ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৬ মার্চ ২০২৫, ১২ চৈত্র ১৪৩১

জাতির উদ্দেশে ভাষণে ড. ইউনূস

ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন

বিশেষ প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ২৩:৪২, ২৫ মার্চ ২০২৫

ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন

জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস দলমত নির্বিশেষে সবাই যেন পরাজিত শক্তির সকল প্ররোচনা সত্ত্বেও সুদৃঢ় ঐক্যবদ্ধ থাকেন সেই প্রত্যাশা ব্যক্ত করে বলেছেন, জুলাই অভ্যুত্থানের প্রথম পর্ব সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। প্রথম পর্বের সমাপ্তির মধ্য দিয়ে অভ্যুত্থানের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হলো। সব সময় মনে রাখতে হবে আমরা কিন্তু যুদ্ধাবস্থায় আছি।

‘গুজব’ হলো এই জুলাই অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে পরাজিত শক্তির মস্ত বড় হাতিয়ার। আমাদের সামগ্রিক ঐক্য পলাতক শক্তির গায়ে জ্বালা ধরিয়ে দিচ্ছে। তারা এই ঐক্য ভাঙ্গতে চায়। আমাদের সচেতনতা ও সামগ্রিক ঐক্য দিয়েই এই গুজবকে রুখতে হবে, পলাতক অপশক্তির ষড়যন্ত্রকে ব্যর্থ করে দিতে হবে।
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় মহান স্বাধীনতা দিবস ও পবিত্র ঈদুল ফিতর উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে ড. ইউনূস এ কথা বলেন। এ বছর ডিসেম্বর থেকে আগামী জুনের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ঐকমত্য কমিশনের মাধ্যমে সকল রাজনৈতিক দলের মতামত নেওয়ার কাজ এখন চলমান আছে।

কমিশনের লক্ষ্য হচ্ছে যে সকল বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হবে সেগুলো চিহ্নিত করা এবং তার একটা তালিকা প্রস্তুত করা। যে সকল দল এতে একমত হয়েছে তাদের স্বাক্ষর নেওয়া। এই তালিকাটিই হবে জুলাই চার্টার বা জুলাই সনদ। 
তিনি বলেন, আমাদের দায়িত্ব জাতির সামনে পুরো প্রক্রিয়াটা স্বচ্ছভাবে তুলে ধরা এবং প্রক্রিয়া শেষে নির্বাচনের আয়োজন করা। আমরা চাই, আগামী নির্বাচনটি বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হোক। এ জন্য নির্বাচন কমিশন সব ধরনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। রাজনৈতিক দলগুলোও ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনায় নির্বাচনের জন্য তৈরি হতে শুরু করবে বলে আশা করছি। 
দ্রবমূল্য নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, রমজান মাসজুড়ে সরবরাহ চেনের প্রতিবন্ধকতা কঠোরভাবে প্রতিহত করতে সব ধরনের ব্যবস্থা আমরা নিয়েছি। দেশের সব জায়গা থেকে খবর এসেছে যে এই রমজানে দ্রব্যমূল্য আগের তুলনায় কমেছে, জনগণ স্বস্তি পেয়েছে। 
গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় গুজবের মহোৎসব চলছে ॥ প্রধান উপদেষ্টা জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় গুজবের যেন এক মহোৎসব চলছে। দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য একের পর এক মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা চলছে। অভিনব সব প্রক্রিয়ায় গুজব ছড়ানো হচ্ছে।

এক ছবির সঙ্গে অন্য ছবি জুড়ে দেওয়া হচ্ছে, ঘটনা একটা ছবি আরেকটা এ রকম ফটোকার্ড বানিয়ে, অন্য দেশের ঘটনাকে এ দেশের ঘটনা হিসেবে চালিয়ে দিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় তোলপাড় করে ফেলছে। যতই নির্বাচন কাছে আসবে এর রূপ আরও ভয়ংকর হতে থাকবে। কারা এর পেছনে আছে, কেন আছে তা আপনাদের সবারই জানা আছে।
তিনি বলেন, আমরা এই গুজব ও মিথ্যা তথ্যের প্রচারণা রোধ করতে জাতিসংঘের সহযোগিতা চেয়েছি। জাতিসংঘ মহাসচিবের মোকাবিলায় আমাদের সহযোগিতা করবেন বলে আশ্বাস দিয়ে গেছেন। তিনি বলেন, ‘গুজব’ হলো এই জুলাই অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে পরাজিত শক্তির মস্ত বড় হাতিয়ার। গুজব দেখলেই গুজবের সূত্রের সন্ধান করতে থাকবেন।

