
ঈদুল ফিতর উপলক্ষে ঢাকা ছাড়তে শুরু করেছে মানুষ
ঈদুল ফিতর উপলক্ষে ঢাকা ছাড়তে শুরু করেছে মানুষ। ঈদযাত্রায় এবার ঢাকা ছাড়বে এক থেকে দেড় কোটি মানুষ। এছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ঢাকায় ঢুকবে ৩০-৫০ লাখ মানুষ। প্রায় দুই কোটি মানুষ পরিবহনের জন্য নেই পর্যাপ্ত যানবহনের ব্যবস্থা। তাই ঈদযাত্রায় বাড়তি মানুষের চাপ সামাল দিতে পারে না পরিবহন সেক্টর।
প্রতিবছরেই অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহনে ফিটনেসবিহীন ও লক্কড়ঝক্কড় যানবাহন সড়কে নামান পরিবহন মালিকরা। এতে ঘটে দুর্ঘটনা। অতিরিক্ত গাড়ির চাপে সড়ক-মহাসড়কে তৈরি হয় যানজট। সারাদেশে অবাধে চলা ব্যাটারিচালিত রিক্সা ও ইজিবাইকের কারণে এবার ঈদযাত্রায় যানজট আরও তীব্র হবে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
তবে এবার ঈদে নয়দিন ছুটি থাকায় একসঙ্গে অনেক যাত্রীর চাপ কিছুটা কম হবে। কিন্তু সড়কপথে ঢাকা থেকে বের ও প্রবেশের সময় যানজটের ভোগান্তি পোহাতে হবে ঘরমুখো মানুষদের। এছাড়া ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট, ঢাকা-ময়মনসিংহ, ঢাকা-গাজীপুর-টাঙ্গাইল, ঢাকা-উত্তরবঙ্গ মহাসড়কসহ সারাদেশের ১৫৫টি যানজটের ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে দুর্ভোগ পোহাতে হতে পারে ঈদযাত্রার যাত্রীদের। তাই ঈদের আগে ও পরে ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে কঠোর মনিটরিং ও মোবাইল কোর্ট পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগ।
এ বিষয়ে সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. এহছানুল হক জানান, মানুষের ঈদযাত্রা নির্বিঘœ করতে সড়ক বিভাগ থেকে ইতোমধ্যেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাগুলো মেরামত ও সংস্কারের কাজ চলমান, অযাচিত বাস ভাড়া নিয়ন্ত্রণে বাস মালিক সমিতির সঙ্গে কার্যকর আলোচনা হয়েছে এবং চাঁদাবাজি ও সড়কে ডাকাতি প্রতিরোধে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ তৎপর রয়েছে।
ঢাকা ছাড়বে প্রায় দেড় কোটি মানুষ ॥ বুয়েটের এক সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়, ঈদের আগের চারদিনে ঢাকা ছাড়েন এক কোটি ২০ লাখ মানুষ। সে হিসাবে ঈদের সময় প্রতিদিন গড়ে বাড়ি যান ৩০ লাখ মানুষ। কিন্তু ঢাকাকেন্দ্রিক যে গণপরিবহন ব্যবস্থা রয়েছে, সেগুলো দিয়ে বড়জোর দিনে ২২ লাখ মানুষ পরিবহন সম্ভব।
ঈদের আগের কয়েকদিনের প্রতিদিন গড়ে প্রায় আট লাখ মানুষ বাস-মিনিবাসে, এক লাখ পাঁচ হাজার মানুষ ট্রেনে বসে ও দাঁড়িয়ে এবং সোয়া লাখ মানুষ লঞ্চে যাতায়াত করেন। ব্যক্তিগত গাড়ি ও মাইক্রোবাস ভাড়া করে বাড়ি যান সাড়ে সাত লাখ মানুষ। মোটরসাইকেলে ঈদযাত্রায় শামিল হন চার লাখ মানুষ। সমীক্ষা বলছে, আরও আট লাখ মানুষ ট্রাক, অটোরিক্সাসহ নানা অপ্রচলিত বাহনে ভোগান্তি নিয়ে যাতায়াত করেন। এর বাইরে কিছু মানুষ উড়োজাহাজেও যাতায়াত করেন।
