
চীন সফরের তৃতীয় দিন শুক্রবার চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এর সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে আলোচনায় বসবেন। সেখানে রোহিঙ্গাদের নিরাপদে প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করা সহ মায়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতি বিষয়ে আলোচনা করার কথা জানিযেছে পররাষ্ট্র সচিব।
রোহিঙ্গাদের শান্তিপূর্ণ প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে চীনের গুরুত্ব অপরিসীম। সরকার প্রধান এ ইস্যুকে খুবই গুরুত্ব দিচ্ছে বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে। এদিকে বিশ্লেষকদের মতেও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে চীন গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখতে পারে বলে মতামত দিয়েছেন।
এছাড়াও ড. ইউনুস এবং শি জিনপিং বৈঠকে বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে কৌশলগত বিভিন্ন দ্বিপাক্ষিক ইস্যু, বাণিজ্য এবং বিনিয়োগ বৃদ্ধি, কৃষি, অবকাঠামো, নবায়নযোগ্য জ্বালানী খাতে সহায়তাসহ দুই দেশের পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্টসার্বিক বিষয়সমূহ নিয়ে আলোচনার কথা রয়েছে।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে প্রত্যাশা
পররাষ্ট্র সচিব জানান, রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে বিগত কয়েক বছর যাবৎ কাজ করা হচ্ছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বিভিন্নভাবে চেষ্টা করা হয়েছে সমস্যার স্থায়ী সমাধান নিশ্চিতকরণে।এ বিষয়ে চীন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র সচিব। এ বৈঠকে রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে চীন সরকারের সাথে আলোচনা হবে। বিশেষ করে মায়ানমার বর্তমানে কোন পরিস্থিতিতে আছে সে বিষয়ে এ বৈঠকে আলোচনা করা হবে।
সে আলোাচনা থেকে রোহিঙ্গাদের নিয়ে কিভাবে কাজ করা যায় সে বিষয়ে আলোচনা করবে সরকার। রোহিঙ্গাদের স্থায়ী সমাধান নিশ্চিত করণে কাজ করবে সরকার।
মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে আলোচনায় চীনও আমাদের সহায়তা করেছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা এ বৈঠকে যেটি করছি, মিয়ানমারের অভ্যন্তরে যে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সেটি নিয়ে চীন কী ভাবছে তা আমরা দেখতে পারি। আমাদের চিন্তা তাদেরকে জানাতে পারি।’
পররাষ্ট্র সচিব বলেন, ‘চীন আমাদের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বন্ধু এবং আমরা সেই বন্ধুত্বকে ধারণ করি। চীনের দিক থেকেও একই ধরনের মনোভাব আছে এবং প্রধান উপদেষ্টার প্রথম দ্বিপাক্ষিক সফর হিসেবে চীনকে বেছে নেওয়ার মধ্য দিয়ে একটি বার্তা আমরা দিচ্ছি।”
এ বিষয়ে চীনে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহম্মেদ জনকন্ঠকে বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে চীনের গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ চীনের সাথে মায়ানমারের সম্পর্ক অনেক ভালো। মায়ানমারের সাথে চীনের বাণিজ্যিক সম্পর্কও রয়েছে। সে জন্য ড. ইউনুস কূটনৈতিকভাবে সফল হতে হলে চীনের সাথে রোহিঙ্গা ইস্যু কূটনৈতিক সফলতা নিয়ে আসবে।
তিনি বলেন, চীন গুরুত্বপূর্ণ তবে একমাত্র সমাধান শুধু চীন এটা ভাবা ঠিক হবেনা। চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত এবং রাশিয়া এক হলেই কেবল রোহিঙ্গা পুনর্বাসন হতে পারে অন্যথায় কষ্ট হয়ে যাবে।
তবে আমরা সবাই চাই রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী একটি সমাধান হোক। ড. ইউনূস উনার ডিপ্লোম্যাসি দিয়ে কাজ করলে হয়তো সমাধান করা কিছুটা সফলতার মুখ দেখবে।
তিনি বলেন, ‘এই সফর থেকে আমাদের প্রত্যাশা বহুমাত্রিক। চীন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার এবং অন্যতম বড় উন্নয়ন সহযোগী।’ এছাড়া মানুষে মানুষে যোগাযোগ বাড়ছে। আমরা নতুন নতুন ক্ষেত্র আবিষ্কার করছি এবং সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছি বলে তিনি জানান।
