ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ৩০ মার্চ ২০২৫, ১৫ চৈত্র ১৪৩১

আল বিদা মাহে রমজান

অধ্যাপক মনিরুল ইসলাম রফিক

প্রকাশিত: ২৩:২৬, ২৬ মার্চ ২০২৫

আল বিদা মাহে রমজান

আজ বহু প্রতীক্ষার রজনী পবিত্র লাইলাতুল কদর বা শবে কদর

হাজার মাসের চাইতে যে রাত মহা মূল্যবান শবে কদর সেই যে সে রাত শোন মুসলমান...
আজ বহু প্রতীক্ষার রজনী পবিত্র লাইলাতুল কদর বা শবে কদর। মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র মাহে রমজানের এ বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ রজনীটি অতি ভাবগম্ভীর পরিবেশে পালিত হচ্ছে। কারণ, এ এমন এক রজনী যে রজনীতে নাযিল হয়েছে পবিত্র কুরআনুল কারীম। যার বরকত হাজার মাসের চেয়েও অধিক। আমাদের দেশের মানুষ ধর্মানুরাগী। শবে কদরের প্রতি তাদের আন্তরিক অভিব্যক্তি অনির্বাণ। তাই দিবাভাগ থেকে তাদের নানা প্রস্তুতির শেষ নেই।

মা বোনরাও নানা আয়োজন, ঘর গোছানো, পাক পবিত্র পরিবেশ সৃষ্টিতে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। বিশিষ্ট রাসুল প্রেমিক শ্রেষ্ঠ হাফেজে হাদীস সাহাবী হজরত আবু হুরায়রা (রাদি.) বলেন, রমজান মাসের শুভাগমন হলে আল্লাহর নবী (স.) বলতেন : তোমাদের মধ্যে মোবারক মাস মাহে রমজান এসেছে। আল্লাহ জাল্লে জালালুহু তোমাদের ওপর এ মাসের রোজা ফরজ করেছেন, বেহেস্তের দ্বারগুলো খুলে দিয়েছেন, দোজখের দরজায় তালা লাগিয়েছেন আর শয়তানদের করেছেন শিকলাবদ্ধ।

এ মাসে এমন এক রজনী রয়েছে যা সহস্র রজনী হতে উত্তম। যে ব্যক্তি এ মাসের খায়ের ও বরকত থেকে বঞ্চিত (যেন) সে সব কিছু থেকে বঞ্চিত। হজরত আবু হুরায়রা (রাদি.) হুজুর (স.) এর উদ্ধৃতি দিয়ে আরও বলেন: যে ব্যক্তি পূর্ণ ঈমান ও আত্মশুদ্ধির মনোভাব নিয়ে এ রাতে ইবাদত বন্দেগিতে মশগুল থাকেন, আল্লাহ তার পূর্বের সমস্ত গুণাহ মাফ করে দেন। (তাফসীর ইবনে কাসীর পৃ. ৫১৩)। 
লাইলাতুল কদরের তারিখ নিয়ে মতানৈক্য থাকলেও রমজানের শেষ দশকের যে কোনো বেজোড় রাতেই যে ‘কদর রজনী’ সে বিষয়ে নিঃসন্দেহ। তবে অধিকাংশ বিশ্লেষক আলেমেদ্বীন ও নিরীক্ষকদের মতে ২৭শে রমজান রাতেই শবে কদর। কুরআন নাজিলের মহিমায় ভাস্বর এ রাত রমজানের শেষ দশকে অবস্থিত বলে এটা মাগফিরাত বা গুণাহ মাফের দশক হিসেবে বিঘোষিত হয়েছে। হজরত আয়েশা (রাদি.) কর্তৃক বর্ণিত বুখারী শরীফের হাদীস থেকে জানা যায় যে, হজরত রাসুলে মাকবুল (স.) রমজানের শেষ দশকে শক্ত করে কাপড় বেঁধে রাতভর জেগে ইবাদতে লিপ্ত থাকতেন এবং তাঁর পরিবারকেও জাগাতেন।