এ বিষয়ে বুয়েটের অধ্যাপক হাদীউজ্জামান জানান, ঈদে সাময়িক সময়ের জন্য মহাসড়কের উন্নয়ন কাজ বন্ধ রাখতে হবে। আবার এটাও খেয়াল রাখতে হবে, যাতে ঠিকাদার নির্মাণসামগ্রী যত্রতত্র না রেখে দেন। এমনটা হলে জরিমানা করতে হবে।
এদিকে নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটি জানায়, ঈদুল ফিতর উপলক্ষে আনুমানিক পৌনে দুই কোটি (এক কোটি ৭২ লাখ ৭০ হাজার) মানুষ বৃহত্তর ঢাকা ছাড়বে। তারা ঢাকা, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জ মহানগরসহ ঢাকা বিভাগের বিভিন্ন জেলার বাসিন্দা। এই বিপুলসংখ্যক মানুষের ৬০ শতাংশ যাবে সড়কপথে। বাকি ৪০ শতাংশ নৌ ও রেলপথে যাবে। এই হিসেবে, এবার সড়কপথে ঈদযাত্রীর সংখ্যা হবে এক কোটি তিন লাখ ৬২ হাজার।
ঢাকা থেকে বের হওয়ার পথে ভোগান্তির আশঙ্কা ॥ ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক ঈদের আগে রাস্তা থেকে সরিয়ে না দিলে যানজট প্রকট আকার ধারণ করতে পারেÑ এমনটাই বলছেন সাধারণ মানুষ। এছাড়া ঈদযাত্রায় এবার যাত্রীদের যানজটের ভোগান্তি পোহাতে হবে ঢাকা থেকে বের হওয়ার পথে। রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, দোলাইপাড়, গুলিস্তান ও বাবুবাজার ব্রিজে ঈদের আগেই দীর্ঘ সময় যানজটে আটকে থাকতে হচ্ছে ঘরমুখো মানুষদের।
তবে ঢাকার প্রবেশপথ যানজটমুক্ত রাখতে একাধিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এগুলো হলো- গাবতলী বাস টার্মিনালে একটি নতুন প্রবেশপথ উন্মুক্তকরণ; আবদুল্লাহপুর থেকে ধউর বা আশুলিয়া সড়ক একমুখীকরণ; বিআরটি লেন দিয়ে শুধু আউটগোয়িং যান চলাচলের ব্যবস্থাকরণ; কাঞ্চন থেকে ভুলতা-গাউছিয়া সড়কটিতে দ্রুত চলাচলের জন্য সংস্কারকরণ; ঢাকা বাইপাস রাস্তা (ভোগড়া হতে কাঞ্চনব্রিজ পর্যন্ত) সাময়িকভাবে চালু করা হয়েছে; ঢাকা মেট্রো এলাকায় রেলের লেভেল ক্রসিংগুলোতে সিগন্যালের সময় হ্রাসকরণ; বিমানবন্দর ফুটওভার ব্রিজ মেরামত করা এবং গাবতলী, দোলাইরপাড়, যাত্রাবাড়ী প্রভৃতি এলাকায় প্রয়োজনীয় ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণের প্রস্তাব; মহাখালী বাস টার্মিনাল হতে বাসের সংখ্যা কমানো; প্রশস্ত রাস্তা বা এলাকা থেকে অস্থায়ী আন্তঃজেলা বাস সার্ভিস পরিচালনা (টঙ্গী ইজতেমা মাঠ, ৩০০ ফুট সড়ক, মাদানী এভিনিউ, উত্তরা সেক্টর-১৬ এর বৌ বাজার); এমআরটির ইউটিলিটি স্থানান্তরের কাজ দ্রুত শেষ করার পরামর্শ; আব্দুল্লাহপুর হতে টঙ্গীগামী ফ্লাইওভারের (আউটগোয়িং) র্যাম্পে ২৩ মার্চ চালু করা; কমলাপুর আইসিডির লং ভেহিক্যাল (লরি) রাতে ডিপোর ভেতরে প্রবেশের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জানানো হয়েছে বলে সড়ক ও মহাসড়কের কর্মকর্তারা জানান।
যানজটের ঝুঁকিপূর্ণ ১৫৫ স্থান চিহ্নিত ॥ ঈদযাত্রা নির্বিঘেœ সারাদেশের ১৫৫টি যানজটের ঝুঁকিপূর্ণ স্থান চিহ্নিত করেছে সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগ। ঈদের আগের ও পরে সব স্থানে মনিটরিংয়ের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করার কাজ চলছে। এই সড়কের নারায়ণগঞ্জ থেকে নরসিংদী পর্যন্ত হাটবাজারের কারণে এমনিতেই চাপ থাকে। কিন্তু চার লেনের কাজ চলমান থাকায় কোথাও কোথাও সড়ক সরু হয়ে পড়েছে। কোথাও আবার খানাখন্দের সৃষ্টি হয়েছে।
