
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস চীন সফর
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস চীন সফরের তৃতীয় দিন শুক্রবার দেশটির প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে আলোচনায় বসবেন। বৈঠকে রোহিঙ্গাদের নিরাপদে প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করাসহ মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতি বিষয়ে আলোচনা হবে বলে জানিয়েছে পররাষ্ট্র সচিব। রোহিঙ্গাদের শান্তিপূর্ণ প্রত্যাবাসন নিশ্চিৎ করতে চীনের গুরুত্ব অপরিসীম।
সরকারপ্রধান এ ইস্যুকে খুবই গুরুত্ব দিচ্ছে বলেও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়। এদিকে বিশ্লেষকদের মতেও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে চীন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে বলে মতামত দিয়েছেন। এ ছাড়াও ড. ইউনূস-শি জিনপিংয়ের বৈঠকে বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে কৌশলগত বিভিন্ন দ্বিপাক্ষিক ইস্যু, বাণিজ্য এবং বিনিয়োগ বৃদ্ধি, কৃষি, অবকাঠামো, নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে সহায়তাসহ দুই দেশের পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট সার্বিক বিষয় নিয়ে আলোচনার কথা রয়েছে।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে প্রত্যাশা ॥ পররাষ্ট্র সচিব জানান, রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে বিগত কয়েক বছর যাবৎ কাজ করা হচ্ছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বিভিন্নভাবে চেষ্টা করা হচ্ছে সমস্যার স্থায়ী সমাধানের। এ বিষয়ে চীন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে বলে জানান পররাষ্ট্র সচিব। ড. ইউনূস-শি জিনপিং বৈঠকে রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে আলোচনা হবে। বিশেষ করে মিয়ানমার বর্তমানে কোন পরিস্থিতিতে আছে, সে বিষয়ে এ বৈঠকে আলোচনা করা হবে। সে আলোাচনা থেকে রোহিঙ্গাদের নিয়ে কীভাবে কাজ করা যায়, সে বিষয়ে আলোচনা করবে সরকার।
মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে আলোচনায় চীনও সহায়তা করেছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা এ বৈঠকে যেটি করছি যে, মিয়ানমারের অভ্যন্তরে যে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সেটি নিয়ে চীন কী ভাবছে তা আমরা দেখতে পারি। আমাদের চিন্তা তাদের জানাতে পারি।’
পররাষ্ট্র সচিব বলেন, ‘চীন আমাদের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বন্ধু এবং আমরা সেই বন্ধুত্বকে ধারণ করি। চীনের দিক থেকেও একই ধরনের মনোভাব আছে এবং প্রধান উপদেষ্টার প্রথম দ্বিপাক্ষিক সফর হিসেবে চীনকে বেছে নেওয়ার মধ্য দিয়ে একটি বার্তা আমরা দিচ্ছি।’
এ বিষয়ে চীনে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহম্মেদ জনকণ্ঠকে বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে চীনের গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ চীনের সঙ্গে মিয়ানমারের সম্পর্ক অনেক ভালো। মিয়ানমারের সঙ্গে চীনের বাণিজ্যিক সম্পর্কও রয়েছে। সেজন্য ড. ইউনূস চীনের সঙ্গে কূটনৈতিকভাবে সফল হলে রোহিঙ্গা ইস্যুতে কূটনৈতিক সফলতা আসবে।
তিনি বলেন, চীন গুরুত্বপূর্ণ, তবে একমাত্র সমাধান শুধু চীন, এটা ভাবা ঠিক হবে না। চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও রাশিয়া এক হলেই কেবল রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন হতে পারে, অন্যথায় কষ্ট হয়ে যাবে। তবে আমরা সবাই চাই রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধান হোক। ড. ইউনূস তার ডিপ্লোম্যাসি দিয়ে কাজ করলে হয়তো সমাধান কিছুটা সফলতার মুখ দেখবে। তিনি বলেন, ‘এই সফর থেকে আমাদের প্রত্যাশা বহুমাত্রিক।
