ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৬ মার্চ ২০২৫, ১২ চৈত্র ১৪৩১

চলে গেলেন বাঙালির ‘চিরবন্ধু চিরনির্ভর’ সন্জীদা খাতুন

গৌতম পাণ্ডে

প্রকাশিত: ০০:০৫, ২৬ মার্চ ২০২৫

চলে গেলেন বাঙালির ‘চিরবন্ধু চিরনির্ভর’ সন্জীদা খাতুন

সন্জীদা খাতুন

বাঙালির চিরায়ত উৎসব হয়ে ওঠা পহেলা বৈশাখের প্রত্যুষে রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ উৎসবে আর কখনো তাকে দেখা যাবে না। জীবনের ৯২ বছর পূর্ণ করার মাত্র দশ দিন আগে বাঙালি সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা, ছায়ানটের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও সভাপতি সন্জীদা খাতুন চলে গেলেন পৃথিবী ছেড়ে।

রাজধানী ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মঙ্গলবার বিকাল ৩টার পর তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বলে পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। তার বয়স হয়েছিল ৯১ বছর। তার ছেলে পার্থ তানভীর নভেদ বলেন, সন্জীদা খাতুন মুক্তি নিয়েছেন। আজ বুধবার বেলা সাড়ে ১২টায় ছায়ানটে তার শেষ দেখা মিলবে। নশ্বর  দেহের মৃত্যু হলেও তিনি চিরকাল বাঙালির পাশে রয়ে যাবেন আলোর পথের পথ প্রদর্শক হিসেবে, স্বজন হিসেবে। 
সন্জীদা খাতুন এমন এক সময়ে চলে গেলেন, যখন পহেলা বৈশাখের বাকি আর মাত্র তিন সপ্তাহ। রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ উৎসবে আর কখনো তার কণ্ঠের অমিয় বাণী শোনা যাবে না।
বাঙালির সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে কিংবদন্তিতুল্য, গবেষকের চোখে বিস্ময় জাগানিয়া ব্যক্তিত্ব ছিলেন সন্জীদা খাতুন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা ও জাতীয় অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেনের কন্যা সনজীদা খাতুনের জন্ম ১৯৩৩ সালের ৪ এপ্রিল। সন্জীদা খাতুন পড়েছেন কামরুন্নেসা স্কুল, ইডেন কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং শান্তি নিকেতনের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক ও রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর করে ১৯৭৮ সালে সেখান থেকেই পিএইচডি করেন। দীর্ঘদিন অধ্যাপনার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ থেকে তিনি অবসর নেন।
সন্জীদা খাতুনের লেখার একটি বড় অংশজুড়ে আছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ব্যাপক পরিসরে জনমানসে কবিগুরুকে পৌঁছে দেওয়ার কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে তার। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় শুদ্ধ সংগীতের চর্চার পাশাপাশি বাহান্নর ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন সন্জীদা খাতুন, তখন সহযোদ্ধাদের কাছে তিনি পরিচিত ছিলেন মিনু আপা নামে।
গবেষক মফিদুল হকের ভাষায়, সন্জিদা আপার জীবন পরিক্রমা আর বাংলাদেশের জাতীয় জাগরণ হাতে হাত ধরে চলেছে। সত্যিকার অর্থে একে অপরের পরিপূরক হয়ে উঠেছে। সন্জীদা আপা এক বিস্ময় জাগানিয়া ব্যক্তিত্ব মন্তব্য করে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মুফিদুল হক বলেন, এমন কথা খুব বেশি মানুষের ক্ষেত্রে বলা যায় না, কিন্তু তার সম্পর্কে উচ্চকণ্ঠে বলা যায়।