গুজবকে অবহেলা করবেন না। বহু অভিজ্ঞ সমর বিশারদ এই গুজবের পেছনে দিনরাত কাজ করছে, সীমাহীন অর্থ এর পেছনে নিয়োজিত আছে। এর মূল লক্ষ্য জুলাই অভ্যুত্থানকে ব্যর্থ করা। আমরা তাকে ব্যর্থ হতে দেব না।
নির্বিচারে গণহত্যা সম্পর্কে জাতিসংঘের রিপোর্ট ভয়াবহ ॥ প্রধান উপদেষ্টা বলেন, পতিত স্বৈরাচারের নিপীড়নের বর্ণনা উঠে এসেছে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয়ের রিপোর্টে। গত জুলাই-আগস্ট মাসে বাংলাদেশে ছাত্র-শ্রমিক-জনতার ওপর শেখ হাসিনা সরকার ও আওয়ামী লীগ যে দমন-নিপীড়ন ও হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে এর পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত করে বিস্তারিত রিপোর্ট প্রকাশ করেছে তারা।
তিনি বলেন, এই রিপোর্টে স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে যে, শেখ হাসিনা নিজেই নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন বিক্ষোভকারীদের হত্যা করতে। বিগত সরকার, আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগের সহযোগী গোষ্ঠী ও সংগঠন একত্রিত হয়ে পরিকল্পিতভাবে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনে জড়িত ছিল।

মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের রিপোর্টে বলা হয়েছে, বিক্ষোভ চলাকালে প্রায় ১৪শ’ জন নিহত হয়েছেন। যার মধ্যে প্রায় ১৩ শতাংশ শিশু। বিক্ষোভের সম্মুখসারিতে থাকার কারণে, আমাদের জুলাই-কন্যারা নিরাপত্তা বাহিনী ও আওয়ামী লীগ সমর্থকদের দ্বারা আক্রান্ত  হয়েছে, এমনকি যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, জাতিসংঘের রিপোর্ট পড়ে সবার গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেছে। কী ভয়াবহতা! কীভাবে একজন প্রধানমন্ত্রী নিজ দেশের নিরস্ত্র মানুষকে হত্যার পর লাশ লুকিয়ে ফেলার নির্দেশ দিতে পারে! ক্ষমতা আঁকড়ে রাখার জন্য তিনি পৃথিবীর সকল নিষ্ঠুরতা ছাড়িয়ে গেছেন এটাই জাতিসংঘের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার কার্যালয়ের এই রিপোর্টকে আমরা স্বাগত জানাচ্ছি।

