরা গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার কার্যক্রম হাতে নিয়েছি।
চলমান সংস্কার কর্মসূচির প্রসঙ্গ উল্লেখ করে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘স্বাধীন কমিশন গঠন করা হয়েছে যাতে নির্বাচনী ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, বেসামরিক প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে সংস্কার আনা যায়।’ এই সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়িত হলে আমাদের জাতির একটি মৌলিক রূপান্তর সাধিত হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমরা যখন একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলতে যাচ্ছি, তখন এশিয়ার অন্যান্য দেশের মতো আমরাও একাধিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছি।’ বিশ্বব্যাপী আর্থিক বাজারের অস্থিরতা, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, কূটনৈতিক উত্তেজনা এবং বাণিজ্য বিঘœœতা বিশ্ব অর্থনীতিতে অস্থিরতা তৈরি করছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘সুদের হার বৃদ্ধি ও ঋণ পরিষেবা ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় এশিয়ার ঋণ সংকট আরও গভীর হচ্ছে।’
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে ধীরগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে উল্লেখ করে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী ২০৩০ এজেন্ডার প্রতি প্রতিশ্রুতি থাকা সত্ত্বেও অগ্রগতি খুব ধীরগতিতে হচ্ছে। এখন পর্যন্ত মাত্র ২৪ শতাংশ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জিত হয়েছে। তিনি বলেন, উন্নয়নশীল এশীয় দেশগুলো প্রতিবছর ২.৫ থেকে ৪ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার এসডিজি অর্থায়নের ঘাটতির সম্মুখীন হচ্ছে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এসডিজি অর্থায়নের বাইরেও এশিয়াকে ব্যাপক পরিমাণে অবকাঠামো বিনিয়োগ ও দায়িত্বশীল অর্থায়নের মাধ্যমে অর্থনৈতিক বৈচিত্র্য আনতে হবে। দুর্নীতি ও আর্থিক অপচয় রোধের আহ্বান জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে দুর্নীতি ও অবৈধ অর্থ প্রবাহের শিকার।
তিনি উল্লেখ করেন, এই ধরনের দুর্নীতি ও আর্থিক অনিয়মের কারণে উন্নয়নশীল দেশগুলো প্রতিবছর প্রায় ১ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতির সম্মুখীন হয়, যা তারা আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহায়তা হিসেবে যে অর্থ পায় তার চেয়ে বহুগুণ বেশি। তিনি বলেন, এশিয়াকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সম্পদ পুনরুদ্ধার ও পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার জন্য একটি বহুপাক্ষিক মধ্যস্থতা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।’
প্রধান উপদেষ্টা আরও বলেন, খাদ্য নিরাপত্তা ক্রমবর্ধমান চাপে রয়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বাড়ার কারণে নি¤œ আয়ের পরিবারগুলো কঠিন সময় পার করছে। তিনি আরও বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ এই সংকটকে আরও গভীরতর করছে। খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থা শক্তিশালী করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ,’ তিনি উল্লেখ করেন।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, জ্বালানি নিরাপত্তা গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষত জ্বালানি আমদানিকারক উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য। জ্বালানি সরবরাহ ব্যাহত হলে মূল্যস্ফীতি, অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং ঋণ সংকট বৃদ্ধি পায়। তিনি বলেন, আমাদের অবশ্যই টেকসই জ্বালানি সমাধান খুঁজে বের করতে হবে। নবায়নযোগ্য শক্তিতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।
প্রধান উপদেষ্টা মানবসম্পদ উন্নয়নে স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় বিনিয়োগের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, যেসব দেশ সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবায় বিনিয়োগ করে, তারা অর্থনৈতিক উৎপাদনশীলতার দিক থেকে ভালো ফল পায়। অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘আমাদের তরুণ প্রজন্মকে ভবিষ্যতের চাকরির বাজারের জন্য প্রস্তুত করতে ডিজিটাল শিক্ষা ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের প্রসার ঘটাতে হবে। তিনি বলেন, ‘ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা বৃদ্ধি পাচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তন তীব্রতর হচ্ছে, ঋণের বোঝা অসহনীয় হয়ে উঠছে এবং মানবিক সংকট বাড়ছে।