টাঙ্গাইল-রংপুর পথে চার লেনের কাজ চলছে ছয় বছর ধরে। এখনো কাজ শেষ হয়নি। বিশেষ করে যমুনা সেতুর আগের অংশের কাজ এখনো চলমান। ঈদের শেষ চারদিনে যমুনা সেতু হয়ে প্রতিদিন গড়ে ৫০ হাজারের মতো যানবাহন চলাচল করে। ফলে, ভোগান্তির আশঙ্কা এই পথেও আছে। এর বাইরে ঢাকা-ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন মহাসড়কের নানা স্থানে দুই পাশেই অবৈধ দখলদারদের কারণে সড়ক সংকুচিত হয়ে গেছে।
ঢাকা বাইপাস মদনপুর-ভুলতা-ভোগড়া মহাসড়ক, নবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়ক, ঢাকা-জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ মহাসড়ক, ঢাকা-জয়দেবপুর মহাসড়ক, ঢাকা-চন্দ্রা-এলেঙ্গা মহাসড়ক, এলেঙ্গা-হাটিকুমরুল-বগুড়া-রংপুর মহাসড়ক, ঢাকা-সিলেট, ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-গোপালগঞ্জ-খুলনা, ভাঙ্গা-বরিশাল এবং ঢাকা সিটি করপোরেশন উত্তর বা দক্ষিণের আওতায় সড়কসমূহের মেরামত বা সংস্কার কাজ ঈদের সাতদিন পূর্বেই সম্পন্ন করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের সিনিয়র সচিব এহসানুল হক জানান, ঈদযাত্রা যানজটমুক্ত রাখাতে সম্ভাব্য ১৫৫টি স্পট চিহ্নিত করা হয়েছে। স্পটসমূহ ঈদযাত্রার সময়ে মনিটরিং করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। ঈদযাত্রায় সড়কে কোনো লক্কড়ঝক্কড় গাড়ি চলাচল করতে দেওয়া হবে না। বিআরটিএর পক্ষ থেকে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হবে।
যানজটের সম্ভাব্য স্পটসমূহের মধ্যে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের ৪৯টি, ঢাকা-উত্তরবঙ্গ মহাসড়কের ৫৪টি, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের ছয়টি, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ৪২টি, ঢাকা-পাটুরিয়া-আরিচা মহাসড়কের আটটি স্পট, ঢাকা-ভাঙ্গা-বেনাপোল, ঢাকা-বরিশাল এবং ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে মনিটরিং জোরদার করা হবে।
সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের একাধিক সিদ্ধান্ত ॥ ঈদযাত্রা নিরাপদ ও নির্বিঘœ করতে একাধিক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করছে সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগ। এগুলো হলো- মহাসড়ক যানজটমুক্ত রাখতে ঢাকা-রংপুর, ঢাকা-সিলেটসহ সব জাতীয় মহাসড়কে সব ধরনের সংস্কার কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে; সাতদিনের জন্য সকল উন্নয়ন কাজ বন্ধ রাখা হয়েছে; কাঞ্চনপুর ব্রিজ সংলগ্ন নির্মাণাধীন সড়ক ঈদের সময় খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত; এলেঙ্গা থেকে যমুনা সেতু পর্যন্ত চার লেন এবং ঝাওয়াল ব্রিজ চার লেন ২০ মার্চ চালু করা হয়েছে; ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঘাটুরা ব্রিজ ঈদের আগেই চালু করা হবে।