গত শতকের ষাটের দশকের শুরুর দিকে বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি নিবেদিত প্রতিষ্ঠান ছায়ানটের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সন্জীদা খাতুন। তার তত্ত্বাবধানে ছায়ানট এখন বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠান, যা শাস্ত্রীয় সংগীত ও নৃত্যের প্রসারে কাজ করছে। ছায়ানটের পাশাপাশি জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদেরও প্রতিষ্ঠাতা সদস্য তিনি। প্রচলিত ধারার বাইরে ভিন্নধর্মী শিশুশিক্ষা প্রতিষ্ঠান নালন্দার সভাপতির দায়িত্বও পালন করেছেন। এশিয়াটিক সোসাইটির সাম্মানিক ফেলোও ছিলেন তিনি। 
সন্জীদা খাতুন সারাজীবন বাঙালি সংস্কৃতির সাধনা করেছেন, প্রধানত সংগীতের মধ্য দিয়ে কিশোর বয়স থেকে সর্বজনের হৃদয়ে বাঙালি জাতিসত্তা ধারণের জন্য স্থির প্রত্যয়ে যাত্রা করেছেন। মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি অন্যদের সহায়তায় গড়ে তোলেন দেশান্তরী শিল্পীদের নিয়ে মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থা, যার সদস্যরা বাংলা গান গেয়ে শরণার্থী শিবির ও মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে সকলকে উজ্জীবিত করে তুলেছেন। সমগ্র পাকিস্তান আমলজুড়ে আরোপিত সংস্কৃতির বিরুদ্ধে তিনি কিংবদন্তি যোদ্ধা।
একাধারে শিল্পী, লেখক, গবেষক, সংগঠক, সংগীতজ্ঞ ও শিক্ষক সন্জিদা খাতুন ভারত সরকারের চতুর্থ সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা পদ্মশ্রী খেতাবে ভূষিত হয়েছেন। একুশে পদক, বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, রবীন্দ্র স্মৃতি পুরস্কারে (পশ্চিমবঙ্গ, ভারত) ভূষিত সন্জিদা ১৬টি বই লিখেছেন।
‘সাংস্কৃতিক মুক্তিসংগ্রাম’ বইটি তার মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, বাঙালির সাংস্কৃতিক সংগ্রামের প্রামাণ্য ইতিবৃত্ত এবং মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক তার একান্ত ভাবনাগুচ্ছ ধারণ করেছে। দুই খণ্ডের ‘আমার রবীন্দ্রনাথ’ ধারণ করেছে সন্জীদা খাতুনের রবীন্দ্রযাপন, বাঙালি জীবন, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে রবীন্দ্রনাথের অবদান, রবীন্দ্র কবিতা, রবীন্দ্রসংগীত এবং রবীন্দ্রভাবনার দশ দিগন্ত নিয়ে নানা স্বাদের রচনা। একই সঙ্গে শান্তিনিকেতন, শিলাইদহ, পতিসরসহ বিভিন্ন রবীন্দ্রতীর্থ নিয়ে লেখকের স্মৃতি ও অবলোকনও স্থান পেয়েছে ‘আমার রবীন্দ্রনাথ’ এ।
সন্জীদা খাতুন রচিত বইয়ের মধ্যে আরও রয়েছে ‘রবীন্দ্রসঙ্গীতের ভাবসম্পদ’, ‘রবীন্দ্রনাথের হাতে হাত রেখে’, ‘রবীন্দ্রনাথ: তাঁর আকাশ ভরা কালে’, ‘রবীন্দ্রনাথ: বিবিধ সন্ধান’, ‘তোমারি ঝরনাতলার নির্জনে’, ‘রবীন্দ্রনাথ ও অন্যান্য’, ‘রবীন্দ্রনাথ এবং রবীন্দ্রনাথ’, ‘রবীন্দ্রসংগীত: মননে লালনে’, ‘রবীন্দ্র-বিশ্বাসে মানব-অভ্যুদয়’।
রবীন্দ্র বিষয়ক তার সম্পাদিত বইয়ের মধ্যে আছে ‘রইল তাঁহার বাণী: রইল ভরা সুরে’, ‘গীতবিতান: তথ্য ও ভাবসন্ধান’, ‘সার্ধশততম জন্মবর্ষে রবীন্দ্রনাথ’।
২০২৩ সালে ৯০তম জন্মবার্ষিকীর দিনে ‘নবতিপূর্ণা’ শিরোনামে এক অনুষ্ঠানে লিখিত বক্তব্য পড়ে শুনিয়েছিলেন সন্জীদা খাতুন। সেদিন তিনি বলেছিলেন, অল্পে তুষ্ট সহজ সরল জীবনের এই সার্থকতায় আমি ধন্য হয়েছি।
