
একাত্তরের এদিন সত্যিই খুলে গিয়েছিল সবকটি জানালা
‘সবকটা জানালা খুলে দাওনা/ আমি গাইব গাইব বিজয়েরই গান/ ওরা আসবে চুপি চুপি/ যারা এই দেশটাকে ভালোবেসে দিয়ে গেছে প্রাণ/....।’
একাত্তরের এদিন সত্যিই খুলে গিয়েছিল সবকটি জানালা। পরাধীনতার আঁধার পেরিয়ে আসে আলোকিত মুক্তির জোয়ার। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বর ও নির্বিচারে গণহত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও সর্বব্যাপী পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে বাঙালি তাদের সর্বশক্তি নিয়ে ইস্পাতকঠিন প্রত্যয় নিয়ে সশস্ত্র লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
সারাদেশে শুরু হয় প্রতিরোধ যুদ্ধ। দেশের অকুতোভয় দুঃসাহসী বাঙালি প্রাণপণ লড়াই করে লাখো প্রাণের বিনিময়ে ছিনিয়ে আনে হাজার বছরের লালিত স্বপ্নÑ মহার্ঘ্য স্বাধীনতা। আজ মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস।
নিত্যদিনের মতো আজও ভোরের সূর্যালোকের বর্ণচ্ছটায় রাঙাবে কৃষ্ণচূড়া, গ্রামীণ পথের শেষে নদীর তীরে অশ্বত্থ শাখা থেকে ভেসে আসবে কোকিলের কুহুতান, শ্যামল প্রান্তরের দূর-দূরান্ত থেকে আজ বাজবে রাখালিয়ার মনকাড়া বাঁশির সুর, নীল আকাশের বুকে ডানা মেলবে উড়ন্ত বলাকার ঝাঁক, কলকাকলিতে মুখরিত হবে জনপদ।
তবুও অন্য যে কোনো দিনের চেয়ে আজকের দিনটি সম্পূর্ণ আলাদা। ভিন্ন আমেজের, ভিন্ন অনুভূতির। কারণ আজ এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা ৫৪ বছর পূরণ করে ৫৫ বছরে পা রাখল। বাঙালি জাতির হাজার বছরের লালিত স্বপ্নের মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস। জাতীয় জীবনের সবচেয়ে গৌরবের অধ্যায়। উদ্যাপনের শ্রেষ্ঠতম মুহূর্ত। আজকের দিনে বাঙালি তার স্বর্ণ অতীতের দিকে ফিরে তাকাবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশকে এগিয়ে নেওয়ার নতুন শপথ, নব উজ্জীবন ঘটবে জাতীয় জীবনে।
আজ ২৬ মার্চ। রক্ত, অশ্রুস্নাত বিক্ষুব্ধ বিদ্রোহের দিন। বাঙালির শৃৃঙ্খলমুক্তির দিন। বাঙালির দীর্ঘ স্বাধিকার আন্দোলনের চূড়ান্ত লড়াইয়ের সূচনাকাল। বিশ্বের বুকে লাল-সবুজের পতাকা ওড়ানোর দিন আজ। মহার্ঘ্য স্বাধীনতা। কিন্তু বাঙালি জাতিকে এজন্য দিতে হয়েছে চরম মূল্য।
হাজার বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে ১৯৭১ সালের এই দিনে বিশ্বের বুকে স্বাধীন অস্তিত্ব ঘোষণা করেছিল বীর বাঙালি। দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র দেশ হিসাবে স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল এ ব-দ্বীপের মানুষ। ইতিহাসের পৃষ্ঠা রক্তে রাঙিয়ে, আত্মত্যাগের অতুলনীয় দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করে একাত্তরের এই দিনে যে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এ দেশের মানুষ, দীর্ঘ ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন তার চূড়ান্ত পরিণতি। রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের সূচনার সেই গৌরব ও অহঙ্কারের দিন আজ। প্রতিবছর মহান স্বাধীনতা দিবস জাতির জীবনের প্রেরণায় উজ্জীবিত হওয়ার নতুন বার্তা নিয়ে আসে।
ভয়াল ‘কালরাত্রি’র পোড়া কাঠ, লাশ আর জননীর কান্না নিয়ে রক্তে রাঙা নতুন সূর্য উঠেছিল ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ। ভয়াল কালরাতের ধ্বংসস্তূপ আর লাশের ভেতরে দিয়ে রক্ত রাঙা সেই নতুন সূর্য। ভীতবিহ্বল মানুষ দেখল লাশপোড়া ভোর। সারি সারি স্বজনের মৃতদেহ। আকাশে কু-লী পাকিয়ে উঠছে ধোঁয়া। পুড়ছে স্বাধীন বাংলার মানচিত্র আঁকা লালসবুজ পতাকা। জ্বলছে শাড়ি, খুকুর ফ্রক। চোখে জল। বুকে আগুন। জ্বলে উঠল মুক্তিকামী মানুষের চোখ, গড়ল প্রতিরোধ। মৃত্যুভয় তুচ্ছ করে তীব্র সেøাগান তুলে ট্যাঙ্কের সামনে এগিয়ে দিল সাহসী বুক।