প্রতিবেদনে যে সুপারিশ করা হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার সে সুপারিশগুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে। দেশবাসীকে আশ্বস্ত করে বলতে চাই, যারা গণহত্যায় জড়িত ছিল, যারা নির্বিচারে মানুষ হত্যা করেছে, যারা ইতোমধ্যে হত্যাকারী হিসেবে বিশ্বের কাছে স্বীকৃত তাদের বিচার এদেশের মাটিতে হবেই।
ধ্বংসপ্রাপ্ত অর্থনীতিতে স্বস্তি ফিরে এসেছে ॥ পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দেশে ভয়াবহ দুর্নীতি-লুটপাটের কথা উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা তাঁর ভাষণে বলেন, গত ১৬ বছরে শেখ হাসিনা যে ভয়াবহ লুটপাট কায়েম করেছিল; আপনারা সেটার ভুক্তভোগী ছিলেন। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে তারা পালিয়ে যাবার সময় এক ল-ভ- অর্থনীতি রেখে গেছে। এই পরিস্থিতিতে দায়িত্ব নেওয়ার পর অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের জন্য অন্তর্বর্তী সরকার নানা উদ্যোগ নিয়েছে।
তিনি বলেন, ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফিরেছে, ক্রমান্বয়ে অর্থনীতির অপরাপর সূচকগুলো ইতিবাচক ধারায় ফিরতে শুরু করছে। এ সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ মূল্যস্ফীতি। ফেব্রুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৩২ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে, যা ২২ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। আগামী জুন মাসের মধ্যে এটি ৮ শতাংশের নিচে নেমে আসবে বলে আশা করছি।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, দেশের ধ্বংসপ্রাপ্ত অর্থনীতিতে স্বস্তি এনে দিয়েছে আমাদের প্রবাসী ভাই-বোনরা। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে রেমিটেন্স ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। ফেব্রুয়ারি মাসে রেমিটেন্স প্রবাহ রেকর্ড গড়েছে, প্রায় ২৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে আড়াই বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। 
ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, গত সরকারের লুটপাটের মহোৎসবে গত ১৫ বছরে ২৩৪ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে- এটা আমরা জানি। কত রকমভাবে পাচার হয়েছে তাও জানার বিষয়। অভিনব একেকটা পদ্ধতি ছিল। পাচারের একটা পদ্ধতি সবাইকে হতভম্ব করে দিয়েছে। এই পাচার হয়েছে- বিদেশে অধ্যয়নরত সন্তানের কাছে টাকা পাঠানোর নামে। তিনি সন্তানের লেখাপড়ার জন্য এক সেমিস্টারের অর্থাৎ তিন মাসের খরচ বাবদ অফিসিয়াল ব্যাংকিং চ্যানেলে পাঠিয়েছেন তিন কোটি ৩৩ লাখ ডলার অর্থাৎ প্রায় ৪০০ কোটি টাকা।

পাচারের এর চাইতে বেশি তাক লাগানো পন্থা আর কী আছে তার কোনো সীমা আছে বলে আমার মনে হয় না। আইন, নিয়ম, নীতির জায়গায় যখন হরিলুট প্রতিষ্ঠিত হয় তখন এমন সবকিছুই সম্ভব। এই অর্থ পাচারকারীদের দ্রুত আইনের আওতায় নিয়ে আসার লক্ষ্যে ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক তৎপরতা জোরদার করা হয়েছে।
দুর্নীতিমুক্ত হওয়া ছাড়া দেশের গতি নেই ॥ দুর্নীতি ও হয়রানি রোধে অন্তর্বর্তী সরকার গুরুত্ব দিচ্ছে উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা সীমাহীন দুর্নীতি।  স্বৈরাচারী সরকার এই দুর্নীতিকে বিশ্বের শীর্ষ স্থানে নিয়ে গেছে। দুর্নীতির ফলে শুধু যে সবকিছুতে অবিশ্বাস্য রকম ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে তাই না, এর ফলে সরকার ও জনগণের সকল আয়োজন বিকৃত হয়ে যায়। 
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, পুরো বিশ্ব বুঝে গেছে, আমরা জাতি হিসেবে সততার পরিচয় বহন করি না। এটা শুধু জাতীয় কলঙ্কের বিষয় নয়, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে এটা আত্মঘাতী বিষয়। দেশবাসীর মতো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও চায় আমরা দুর্নীতিমুক্ত হই, কারণ তারা আমাদের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণ করতে চায়। দুর্নীতিমুক্ত হতে না পারলে ব্যবসা-বাণিজ্য কিছুই চলবে না। দুর্নীতি থেকে মুক্ত হওয়া ছাড়া বাংলাদেশের কোনো গতি নেই।
তিনি বলেন, দুর্নীতি ও হয়রানি রোধে আমরা একটা বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছি। সরকারের সঙ্গে দৈনন্দিন, মাসিক বা বার্ষিক রুটিন কাজের জন্য যেন কোনো নাগরিককে সশরীরে কোনো সরকারি অফিসে উপস্থিত হতে না হয়। দুর্নীতি প্রতিরোধের অংশ হিসেবে সরকারি সব অফিসে ই-ফাইলিং চালুর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, ই-ফাইলিং ব্যবস্থা চালু হলে দুর্নীতি কমে আসবে। এতে করে কোন অফিসের কোন ডেস্কে কোন ফাইল আটকে আছে তা সহজেই জানা যাবে। 
হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহার করা হচ্ছে ॥ প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বিগত সরকারের আমলে ভিন্নমতকে দমন করার জন্য মিথ্যা মামলাকে হাতিয়ার হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছিল। বিভিন্ন পর্যায়ে যাচাই-বাছাই করে আমরা এসব হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারের উদ্যোগ নিয়েছি। গত ফ্যাসিস্ট সরকারের সময় দায়ের করা রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলাগুলোর মধ্যে সারাদেশে এ পর্যন্ত ৬ হাজার ২৯৫টি মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ করা হয়েছে।