তিনি আরও বলেন, উন্নয়ন সহযোগিতার জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা দুর্বল হয়ে পড়ছে, এবং বিশ্ব এখন সম্মিলিত পদক্ষেপের অভাবের কারণে একটি বিপজ্জনক পরিস্থিতির সম্মুখীন। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘বিশ্বের ৬০ শতাংশ জনসংখ্যা এবং ৫৫ শতাংশ বিশ্ব জিডিপি ধারণকারী এশিয়া এই পরিবর্তনগুলোর কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে।
নতুন নিয়ম, বিধি-নিষেধ এবং প্রযুক্তি সরকার পরিচালনা ও অর্থনৈতিক নীতিকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করছে, তিনি বলেন। তিনি আরও বলেন, এক দশক আগে যে নীতিগুলো কার্যকর ছিল, সেগুলো আর প্রাসঙ্গিক নয়। আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তা এখন আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি প্রয়োজন।’
মুনাফার চেয়ে মানুষ ও পৃথিবীকে অগ্রাধিকার ॥ বক্তৃৃতাকালে ড. মুহাম্মদ ইউনূস মুনাফার চেয়ে মানুষ ও পৃথিবীকে অগ্রাধিকার দিয়ে টেকসই অর্থনৈতিক মডেলের দিকে অগ্রসর হওয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। তিনি বলেছেন, আমাদের অবশ্যই টেকসই অর্থনৈতিক মডেলের দিকে অগ্রসর হতে হবে, যা মুনাফার চেয়ে মানুষ ও পৃথিবীকে অগ্রাধিকার দেয়। এ বছর বিএফএ সম্মেলনের প্রতিপাদ্য হলো- ‘এশিয়া ইন দ্য চেঞ্জিং ওয়ার্ল্ড : টুওয়ার্ডস আ শেয়ারড ফিউচার’।
সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশনের ভাষণে ড. ইউনূস বলেন, মানুষ আত্মঘাতী অর্থনৈতিক মূল্যবোধকে ধারণ করে চলা অব্যাহত রেখেছে। এই কারণে মানব সভ্যতা ঝুঁকিতে পড়েছে। তিনি বলেন, আধিপত্যশীল অর্থনৈতিক মডেল সীমাহীন ভোগের ওপর নির্ভরশীল এবং প্রবৃদ্ধির নামে তা সম্পদের অতিরিক্ত উত্তোলন ও পরিবেশগত অবক্ষয়কে ন্যায্যতা দেয়।
জলবায়ু সংকট মানবতার জন্য অস্তিত্বগত হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে জলবায়ু দুর্যোগজনিত অর্থনৈতিক ক্ষতি ইতোমধ্যেই বিশাল, যা প্রায় ৬ হাজার ৫শ’ কোটি মার্কিন ডলারের সমতুল্য। তিনি বলেন, বাংলাদেশের মতো জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোকে সম্পদ ব্যবহার করে দুর্যোগ মোকাবিলা করতে বাধ্য করা হচ্ছে, যা উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ সীমিত করে দিচ্ছে।
ড. ইউনূস বলেন, আমাদের নতুন, অতিরিক্ত, সহজলভ্য, বেসরকারি উন্নয়ন সহযোগিতা, ঋণ-সৃষ্টিকারী নয় এমন, অনুদানভিত্তিক জলবায়ু অর্থায়ন প্রয়োজন, যা অভিযোজন ও প্রশমনের মধ্যে ন্যায়সঙ্গত বন্টন নিশ্চিত করে। সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টা জীবন রক্ষাকারী ওষুধ ও প্রযুক্তির সর্বজনীন প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, কোভিড-১৯ মহামারি আমাদের জন্য একটি সতর্কবার্তা ছিল, যা বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় বিদ্যমান গভীর বৈষম্যসমূহ আমাদের সামনে তুলে ধরেছে।
বৈশ্বিক মহামারি চুক্তির চলমান আলোচনায় এশিয়ার ঐক্যবদ্ধ অবস্থান নেওয়া উচিত। প্রযুক্তিগত অগ্রগতির কথা উল্লেখ করে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, তথ্য-চালিত প্রযুক্তি, রোবটিক্স, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দ্রুত অগ্রগতি ক্রমশ বিশ্বকে ভিন্ন একটি রূপ দিচ্ছে।
তিনি উল্লেখ করেন, উন্নত বিশ্বের তুলনায় এশিয়ার কম সক্ষমতা, সামর্থ্য এবং সম্পদ স্থানান্তর ডিজিটাল বৈষম্যকে আরও বিস্তৃত করতে পারে। তথ্যের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার বিষয়টিকে গভীর উদ্বেগের বিষয় হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘যদি দায়িত্ব জ্ঞানহীনভাবে প্রযুক্তি বিকশিত হয়, তাহলে তা অস্তিত্বগত ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। তিনি আরও বলেন, এশিয়াকে অবশ্যই ডিজিটাল বৈষম্য দূর করতে হবে এবং প্রযুক্তি, উদ্ভাবন ও ইনকিউবেশনে আঞ্চলিক সক্ষমতা তৈরি করতে হবে।
ফিলিস্তিন সংকট শুধু মুসলমানদের উদ্বেগের বিষয় নয় ॥ অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, আজকের বহু-সংকটের বিশ্বে যুদ্ধ এবং সংঘাত অধিকার খর্ব করে এবং অর্থনীতিকে ব্যাহত করে। বিশ্বব্যাপী নিন্দা সত্ত্বেও গাজায় গণহত্যা অব্যাহত রয়েছে। ফিলিস্তিন সংকট শুধু আরব বা মুসলমানদের উদ্বেগের বিষয় নয়, এটি একটি মানবিক বিষয়। ইউক্রেনে অব্যাহত উত্তেজনা বৈশ্বিক সরবরাহ চেইনে ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলছে।
