ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৯ মার্চ ২০২৫, ১৫ চৈত্র ১৪৩১

নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের অভিযানে ভাটা

সেমাই নুডলস সস ড্রিংকসে ভেজাল বেশি

ফজলুর রহমান

প্রকাশিত: ০০:০২, ২৭ মার্চ ২০২৫

সেমাই নুডলস সস ড্রিংকসে ভেজাল বেশি

সেমাই নুডলস ভেজাল বেশি

কতিপয় অসাধু ব্যবসায়ী সব সময়ই বিভিন্ন ধরনের খাদ্যপণ্যে ভেজাল মিশিয়ে থাকে। এবারও রোজায় ও ঈদ ঘিরে ভেজাল খাদ্য থেকে রক্ষা পায়নি ভোক্তারা। এ সময়ে যেসব খাদ্যে ভেজাল মেশানো হয় এরমধ্যে সেমাই, খেজুর, নুডলস, মসলা, বিভিন্ন প্রকারের সস, বিভিন্ন ধরনের ড্রিংকস ও বেকারি পণ্য বেশি। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি অভিযানে এসব পণ্য ভেজাল করার প্রমাণ পেয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

নকল থেকে বাদ যায়নি কসমেটিক্স আইটেমও। আসল পণ্যের বোতল বা মোড়কের ভেতর নকল পণ্য ভরে বিক্রি করা হয়। চিকিৎসকদের মতে, এসব ভেজাল খাবার খেয়ে এবং কসমেটিক্স ব্যবহারে কারও কিডনি, ফুসফুস আক্রান্ত হচ্ছে। ক্যান্সারের মতো জটিল রোগেও ভুগছে মানুষ। বিশুদ্ধ খাবার নিশ্চিত করতে সরকারি যে সকল প্রতিষ্ঠান কাজ করছে, এরমধ্যে হাতেগোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ভেজালবিরোধী অভিযানে সোচ্চার রয়েছে।

কিন্তু যে প্রতিষ্ঠানের প্রধান কাজই হচ্ছে খাদ্যের মান নিশ্চিত করা, অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া, সেই নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ এবার একেবারেই নিশ্চুপ। নেই কোনো ভেজালবিরোধী অভিযান। শুধুমাত্র মনিটরিং কার্যক্রম আর তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করেই দায় সারছে কর্তৃপক্ষ। সম্প্রতি ভেজাল খাদ্যবিরোধী বেশ কয়েকটি অভিযান পরিচালনা করেছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউট (বিএসটিআই) ও র‌্যাব।