একাত্তরের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে পাকিস্তানি হিংস্র শ্বাপদের গণহত্যার বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা। শত্রুসেনাদের বিতাড়িত করতে শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে জীবনপণ সশস্ত্র লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে বীর বাঙালি। দীর্ঘ ৯ মাস এক সাগর রক্তের বিনিময়ে ছিনিয়ে আনে হাজার বছরের বাঙালির শ্রেষ্ঠতম অর্জন- মহান স্বাধীনতা।
আজ ভোরের সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গেই বাঙালি জাতির জীবনে সূচনা ঘটবে আরও একটি ঝলমল উৎসব দিনের। রক্ত, অশ্রুস্নাত বিক্ষুব্ধ বিদ্রোহের দিন ২৬ মার্চ। এ ভূ-ভাগের সবচেয়ে বড় অর্জন, বাঙালির সহস্র বছরের জীবন কাঁপানো ইতিহাস- মহান স্বাধীনতা। অসংখ্য শহীদের রক্তে ভেজা, জাতির বীরসেনানীদের রক্তস্নাত মুক্তিযুদ্ধের সূচনা দিন। বাঙালির স্বাধীনতার ঘোষণা ও মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিন। গৌরব ও স্বজন হারানোর বেদনার এই দিনে বীর বাঙালি সশস্ত্র স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনা করেছিল। তাই আজ গৌরব ও অহঙ্কারের দিন।
দেশের মহার্ঘ্য স্বাধীনতার ৫৪ বছরের এই ক্ষুদ্র পরিসরে দেশ ও জাতি অনেক ঘটন-অঘটন, চড়াই-উৎরাইয়ের সাক্ষী হয়েছে। সময়ে সময়ে এসব ঘটনা সমগ্র জাতিকে আন্দোলিত করেছে, পাল্টে দিয়েছে এর গতিপথ। কখনো জাতির জীবনে এসেছে হতাশা-অন্ধকারাচ্ছন্ন মুহূর্ত, কখনো বা হয়েছে সুন্দর আগামীর প্রত্যাশায় উজ্জীবিত।
যদিও ৫৪ বছর একটি জাতির জীবনে খুব বড় পরিসর নয়, গড় আয়ুর নিরিখে হয়তোবা একটি প্রজন্ম মাত্র, তথাপি পরাধীনতার শিকল ভেঙে বেরিয়ে আসা সহ¯্র বছরের ঐতিহ্য সমৃদ্ধ আত্মমর্যাদায় বলীয়ান একটি জাতির সামনে অর্ধশতাব্দীর এই মাইলফলক অনেককিছুই বদলে দিয়েছে। নতুন প্রজন্মের সামনে দুর্নীতি, দুঃশাসনমুক্ত, নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন।
অতীতের সকল কালিমা মুছে ফেলে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক- শোষণ ও হানাহানিমুক্ত শান্তির বাংলাদেশ গড়ার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়েই এবার বাঙালি জাতি নানা কর্মসূচির মাধ্যমে স্বাধীনতা দিবস পালন করছে। স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে আজ সরকারি ছুটির দিন। দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস পৃথক বাণী দিয়েছেন।
এ ছাড়া দিবসটি উপলক্ষে রেডিও, টেলিভিশন, ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়া ও সংবাদপত্রে বিশেষ নিবন্ধ ও অনুষ্ঠানমালা প্রচার করা হচ্ছে। পথে পথে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সকল বাঙালির কণ্ঠে উচ্চারিত হবে-‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী ভয় নাই ওরে, ভয় নাই। নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই...।’
যাঁদের রক্ত ও সম্ভ্রমের মূল্যে আমরা পেয়েছি মহামূল্যবান এই স্বাধীনতা, তাঁদের কাছে মহামূল্য ঋণ গভীর কৃতজ্ঞতা, ভালোবাসা ও বিনম্র শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবার দিন আজ। মহান স্বাধীনতা দিবসে জাতি আজ গভীর শ্রদ্ধা, ভালোবাসা আর বেদনায় স্মরণ করবে মহান মুক্তিযুদ্ধের লাখো শহীদকে। জাতি শ্রদ্ধা জানাবে বীরাঙ্গনা আর শহীদমাতাদের।