বিশিষ্ট ব্যক্তি ও সংগঠনের শোক ॥ সন্জীদা খাতুনের মৃত্যুতে শোক জানিয়েছে ছায়ানট, উদীচী, চারণ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন।
তার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে একটি বার্তা প্রকাশ করা হয়েছে ছায়ানটের ফেসবুক পেজ থেকে। শোকবার্তায় বলা হয়েছে, সংস্কৃতিকর্মী, শিল্পী, গবেষক, শিক্ষাবিদ ছায়ানট সভাপতি সন্জীদা খাতুনের প্রয়াণে ছায়ানট গভীর শোক জ্ঞাপন করছে।
গভীর শোক ও শ্রদ্ধা জানিয়েছে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী। এক  শোক বার্তায় উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক বলেন, সন্জীদা খাতুনের মৃত্যুতে  দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এক অপূরণীয় শূন্যতার সৃষ্টি হলো। 
সন্জীদা খাতুনের মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু। তিনি এক শোক বার্তায় লিখেছেন, তোমার দীর্ঘল ছায়া মিলিয়ে যাবে না কোনদিন বাঙালির হৃদয় হতে। 
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল, জাসদের কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে এক শোকবার্তায় জানানো হয়, দেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ, সাংস্কৃতিক শিক্ষা সংগঠন ছায়ানটের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মেলন পরিষদের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, পাকিস্তানি সামরিক শাসক আইয়ূবের রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধসহ বাঙালির ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির ওপর আক্রমণের প্রতিবাদে ১৯৬১ সাল থেকে রমনা বটমূলে বাংলা নববর্ষ পহেল বৈশাখকে স্বাগত জানিয়ে প্রতিরোধের সংস্কৃতি হিসেবে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান চালু করার মূল উদ্যোক্তা, মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম, মহান মুক্তিযুদ্ধসহ বাঙালি জাতির সকল গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল সংগ্রামের সহায়ক সাংস্কৃতিক আন্দোলনে গড়ে তোলার পুরোধা সংগঠক, বরেণ্য রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক সন্জীদা খাতেুনর মৃত্যুত গভীর শোক প্রকাশ করছে এবং শোকসন্তপ্ত পরিবার, স্বজন এবং শোকাহত জাতির প্রতি আন্তরিক সমবেদনা জ্ঞাপন করছে।

জাসদের বিবৃতিতে বলা হয়, মহীয়সী সন্জীদা খাতুনের মৃত্যুতে বাঙালি জাতির অপূরণীয় ক্ষতি হলো। বাঙালি জাতি একজন অভিভাবক ও বাতিঘর হারালো। জাসদের বিবৃতিতে বলা হয়,  দেশ ও জাতির জন্য সন্জীদা খাতুনের অবদান জাতি চিরদিন কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করবে।  
বাংলাদেশ গণসঙ্গীত সমন্বয় পরিষদের শোক ॥ বাংলাদেশের শুদ্ধ সংস্কৃতি চর্চার অন্যতম পথিকৃৎ লেখক ও বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে সকল সাংস্কৃতিক আন্দোলন ও সংগ্রামের অন্যতম কা-ারি, রবীন্দ্র প্রসারের অগ্রদূত, ছায়ানটের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, শিল্পী-সংগ্রামী সনজিদা খাতুনের মৃত্যুতে গভীর শোক এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সহানুভূতি জানিয়েছে বাংলাদেশ গণসঙ্গীত সমন্বয় পরিষদ।

×