অভিযানে বিভিন্ন ধরনের ভেজাল ও নকল খাদ্য এবং কসমেটিক্স পণ্য জব্দ করা হয়েছে। এতে দেখা গেছে, সেমাই, খেজুর, নুডলস, মসলা, সস, ড্রিংকস, বেকারি পণ্য, ভিনেগারে বেশি ভেজাল মেশানো হয়েছে। কসমেটিক্সের মধ্যে শ্যাম্পু নকল করা হয়েছে। আর বিভিন্ন ব্র্যান্ডের শ্যাম্পু, হেড অ্যান্ড শোলডারের ভোতলে নকল শ্যাম্পু ভরে বাজারজাত করা হচ্ছে। 
রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরের মিতালি ট্রেডার্স ও নাসির ট্রেডার্সের কারখানায় অস্বাস্থ্যকর নোংরা পরিবেশে সেমাই প্রস্তুত করা হচ্ছিল। অস্বাস্থ্যকর ও নোংরা পরিবেশে অনুমোদনহীনভাবে নুডলস উৎপাদন ও বাজারজাত করে আসছিল কেরানীগঞ্জের প্রিমিয়াম ড্রাগন নুডলস কারখানা। আসন্ন ঈদ ঘিরে অসাধু ব্যবসায়ীরা এসব খাদ্য প্রস্তুত করে আসছিল। অবশেষে গত ১৮ তারিখে র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত এই তিন প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালিয়ে ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা জরিমানা করে।
র‌্যাব-২ এর সহকারী পরিচালক (এএসপি) খান আসিফ তুপ বলেন, তিনটি কারখানায় এতটা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে সেমাই ও নুডলস প্রস্তুত করা হচ্ছিল যে, এসব মানুষের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।     
বেকারি পণ্যে ক্ষতিকারক রঙ ও কেমিক্যাল ব্যবহার করে আসছিল উত্তরখান ও দক্ষিণখানের মদিনা বেকারি, নিউ রাজধানী বেকারি ও সুমাইয়া বেকারি। ২০ তারিখে র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. আবু হাসানের নেতৃত্বে অভিযান পরিচালনা করে তিন বেকারিকে জরিমানা করে ভ্রাম্যমাণ আদালত। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রঙ ও কেমিক্যাল মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।    
মার্চের ২ থেকে ১৯ তারিখ পর্যন্ত বিএসটিআই প্রধান কার্যালয় ভেজালবিরোধী ১৮টি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করেছে। খাদ্যে ভেজাল মেশানোর অপরাধে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে এ সময় ৬ লাখ ২০ হাজার টাকা জরিমানা করেছে। বিভিন্ন পণ্য এনে ল্যাবে পরীক্ষা করার পর সংস্থাটি জানিয়েছে, সয়াবিন তেল, ফ্র্রুটস ড্রিংকস, আর্টিফিসিয়াল ফ্লেভার ড্রিংকস, কসমেটিক্স, ভিনেগার ও বেকারি পণ্যে বেশি ভেজাল মেশানো হয়।   
নকল করা হয় কসমেটিক্স পণ্যও। সংস্থাটি গত ১৬ তারিখ লালবাগের শহীদনগরে একটি কারখানায় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে। অভিযানকালে অবৈধভাবে শ্যাম্পু তৈরি করায় প্রায় ২৫ হাজার পিস বিভিন্ন ব্র্যান্ডের (সান সিল্ক, হেড অ্যান্ড শোলডার, ডাব, পেন্টিন) শ্যাম্পুর বোতল জব্দ করা হয়। পরে এসব বোতল ধ্বংস করা হয়েছে। 
বিএসটিআইর প্রসিকিউটিং কর্মকর্তা তারেক রহমান বলেন, অসাধু ব্যবসায়ীর নামি দামি ব্র্যান্ডের বোতলে ভেজাল শ্যাম্পু ভরে বাজারজাত করত। এজন্য বোতলগুলো সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে। সাধারণ মানুষ বোতল দেখে মনে করবেন আসল পণ্য। কিন্তু ভেতরে যে নকল পণ্য সেটি সাধারণ ভোক্তার পক্ষে বোঝা কঠিন।  
একইদিন কেরানীগঞ্জের জিনজিরায় একটি নামবিহীন শ্যাম্পু উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালায় বিএসটিআইয়ের আরেকটি টিম। এ সময় বিপুল পরিমাণ নকল শ্যাম্পু উদ্ধার করা হয়।
নকল এসব শ্যাম্পু ব্যবহারের ফলে চুল উঠে যেতে পারে, ত্বকের সমস্যা দেখা দেওয়াসহ নানান রোগ হতে পারে- এমনটি জানিয়েছেন সংস্থাটির উপ-পরিচালক (মেট্রোলজি) মিজানুর রহমান। 
সারা মাসে ১টি মাত্র অভিযান ॥ বিগত বছরগুলোতে রোজা এলেই ইফতারির বাজারে, খেজুরের মার্কেটে অভিযান পরিচালনা করত নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ। এতে অসাধু ব্যবসায়ীরা যেমন ভয়ে থাকতেন, তেমনি বিশুদ্ধ খাবার পাওয়া নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে স্বস্তি ছিল। কর্তৃপক্ষের অভিযানও ছিল ফলপ্রসূ।

কিন্তু এবার রাজধানীতে ভেজাল বিরোধী কোনো অভিযান চালায়নি সরকারি এই সংস্থাটি। রোজার শুরু থেকে ২৩ তারিখ পর্যন্ত শুধুমাত্র একটি অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। অথচ বিগত রমজান মাসে এবং ঈদ ঘিরে ভোক্তাদের জন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে যথেষ্ট ভূমিকা রেখেছিল নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ। 
বিগত বছরগুলোর মধ্যে ২০২৩ সালে পুরো রমজানে ভেজালবিরোধী অভিযানের অংশ হিসেবে প্রধান কার্যালয় থেকে কর্তৃপক্ষের নিজস্ব ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে ১৫টি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করেছে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ। এর মাধ্যমে ১০ লাখ টাকা জরিমানা ও ৬টি মামলা প্রদান করা হয়েছে।