অন্যান্য সকল হয়রানিমূলক মামলাও ক্রমান্বয়ে প্রত্যাহার করা হচ্ছে। এ ছাড়া এ পর্যন্ত সাইবার সিকিউরিটি আইনের অধীনে বিচারাধীন স্পিচ অফেন্স সংক্রান্ত ৪১৩টি মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে। এই আইনটি অবিলম্বে বাতিল করে নাগরিকবান্ধব সাইবার সুরক্ষা আইন করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, মানুষের ভোগান্তি রোধেও আমরা আইনগত পদক্ষেপ নিচ্ছি। জিডি করার সময় স্বাক্ষর দেওয়ার জন্য এখন আর থানায় যাওয়ার প্রয়োজন নেই। এটা অনলাইনেই করা যাবে। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পাওয়ার অব অ্যাটর্নি বিধিমালায় সংশোধনীর মাধ্যমে প্রবাসী বাংলাদেশীদের হয়রানি লাঘব করা হয়েছে।

সংশোধিত বিধিমালার আলোকে বাংলাদেশী পাসপোর্ট না থাকলেও বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ব্যক্তির পাসপোর্টে ‘নো ভিসা রিক্যুয়ার্ড’ স্টিকার থাকলে কিংবা জন্ম সনদ বা জাতীয় পরিচয়পত্র থাকলেই তিনি বিদেশ থেকে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি সম্পাদন করতে পারবেন।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, সরকারি সিদ্ধান্ত ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার পর বিমানের টিকিট কেনার পুরো প্রক্রিয়াটি অনলাইনে নিয়ে যাওয়ায় ফলে বিমানের টিকিটের দাম শতকরা ৫০ থেকে ৭৫ ভাগ কমে গেছে। 
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, রাজস্ব সংস্কার কমিশনের সুপারিশ অনুসারে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বিলুপ্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এর জায়গায় দুটি পৃথক বিভাগ করা হচ্ছে। একটি হলো নীতি প্রণয়ন বিভাগ বা জাতীয় রাজস্ব নীতি বোর্ড, অন্যটি বাস্তবায়ন বিভাগ বা জাতীয় রাজস্ব সংগ্রহ বিভাগ। এর ফলে সরকারের পছন্দের ব্যক্তিরা হাজার হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার আর সুযোগ পাবে না। আমি আশা করি পরবর্তীতে যারা সরকারে আসবেন তারাও এই নীতি বহাল রাখবেন।
বিশ্ব মানচিত্র বাংলাদেশ অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া হবে ॥ বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া আমাদের অন্যতম লক্ষ্য উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এ লক্ষ্যে আমরা আসিয়ানের সদস্য হিসেবে যোগদান করার বিষয়ে আগ্রহের কথা জানিয়েছি। এ বছরের শুরু থেকে মালয়েশিয়া আসিয়ানের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব গ্রহণ করেছে।

মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা হয়েছে। তিনি আমাদের আবেদনের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন, আমাকে মালয়েশিয়া সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। আমি এই আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছি।
তিনি বলেন, মালয়েশিয়া রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের জন্য জাতিসংঘের সম্মেলন আয়োজনের দায়িত্ব নিয়েছে। আমাদের দেশ থেকে শ্রমিক নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে যে সমস্ত সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল সব সমাধানের জন্য আন্তরিকভাবে তারা কাজ করছে। চারদিনের সফরে আমি চীন যাচ্ছি। প্রেসিডেন্ট শি চিন পিংয়ের সঙ্গে আমার বৈঠক হবে। চীনের বড় বড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের সিইওদের সঙ্গেও বৈঠক করব। 
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বরাবরই বলে এসেছি, আমরা মহা সৌভাগ্যবান এক জাতি, পৃথিবীর মানচিত্রে আমাদের অবস্থানের কারণে। বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও ভুটান-দক্ষিণ এশিয়ার এই চারটি দেশ মিলে একটি যৌথ অর্থনীতি গড়ে তুলতে পারলে চার দেশই লাভবান হবে। নেপাল ও ভুটান আমাদের জলবিদ্যুৎ দিতে অত্যন্ত আগ্রহী, আমরাও নিতে আগ্রহী। বাংলাদেশের শিল্পাঞ্চল গড়ে তুলতে এর কোনো বিকল্প নেই।
তিনি বলেন, আমাদের পণ্য, পৃথিবীর পণ্য। এই পণ্য নেপালে যাবে, ভুটানে যাবে, ভারতের সেভেন সিস্টার্সে যাবে। প্রতিবেশীদের পণ্য আমাদের এখানে আসবে, সারা পৃথিবীর কাছে পৌঁছে যাবে, এভাবেই এটি একটি লাভজনক অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে দাঁড়িয়ে যাবে। আর এ অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় থাকবে বাংলাদেশ।
স্টারলিংক ডিজিটাল জগতে বিপ্লব আনবে ॥ স্টারলিংকের প্রতিষ্ঠাতা এবং বিশ্বের শীর্ষ ধনকুবের স্পেস এক্স ও টেসলার মালিক ইলন মাস্কের সঙ্গে তাঁর ফোনালামের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ফোনে আলাপ করে বাংলাদেশে স্টারলিংকের কার্যক্রম শুরু করার আহ্বান জানিয়েছি। সে অনুসারে, কোম্পানির প্রতিনিধিরা এখন বাংলাদেশে তাদের কার্যক্রম শুরুর আয়োজন করছে। তাদের সঙ্গে তিন মাসের মধ্যে বাণিজ্যিক চুক্তি চূড়ান্ত করার কাজ চলছে।
তিনি বলেন, স্টারলিংকের মাধ্যমে স্বল্পমূল্যে উচ্চগতির ইন্টারনেট বাংলাদেশের ডিজিটাল জগতে একটি বিপ্লব আনবে। স্টারলিংক সেবা চালু হলে দেশের প্রতিটি গ্রাম, দ্বীপাঞ্চল, দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চল অতি উচ্চগতির ইন্টারনেট সেবার আওতায় চলে আসবে। স্টারলিংক চালু হলে ভবিষ্যতে কোনো সরকার ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে মানুষকে আর তথ্যবন্দি করার কোনো সুযোগ পাবে না।

বাংলাদেশের প্রতিটি অঞ্চলে বিশ্বমানের শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যাবে। আমাদের নতুন প্রজন্ম দেশের যে কোনো প্রত্যন্ত অঞ্চলেই থাকুক না কেন তারা বিশ্ব নাগরিক হয়ে গড়ে ওঠার সুযোগ পাবে।
নারীদের অধিকার রক্ষায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ॥ প্রধান উপদেষ্টা বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশের প্রেক্ষিত বদলে দিয়েছে। জুলাইয়ের পর নারীদের অবস্থান ইতিবাচকভাবে পরিবর্তন হবে সেটাই আমরা চাই। আমরা বাংলাদেশ নিয়ে নতুন করে ভাবতে চাই। আর এই নতুন ভাবনায় নারীদের অবস্থান উচ্চতম পর্যায়ে অগ্রাধিকার পাক সেটাই আমরা চাই।

পরিবারের সকল সদস্য, পাড়া-প্রতিবেশী, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, স্কুল আপনারা আপনাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে ছেলে শিশু ও মেয়ে শিশুর মধ্যে যেন কোনো বৈষম্য না সৃষ্টি না হয় তা নিশ্চিত করুন। আসুন, নতুন বাংলাদেশে সবাই মিলে শিশুদের জন্য সুস্থ পরিবেশ নিশ্চিত করি। তিনি বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া নারীরা তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

দেশে বিরাজমান বৈষম্যগুলো চিহ্নিত করে নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ ও বৈষম্য নিরসনে আমাদের প্রত্যেককে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। নারীর প্রতি বিদ্বেষমূলক কথাবার্তা, নারীকে খাটো করে রাখার প্রবৃত্তি যারা ধারণ করে তাদের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা প্রয়োজন।

×