চুক্তি ও ঘোষণা
এবারের সফরে বেশ কয়েকটি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হতে পারে বলে নিশ্চিত করেছেন পররাষ্ট্র সচিব। এছাড়া কিছু ঘোষণা আসতে পারে জানিয়ে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, ‘এরমধ্যে রয়েছে পানি সম্পর্ক উন্নয়নে অর্থনৈতিক ও কারিগরি সহায়তা, সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়াবিষয়ক সহায়তা, এবং গণমাধ্যম বিষয়ক সহযোগিতা।’
পররাষ্ট্র সচিব জসীম উদ্দিন জানান,অর্থনৈতিক বিনিয়োগ, অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিনিয়োগ, এবং গণমাধ্যম সংক্রান্ত বিষয়ক প্রস্তাবনা আসার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
স্বাস্থ্যখাতে সহযোগিতা
চীন বাংলাদেশি রোগীদের জন্য চারটি হাসপালাতাল ইতোমধ্যে তৈরী করেছে। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা করার জন্য বাংলাদেশ থেকে রোগীদের পাঠানো হয়েছে এবং চিকিৎসাও সম্পন্ন করেছে। সেখানে বাংলাদেশের রোগীদের অনুকূল পরিবেশও রয়েছে বলে জানান পররাষ্ট্র সচিব।
চায়না বাংলাদেশ রিলেশনশিপ ৫০ বছর
৫০ বছর পূর্তিতে বাংলাদেশে চীন একটি বিশেষায়িত হাসপাতাল করবে। আর সেটিই হবে পঞ্চাশ বছর পূর্তির প্রথম সোপান।
তিনি বলেন, ‘চীনে বাংলাদেশি রোগীদের প্রথম ব্যাচ গিয়েছে। আমি যতটুকু জানতে পেরেছি, তারা চিকিৎসাসেবায় সন্তুষ্ট। এছাড়া বাংলাদেশি রোগীদের জন্য কুনমিংয়ে চারটি হাসপাতাল চিহ্নিত করা হয়েছে।’
সচিব বলেন, আমাদের প্রত্যাশা, সামনের সময়ে এই সহযোগিতা আরও বাড়বে এবং চীন বাংলাদেশে একটি বিশেষায়িত হাসপাতাল করবে, যেটি বাংলাদেশ ও চীনের দ্বিাপক্ষিক সম্পর্কের যে সুবর্ণজয়ন্তী, তার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ বিষয় হবে। এ বিষয়টিকে জোর দেওয়ার জন্য আমরা শীর্ষ পর্যায়ে কথা বলবো।’
সামরিক সহযোগিতা
পররাষ্ট্র সচিব বলেন, চীনের সাথে বাংলাদেশের সামরিক চুক্তি অনেক আগে থেকেই ছিলো । সে বিষয়ে আলোচনা হতে পারে ।তবে নতুন করে কোনো সামরিক চুক্তি হবার সম্ভবনা নেই।
‘আমাদের দিক থেকে সাধারণভাবে চীনের সঙ্গে যে সামরিক সহযোগিতা আগে থেকেই ছিলো বর্তমানেও থাকবে। তবে এ সফরে চীনের সঙ্গে সাধারণ আলোচনা হতে পারে সাংবাদিকদের জানান পররাষ্ট্র সচিব।
তিস্তা নিয়ে আলোচনা
চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ও প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের মধ্যে বৈঠকে তিস্তা প্রকল্প নিয়ে আলোচনার কথা রয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন পররাষ্ট্র সচিব মো. জসীম উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘এছাড়াও স্বাস্থ্য, রোহিঙ্গা, জিডিআই, জিপিআই অর্থনৈতিক সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা হতে পারে।’
মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টার চীন সফর উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিস্তা নিয়ে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, ‘চীনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে যে বৈঠকটি হবে, সেটি শীর্ষ নেতৃত্ব তাদের পছন্দ অনুযায়ী কথা বলবেন। তবে, আমাদের দিক থেকে এবং চীনের দিক থেকে পানি ব্যাবস্থাপনার বিষয়ে কথা বলার আগ্রহ আছে। পানি ব্যাবস্থাপনার আওতায় তিস্তা প্রকল্প নিয়ে কথা বলার সুযোগ আছে।’
উল্লেখ্য, চীনের হাইনান প্রদেশে বোয়াও সম্মেলন এবং বেইজিং এ চীনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠক করার জন্য আগামী বুধবার চীনের উদ্দেশে রওনা দেবেন প্রধান উপদেষ্টা। ২৭ মার্চ বোয়াও সম্মেলনের প্লেনারি সেসনে বক্তব্য রাখবেন তিনি। ২৮ মার্চ চীনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তার বৈঠক হবে। ২৯ মার্চ পিকিং বিশ্ববিদ্যালয় প্রফেসর মুহাম্মদকে বিশেষ সম্মাননা জানাবে।
আফরোজা