ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ৩০ মার্চ ২০২৫, ১৬ চৈত্র ১৪৩১

সংগীতগুরু ড. সানজীদা খাতুনের জীবনাবসান

নাজনীন বেগম

প্রকাশিত: ১৫:৩১, ২৭ মার্চ ২০২৫; আপডেট: ১৬:৫৯, ২৭ মার্চ ২০২৫

সংগীতগুরু ড. সানজীদা খাতুনের জীবনাবসান

দেশের বরেণ্য সংগীতশিল্পী ড. সানজীদা খাতুন চিরপ্রস্থানের পথে অনন্তকালের বাসিন্দা হলেন। তবে কিছু অসাধারণ গুণী ব্যক্তিত্বের বিদায় মানা আসলেই কঠিন। চিরঞ্জীব হয়ে তিনি বেঁচে থাকবেন অগণিত শিক্ষার্থী, কলাকৌশলী, ভক্ত-শ্রোতার হৃদয়ের নিভৃতে সংগীতের অনুরণনে চিরস্থায়ী এক নির্মাল্যে। তবে পরিণত বয়সে ৯২ বছর পর্যন্ত বর্ণাঢ্য জীবন কাটানো এই গুণীজন রবীন্দ্র বলয়ের এক স্পর্শকাতর অনুভব। প্রতিদিন অনুভব, অনুভূতিতে রবীন্দ্রনাথকে ধারণ করা এই গুণী শিল্পী শান্তিনিকেতনের বর্ণাঢ্য সংগীত বলয়ে সুবর্ণ সময় কাটিয়েছেন কয়েক বছর।

স্বনামখ্যাত এই রবীন্দ্র শিল্পী দেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রথম সারির একজন লড়াকু সৈনিক। ১৯৬১ সালের রবীন্দ্র বিরোধী দুঃসময়ে ষাটের দশকে তোলপাড় করা আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া এই ক্ষণজন্মা শিল্পীর জীবনাচরণ ছিল শৈল্পিক মাহাত্ম্যের অনন্য শৌর্যে। শক্তি আর সৌন্দর্যে জীবনটা সাজিয়েছেন রবীন্দ্র নিবিড়তায় পরম নিবেদন আর সমর্পণে। এগিয়ে গেছেন বীরদর্পে, সাবলীল সাংস্কৃতিক দ্যোতনা আর পারদর্শিতায় নিজেকে পূর্ণ করে দেওয়া। শুধু কি নিজেকে? চারপাশের সবুজ ঘেরা শ্যামল বাংলাদেশের ছায়া সুশীতল শান্তির নীড়ের অসংখ্য শিক্ষার্থী আর শুভানুধ্যায়ীদের। পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। পিতা ছিলেন কাজী মোতাহার হোসেন আর এক স্বনামধন্য ব্যক্তিত্বের দেশের বরেণ্য সীমানায়। যাপিত জীবনের স্রোত বরাবরই অনুকূলে থাকা ড. সানজীদা খাতুন নিজেকে সাবলীলভাবে এগিয়ে নিতে বাধা-বিঘ্ন অতিক্রম না করাও স্বাচ্ছন্দ্যময় গতিপ্রবাহে আপন ভুবনে সৃষ্টির বলয়কে পরিশীলিত, মার্জিত ও জীবনমুখী করতে পেরেছিলেন।

শিক্ষক, গবেষক, সংগীতশিল্পীর উজ্জ্বল আসনে অভিষিক্ত এই অকুতোভয় সৈনিক ষাটের দশকে যে মাত্রায় আন্দোলন ঝড়ে নিজেকে উজাড় করেন তাও এক স্মরণীয় বরণীয় অধ্যায়। আলাদা মাত্রার এক জ্ঞান সাগর উন্মুক্ত করার অনন্য প্রতিষ্ঠান 'নালন্দা' তাঁর হাত ধরে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে চলে। যা আজ দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের এক অভাবনীয় শিক্ষার আধার। বহুমুখী কর্মযোগে যেভাবে নিজেকে সমর্পণ করেন সেখানে মাতৃভূমি, মাতৃভাষা ছিল পরম আরাধ্য বিষয়। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথই শুধু নয়, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল তাকে নানাভাবে প্রাণিত করেছেন। যে কোনো প্রথিতযশা শিল্পী নিজেকে সীমাবদ্ধ বলয়ে আটকে রাখা কঠিনতর এক বিষয়। সানজীদা খাতুন তেমন সীমাবদ্ধ গণ্ডি থেকে বৃহত্তর সাংস্কৃতিক ও সাঙ্গিতিক প্রবাহে আন্তরিকভাবে নিজের সমস্ত উৎসাহ-উদ্দীপনা ঢেলে দেন।