এছাড়া যানজট নিরসন ও বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে যানজটপ্রবণ এলাকায় বিকল্প সড়ক ব্যবহারের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে এর মধ্যে সদরঘাট, মহাখালী, সায়েদাবাদ, গাবতলী ও ফুলবাড়িয়া টার্মিনালে সিসিটিভি ও সার্চলাইট স্থাপন করা হয়েছে এবং পুলিশ কন্ট্রোলরুমের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়েছে; ১৫৫টি যানজটপ্রবণ স্পট মনিটরিংয়ের আওতায় আনা হয়েছে; ঈদযাত্রার সময় যানবাহন চলাচল পর্যবেক্ষণের জন্য বিশেষ মনিটরিং ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে।
বিশেষ মনিটরিং ও মোবাইল কোর্ট ॥ ঈদের সময় বিভিন্ন মহাসড়কে হাইওয়ে পুলিশ, জেলা প্রশাসন ও ট্রাফিক বিভাগের সমন্বয়ে মনিটরিং টিম গঠন করা হয়েছে। যানবাহনে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় ও লক্কড়-ঝক্কড় যান চলাচল বন্ধে মোবাইল কোর্ট পরিচালিত হচ্ছে।
নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার ॥ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা নিশ্চিত, ঢাকার বিভিন্ন বাস টার্মিনালে হেল্পডেস্ক স্থাপন এবং এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে যানবাহনের গতিসীমা নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। ঈদযাত্রায় পর্যাপ্ত ফেরির ব্যবস্থা করা হয়েছে, যাতে যানজট এড়ানো যায়।
বিআরটিসি বিশেষ ঈদ সার্ভিস চালু করেছে এবং ৭৭৫টি বাস ঢাকা থেকে বিভিন্ন জেলায় পরিচালিত হচ্ছে। গার্মেন্টস শ্রমিকদের জন্য বিশেষ বাস-সার্ভিসের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সিএনজি ও ফিলিং স্টেশন ২৬ মার্চ থেকে ঈদপরবর্তী পাঁচদিন সার্বক্ষণিক খোলা রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
জরুরি সহায়তা কেন্দ্র ও স্বাস্থ্য সেবার দুর্ঘটনা কবলিত যানবাহন দ্রুত সরানোর জন্য রেকার ও উদ্ধারকারী দল প্রস্তুত রাখা হয়েছে। ৯৯৯ এর মাধ্যমে জরুরি চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে মহাসড়কের পাশে হাসপাতালগুলো প্রস্তুত রাখা হয়েছে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের ১৩টি টিম সার্বক্ষণিক প্রস্তুত রয়েছে। টোল আদায় ও সেতু ব্যবস্থাপনা বিষয়ে পদ্মা সেতু, যমুনা সেতু, কর্ণফুলী টানেলসহ প্রধান সেতুগুলোর টোল প্লাজায় পর্যাপ্ত জনবল রাখা হয়েছে।
ইলেকট্রনিক টোল আদায় ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। গার্মেন্টস ও শিল্প-কারখানায় শ্রমিকদের ধাপে ধাপে ছুটি দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়া ঈদযাত্রার সময় যাত্রীদের সহায়তা দেওয়ার জন্য বিআরটিএ কন্ট্রোল রুম সার্বক্ষণিক চালু থাকবে। যোগাযোগের জন্য বিআরটিএ কন্ট্রোল রুমের মোবাইল নম্বর- (০১৫৫০০৫১৬০৬, ০১৫৫০০৫৬৫৭৭ এবং ০১৫৫২১৪৬২২২)।