চুক্তি ও ঘোষণা ॥ প্রধান উপদেষ্টার সফরে বেশ কয়েকটি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হতে পারে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র সচিব। এ ছাড়া কিছু ঘোষণা আসতে পারে জানিয়ে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, ‘এরমধ্যে রয়েছে পানি সম্পর্ক উন্নয়নে অর্থনৈতিক ও কারিগরি সহায়তা, সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়াবিষয়ক সহায়তা এবং গণমাধ্যম বিষয়ক সহযোগিতা।’
পররাষ্ট্র সচিব জসীম উদ্দিন জানান, অর্থনৈতিক বিনিয়োগ, অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিনিয়োগ, এবং গণমাধ্যম সংক্রান্ত বিষয়ক প্রস্তাবনা আসার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
স্বাস্থ্য খাতে সহযোগিতা ॥ চীন বাংলাদেশী রোগীদের জন্য চারটি হাসপাতাল ইতোমধ্যে তৈরি করেছে। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা করার জন্য বাংলাদেশ থেকে রোগীদের পাঠানো হয়েছে এবং চিকিৎসাও সম্পন্ন করেছে। সেখানে বাংলাদেশের রোগীদের অনুকূল পরিবেশও রয়েছে বলে জানান পররাষ্ট্র সচিব।
বাংলাদেশ-চীন সম্পর্কের ৫০ বছর ॥ দু’দেশের সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তিতে বাংলাদেশে একটি বিশেষায়িত হাসপাতাল করবে চীন। আর সেটিই হবে ৫০ বছর পূর্তির প্রথম সোপান। তিনি বলেন, ‘চীনে বাংলাদেশী রোগীদের প্রথম ব্যাচ গেছে। আমি যতটুকু জানতে পেরেছি, তারা চিকিৎসাসেবায় সন্তুষ্ট। এ ছাড়া বাংলাদেশী রোগীদের জন্য কুনমিংয়ে চারটি হাসপাতাল চিহ্নিত করা হয়েছে।’
সচিব বলেন, আমাদের প্রত্যাশা, সামনের সময়ে এই সহযোগিতা আরও বাড়বে এবং চীন বাংলাদেশে একটি বিশেষায়িত হাসপাতাল করবে, যেটি বাংলাদেশ ও চীনের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের যে সুবর্ণজয়ন্তী, তার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ বিষয় হবে। এ বিষয়টিকে জোর দেওয়ার জন্য আমরা শীর্ষ পর্যায়ে কথা বলব।’
সামরিক সহযোগিতা ॥ পররাষ্ট্র সচিব বলেন, চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সামরিক চুক্তি অনেক আগে থেকেই ছিল। সে অবস্থান থেকে সে বিষয়ে আলোচনা হতে পারে। তবে নতুন করে কোনো সামরিক চুক্তি হবার সম্ভাবনা নেই।
‘আমাদের দিক থেকে সাধারণভাবে চীনের সঙ্গে যে সামরিক সহযোগিতা আগে থেকেই ছিল, বর্তমানেও থাকবে। তবে এ সফরে চীনের সঙ্গে সাধারণ আলোচনা হতে পারে সাংবাদিকদের জানান পররাষ্ট্র সচিব।
তিস্তা নিয়ে আলোচনা ॥ চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ও প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের মধ্যে বৈঠকে তিস্তা প্রকল্প নিয়ে আলোচনার কথা রয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন পররাষ্ট্র সচিব মো. জসীম উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘এ ছাড়াও স্বাস্থ্য, রোহিঙ্গা, জিডিআই, জিপিআই অর্থনৈতিক সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা হতে পারে।’
মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টার চীন সফর উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিস্তা নিয়ে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, ‘চীনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে যে বৈঠকটি হবে, সেটি শীর্ষ নেতৃত্ব তাদের পছন্দ অনুযায়ী কথা বলবেন। তবে, আমাদের দিক থেকে এবং চীনের দিক থেকে পানি ব্যবস্থাপনার বিষয়ে কথা বলার আগ্রহ আছে। পানি ব্যবস্থাপনার আওতায় তিস্তা প্রকল্প নিয়ে কথা বলার সুযোগ আছে।’
উল্লেখ্য, চীনের হাইনান প্রদেশে বোয়াও সম্মেলন এবং বেজিংয়ে চীনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠক করার জন্য আজ বুধবার চীনের উদ্দেশে রওনা দেবেন প্রধান উপদেষ্টা। আগামীকাল ২৭ মার্চ বোয়াও সম্মেলনের প্লেনারি সেশনে বক্তব্য রাখবেন তিনি। ২৮ মার্চ চীনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তার বৈঠক হবে। ২৯ মার্চ পিকিং বিশ্ববিদ্যালয় প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসকে বিশেষ সম্মাননা জানাবে।