সম্মেলনে বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়ার মহাসচিব ঝাং জুন, জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব ও বোয়াও ফোরামের চেয়ারম্যান বান কি-মুন এবং চীনের স্টেট কাউন্সিলের নির্বাহী উপ-প্রধানমন্ত্রী ডিং শুয়েশিয়াংও বক্তৃতা করেন।
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বান কি-মুন ও কু ডংগিউয়ের সাক্ষাৎ ॥ বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব ও বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়ার চেয়ারম্যান বান কি-মুন সাক্ষাৎ করেছেন। বৃহস্পতিবার চীনের হাইনান প্রদেশে বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়ার (বিএফএ) বার্ষিক সম্মেলনের ফাঁকে উভয়ের এ সাক্ষাৎ অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও)-এর মহাপরিচালক কু ডংগিউও প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন।
সাক্ষাৎকালে অন্যান্যের মধ্যে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, প্রধান উপদেষ্টার উচ্চ প্রতিনিধি ড. খলিলুর রহমান, এসডিজিবিষয়ক মুখ্য সচিব লামিয়া মোরশেদ এবং প্রেস সচিব শফিকুল আলম উপস্থিত ছিলেন। এর আগে বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়া সম্মেলনের ফাঁকে চীনের স্টেট কাউন্সিলের নির্বাহী উপ-প্রধানমন্ত্রী ডিং জুয়েশিয়াং অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
চীনে কৃষিপণ্য রপ্তানিতে এফএওর সহযোগিতা কামনা ॥ বাংলাদেশ থেকে চীনে বৃহৎ পরিসরে ফল ও কৃষিপণ্য রপ্তানিতে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও)-এর সহযোগিতা চেয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বৃহস্পতিবার চীনের হাইনানে বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়ার (বিএফএ) বার্ষিক সম্মেলনের ফাঁকে এফএওর মহাপরিচালক কু ডংইউর সঙ্গে এক বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা এই সহযোগিতা কামনা করেন। অধ্যাপক ইউনূস বলেন, চীন কৃষি ও জলজ পণ্যের শীর্ষ আমদানিকারক হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে, কিন্তু চীনের বাজার সম্পর্কে না জানার কারণে বাংলাদেশ সেখানে প্রবেশ করতে পারছে না।
এফএও মহাপরিচালক কিউ দংইউ এক সময় চীনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ছিলেন। প্রধান উপদেষ্টা তাকে চীনা আমদানিকারক ও বাংলাদেশের কৃষি ও ফল উৎপাদনকারীদের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করার আহ্বান জানান। এফএওর মহাপরিচালককে উদ্দেশ্য করে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ফল প্রক্রিয়াজাতকরণ, সবজি সংরক্ষণ, গুদামজাতকরণ ও প্যাকেজিংয়ের ক্ষেত্রে আমাদের সহায়তা প্রয়োজন।
আপনি আমাদের কৃষক ও রপ্তানিকারকদের সঙ্গে চীনকে সংযুক্ত করতে পারেন। তিনি বলেন, চীন শীঘ্রই বাংলাদেশ থেকে আম আমদানি করবে এবং এফএওর সহায়তায় বাংলাদেশ সহজেই আরও রপ্তানিযোগ্য শাক-সবজি ও ফল উৎপাদন করতে পারবে। বাংলাদেশকে সহায়তার আশ্বাস দিয়ে এফএওর মহাপরিচালক বলেন, তার সংস্থা চীনে বাংলাদেশের কৃষিপণ্য রপ্তানির লক্ষ্যে একটি নতুন প্রকল্প গ্রহণ করবে।
চীনা উৎপাদন কেন্দ্র স্থানান্তরে সহায়তা করবে চীনের এক্সিম ব্যাংক ॥ চীনের এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ব্যাংকের (এক্সিম ব্যাংক) চেয়ারম্যান চেন হুয়াইউ বলেছেন, তার ব্যাংক বাংলাদেশে চীনা উৎপাদন কেন্দ্র স্থানান্তরে সহায়তা করবে, যাতে অন্যান্য দেশে রপ্তানির জন্য বাংলাদেশকে একটি প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। চীনের এক্সিম ব্যাংক বাংলাদেশে চীনা অর্থায়িত অবকাঠামো ও জ্বালানি প্রকল্পগুলোর প্রধান অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠান।
তবে এবারই প্রথম তারা দক্ষিণ এশিয়ার দেশটিতে চীনা বেসরকারি শিল্প বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। চেন হুয়াইউ বৃহস্পতিবার চীনের হাইনানে বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়ার বার্ষিক সম্মেলনের ফাঁকে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ সময় তিনি এ কথা বলেন। সাক্ষাৎকালে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূস বলেন, বাংলাদেশের কৌশলগত অবস্থান এবং মানবসম্পদ দেশটিকে চীন ও বিশ্বের অন্যান্য শীর্ষস্থানীয় কোম্পানির জন্য একটি উৎপাদন কেন্দ্রে রূপান্তরিত করতে পারে।
তিনি বলেন, তিনি শীর্ষ চীনা বেসরকারি উদ্যোক্তাদের বাংলাদেশে তাদের কারখানা স্থানান্তরের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন এবং তার সরকার বিনিয়োগকারীদের জন্য আকর্ষণীয় সুবিধা ও একটি বাণিজ্য করিডর প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।