হজরত কা’ব (রাদি.) থেকে বর্ণিত আছে, ৭ম আকাশে জান্নাতের অদূরে ‘সিদরাতুল মুনতাহা’ নামক গাছের মাঝামাঝি হজরত জিবরাঈলের নিবাস। আবার উক্ত গাছের শাখা-প্রশাখায় বাস করেন অসংখ্য অগণিত ফেরেস্তা। মু’মনীদের প্রতি স্নেহপরায়ণ এ সব ফেরেস্তা জিবরাঈলের (আ.) নেতৃত্বে এ রাতে আল্লাহর নির্দেশ মুতাবেক সুর্যাস্তের পরপরই পৃথিবীতে অবতরণ করেন; ঘুরে বেড়ান পৃথিবীর আনাচে-কানাচে। কিন্তু মুশরিক ‘জাদুকর’ নেশাখোর, জিনাকার, আত্মীয়ের প্রতি অনুদার প্রভৃতি খারাপ লোক এবং ময়লা আবর্জনাযুক্ত অপবিত্র স্থান থেকে দূরে থাকেন।

পক্ষান্তরে মু’মীনদের কল্যাণ ও মঙ্গল কামনা করে সারা রাত দোয়া করতে থাকেন আর আল্লাহর পক্ষ থেকে সালাম পৌঁছাতে থাকেন ইবাদতে মশগুল সকল মু’মীনের কাছে। শুধু তাই নয়, আল্লাহর ফেরেস্তা জিবরাঈল (আ.) প্রতিটি ঈমানদারের করমর্দনও করে থাকেন। কোনো মু’মীন মুসলমানের শরীর হঠাৎ রোমাঞ্চিত হওয়া বা হৃদয়-মন বিগলিত হয়ে আঁখি যুগল অশ্রুসজল হওয়া তাঁর করমর্দনেরই আলামত।

এ অবস্থা অনুমেয় হলে বুঝতে হবে তার হাত হজরত জিবরাঈলের হাতের মধ্যেই আছে। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে ফেরেস্তারা আসমানে ফিরে যান এবং বান্দাদের বন্দেগির ওপর আল্লাহর দরবারে প্রতিবেদন পেশ করেন। 
বলাবাহুল্য, আল্লাহর অফুরন্ত রহমত, বরকত ও মাগফিরাতের বারিধারায় সিক্ত এ মহান রজনীতে যখন তামাম সৃষ্টিকুল করুণাময় আল্লাহর দয়া ও মেহেরবাণীতে অবগাহন করে, তখনও এক শ্রেণির মানুষের ভাগ্য থাকে অপ্রশস্ত, বঞ্চিত তারা দুনিয়া ও আখিরাতের পাথেয় অর্জনে। ওসব দুর্ভাগা লোকদের তালিকায় রয়েছে বেরোজাদার, গণক, ঈর্শাপরায়ণ, দাবা-পাশার খেলোয়াড়, অন্যায়ভাবে শুল্ক আদায়কারী, পরোক্ষ নিন্দাকারী, কৃপণ, না হক হত্যাকারী, অশ্লীল গায়ক, বাদক, রেখা টেনে অথবা ফালনামা দেখে ভাগ্য ও ভবিষ্যৎ নির্নীতকারী, মাতা-পিতার অবাধ্য সন্তান, পর-স্ত্রীগামী, গর্বসহকারে পায়ের গিরার নিচে কাপড় পড়নেওয়ালা, শত্রুভাবাপন্ন লোক, অত্যাচারী শাসক ও তাদের হোমরা চোমরা, ধোঁকাবাজ ব্যবসায়ী- এ ধরনের আরও যারা মারাত্মক গুণাহের কাজে লিপ্ত।

অবশ্য তওবা সহকারে এসব ঘৃণিত পথ ও অভ্যাস থেকে বাকি জীবন সরে দাঁড়াবার ও পরিত্যাগ করার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়ে আল্লাহর কাছে কায়মনোবাক্যে ক্ষমা প্রার্থনাপূর্বক কান্নাকাটি ও মুনাজাত করলে দয়াময় আল্লাহ তাদের প্রতি দয়াপরবশ হন। 
আল্লাহ পাক আমাদের শরীয়তের পূর্ণ অনুসরণের মাধ্যমে এ রজনীতে ইবাদত বন্দেগি করে খোদাতায়ালার কুরবাত বা নৈকট্য লাভের তাওফীক দান করুন।

×