গতবছর প্রধান কার্যালয় থেকে ১৬টি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে ৯ লাখ ৪৫ হাজার টাকা জরিমানা এবং ২৪টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। আর চলতি রমজানে মাত্র একটি অভিযান (১৮ তারিখে যাত্রাবাড়ী এলাকায়) পরিচালনা করা হয়েছে। যা অন্যান্য বছরের তুলনায় নগণ্য। 
জানতে চাইলে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান জাকারিয়া জনকণ্ঠকে বলেন, রোজার দিন, তাই প্রথম ১৫ দিন কোনো অভিযান পরিচালনা করা হয়নি। আমরা তথ্য পাই না, সাধারণ মানুষ তথ্য না দিলে কোন সোর্সের ভিত্তিতে অভিযান পরিচালনা করব ? খবর না পেয়ে অভিযানে গেলে কম ভেজালই পাওয়া যায়। কেউ তথ্য না দিলে ভেজালবিরোধী অভিযান সম্পন্ন বন্ধ থাকবে ? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, আপনি আমাদের ফেসবুক পেজ দেখেন।

সেখানে আমাদের কার্যক্রম সম্পর্কে দেওয়া আছে। আমরা মনিটরিং করি, মামলা করি। সেমাই পরীক্ষা করতে জেলাপর্যায় থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। কিন্তু আমাদের নিজস্ব ল্যাব নেই। ল্যাবে পণ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষার রিপোর্ট সময়সাপেক্ষের বিষয়। কিন্তু রমজান ও আসন্ন ঈদে খাদ্য অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা এবং খাদ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কর্তৃপক্ষের কোনো ভূমিকা নেই ? এমন প্রশ্নের উত্তরে চেয়ারম্যান বলেন, অভিযান, জরিমানা ও শাস্তি কোনো সমাধান হতে পারে না। তাহলে কিসে সমাধান ? এর উত্তর মেলেনি। 
বিষয়টি দৃষ্টিতে এনে জানতে চাইলে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মাসুদুল হাসান বলেন, বিশুদ্ধ খাদ্য নিশ্চিত করতেও অভিযানের বিকল্প নেই। আমি নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলব। 
ফুটপাত থেকে শুরু করে অভিজাত হোটেল-রেস্টুরেন্ট বা নামি-দামি ব্র্যান্ডের পণ্য এমনকি বাসাবাড়ির খাদ্যও এখন ভেজালমুক্ত নয়। খাদ্যে ভেজাল, খাদ্যে বিষক্রিয়ার ব্যাপ্তি যে হারে বাড়ছে তা আতঙ্কিত হওয়ার মতো। ভেজাল খাবার ঝুঁঁকির দিকে ঠেলে দিচ্ছে জীবন। উৎপাদনকারী ও ব্যবসায়ীদের একটি শ্রেণি অধিক মুনাফার লোভে মনুষ্যত্ব ভুলে গিয়ে প্রচুর মাত্রায় কেমিক্যাল, ক্যালসিয়াম কার্বাইড, ফরমালিন, আর্টিফিসিয়াল রং, ইউরিয়াসহ বিষাক্ত সামগ্রী। এসব কেমিক্যাল অত্যন্ত বিষাক্ত।

এমন বিষাক্ত খাবার খেয়ে আগামী প্রজন্ম মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়বে এমনটি জানিয়েছে একাধিক চিকিৎসক বলেন, বিষাক্ত খাবার খেয়ে কারও কিডনি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, ফুসফুস আক্রান্ত হচ্ছে, ক্যান্সারের কিংবা অন্য কোনো জটিল রোগে ভোগছে মানুষ। শিশুদের মেধা বিকাশে প্রভাব পড়ছে। নারীরা জটিল জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। মানুষের শরীরে রোগবালাই পেয়ে বসেছে। মানুষ অকালে মারা যাচ্ছে। বিষ খেলে মানুষ তো মরবেই। তাই খাবার কেনার ক্ষেত্রে বুঝে শুনে এবং মান দেখে ভেজালমুক্ত খাবার কেনার ও খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা।

×