শুধু কণ্ঠ নয়, মনন শিল্পেও রয়েছে তার অভাবনীয় কৃতিত্ব। পাশে পেয়েছিলেন ওয়াহিদুল হকের মতো আরও এক সাংস্কৃতিক বোদ্ধা, মনন শৌর্যে মহীয়ান ভিন্নমাত্রার সৃজন শিল্পী। ছায়ানটের অনুরাগী, ভক্ত, সহকর্মীদের বন্দনায় উঠে আসবে আপার সাংগঠনিক দক্ষতা, সক্ষমতা, নিজের সবটুকু দিয়ে দেওয়ার মতো হৃদয়ের প্রসারতা। তার আপন শৌর্য আর সৃজন দ্যোতনায় আপোসহীন এক লড়াকু শিল্পী বোদ্ধা কি মাত্রায় সমস্ত অপসংস্কার, দুর্বিনীত অপশক্তি আর সামাজিক কূপমণ্ডুকতাকে দুমড়ে-মুচড়ে নির্ভীক পদচারণায় শুধু সামনের দিকে তাকিয়েছেন। পেছন ফেরার গরজ কখনোই হয়নি। ছায়ানটের মতো এক অনন্য সংগঠন তৈরি করা এই রবীন্দ্র অনুরাগী কবিগুরুর বিশ্ব ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়েও অধ্যয়ন করে নিজের শৈল্পিক মাহাত্ম্যকে অনন্য শিখরে নিয়ে যান।

প্রাচ্যের অক্সফোর্ড হিসেবে স্বীকৃত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক করা এই মেধাবী মনন পরবর্তীতে আরও কত রবীন্দ্রধন্য প্রতিষ্ঠানে নিজেকে সমর্পণ করেছেন সেটাই বিচিত্র প্রতিভার অনন্য স্ফূরণ তো বটেই। পরের বছরই স্নাতকোত্তর করলেন রবীন্দ্র ধন্য বিশ্বভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। রবীন্দ্রনাথের গভীর মনন বোধে উচ্চতর গবেষণা পিএইচডিও সম্পন্ন করলেন বিশ্ব ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। নিজের অর্জিত জ্ঞান সর্বজনের মাঝে ছড়িয়ে দিতে পেশা হিসেবে নির্বাচন করলেন শিক্ষকতা। আজও আমার মনে হয় এর চেয়ে উত্তম পেশা আর হতেই পারে না। মানবসম্পদ গড়ার যথার্থ কারিগর তো বটেই।

শিক্ষকতা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিশিষ্ট রবীন্দ্র বোদ্ধা শৈলজারঞ্জল মজুমদার, আবদুল আহাদ, কণিকা বন্দোপাধ্যায়, নীলিমা সেনের মতো প্রতিষ্ঠিত রবীন্দ্র সংগীতশিল্পী-বোদ্ধাদের কাছ থেকে তালিমও নেন। রবীন্দ্র সংগীতের ভাব সম্পদই ছিল তার গবেষণার মূল বিষয়। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র বিরোধিতার দুঃসময়ে 'ছায়ানটে'র মতো সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরু করা সঞ্জীদা আপার মহান কৃতিত্ব। ১৯৬৭ সাল থেকেই রমনা বটমূলে ১ বৈশাখের প্রথম অনুষ্ঠান করা এই বরেণ্য শিল্পীর কর্মযোগ আজও অব্যাহত গতিতে চলমান। যুগ-যুগান্তরের যেন পরম পাওয়া। যারা রবীন্দ্রভক্ত তাদের জন্য তো বটেই। অনেকেই শামিল হন বৈশাখের প্রথম প্রহরে এমন ছায়াঘেরা নৈসর্গিক আবহে বাংলার নববর্ষকে স্বাগত জানাতে। সেখান থেকেই নববর্ষের নতুন অনুষ্ঠান পালন করা জাতির জন্য এক সাংস্কৃতিক পথরেখা তো বটেই।

২০০১ সালে বৈশাখের প্রথম প্রহরে রমনা বটমূলে অনুষ্ঠান চলাকালীন প্রচন্ড বোমা বিস্ফোরণ আজও এক ক্ষতচিহ্ন। তবে আনুষ্ঠানিক এমন মহাপর্বের কোনো ব্যবচ্ছেদই ঘটেনি। লাগাতারভাবে অনুষ্ঠান চলাও সম্পন্ন হওয়া জাতির জন্য পরম স্বস্তিদায়ক পরিবেশ তৈরি হয়।

বরেণ্য নজরুল সংগীতশিল্পী সোহরাব হোসেনের হাত দিয়ে এই প্রথিতযশা রবীন্দ্র ঘরানার বোদ্ধার সংগীতের জগতে এগিয়ে আসা। শুধু রবীন্দ্র নিবেদনই নয় তার চেয়েও বেশি ছিলেন দেশপ্রেমিকের কাতারে একজন সহযোদ্ধার ভূমিকায়। তার স্বীকৃতি কোনো পদকের বিনিময়ে আসে না। তবে তিনি তাও অর্জন করেছেন আপন সীমানায় অসাধারণ কৃতিত্বের বদৌলতে। একুশে পদক, বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার। এছাড়া ভারত সরকারের সম্মানজনক 'পদ্মশ্রী পদক'। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের দেশিকোত্তম পুরস্কার এবং কলকাতার টেগোর রিসার্চ ইনস্টিটিউটের রবীন্দ্র তত্ত্বাচার্য পুরস্কার। প্রতিবেদকের সঙ্গে সন্‌জীদা খাতুনের সরাসরি যোগাযোগ আলাপ রবীন্দ্র সংগীত সম্মিলন পরিষদে যুক্ত ছিলাম সেই সুবাদে। কাছ থেকে নিবিড়ভাবে দেখা এই বরেণ্য রবীন্দ্র বোদ্ধাকে নিয়ে স্মৃতিচারণ মাত্র।

নাজনীন বেগম/রাকিব

×