দৃপ্ত শপথ নেবে দুর্র্নীতি, সন্ত্রাস, শোষণ ও হানাহানিমুক্ত নতুন বাংলাদেশ গড়ার। কৃতজ্ঞ বাঙালি জাতি আজ দৃঢ় শপথে বলীয়ান হবে সকল অন্ধকারের শক্তিকে পরাজিত করে শান্তিময় গণতান্ত্রিক দেশ গড়ে তোলার।
কর্মসূচি ॥ আজ ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস যথাযোগ্য মর্যাদায় উদযাপনের লক্ষ্যে জাতীয় পর্যায়ে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। ঢাকাসহ সারাদেশে প্রত্যুষে ৩১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে দিবসটির সূচনা হবে। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন।
এরপর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার নেতৃত্বে উপস্থিত বীরশ্রেষ্ঠ পরিবার, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও বীর মুক্তিযোদ্ধারা পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। বাংলাদেশে অবস্থিত বিদেশী কূটনীতিকবৃন্দ, বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনসহ সর্বস্তরের জনগণ পুষ্পস্তবক অর্পণ করে মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবেন।
আজ সকল সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি ভবনে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় পতাকা এবং ঢাকা শহরে সহজে দৃশ্যমান ভবনসমূহে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে এবং গুরুত্বপূর্ণ ভবন ও স্থাপনাসমূহ আলোকসজ্জায় সজ্জিত করা হবে। ঢাকা ও দেশের বিভিন্ন শহরের প্রধান সড়ক ও সড়কদ্বীপসমূহ জাতীয় পতাকা ও অন্যান্য পতাকায় সজ্জিত করা হয়েছে। ঢাকার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বিভিন্ন বাহিনীর বাদক দল বাদ্য বাজাবেন।
এ ছাড়াও জেলা ও উপজেলার স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হবে। দেশের সকল বিভাগ, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলন, জাতীয় সংগীত পরিবেশন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীদের সমাবেশ ও কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হবে। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, বাংলা একাডেমি, জাতীয় জাদুঘর, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, বাংলাদেশ শিশু একাডেমিসহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক আলোচনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, শিশুদের চিত্রাঙ্কন, রচনা ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রামাণ্যচিত্র এবং চলচ্চিত্র প্রদর্শনের এবং জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে ফুটবল, টি-টুয়েন্টি ক্রিকেট, কাবাডি, হাডুডু ইত্যাদি খেলার আয়োজন করবে। এ ছাড়া মহানগর, জেলা ও উপজেলায় বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং শহীদ পরিবারের সদস্যদের সংবর্ধনা প্রদান করা হবে। বাংলাদেশ ডাক বিভাগ স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করবে।
ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসমূহে দেশের শান্তি, সমৃদ্ধি ও অগ্রগতি কামনা করে বিশেষ দোয়া ও উপাসনার আয়োজন করা হবে। দেশের সকল হাসপাতাল, জেলখানা, শিশু পরিবার, বৃদ্ধাশ্রম, ভবঘুরে প্রতিষ্ঠান ও শিশু দিবাযতœ কেন্দ্রসমূহে বিশেষ খাবার পরিবেশন করা হবে।
দেশের সকল শিশুপার্ক ও জাদুঘরসমূহ বিনা টিকিটে উন্মুক্ত রাখা হবে। চট্টগ্রাম, খুলনা, মোংলা ও পায়রা বন্দর এবং ঢাকার সদরঘাট, নারায়ণগঞ্জের পাগলা, বরিশাল ও চাঁদপুর বিআইডব্লিউটিএ ঘাটে বাংলাদেশ নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ডের জাহাজসমূহ আজ সকাল ৯টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত জনসাধারণের পরিদর্শনের জন্য উন্মুক্ত রাখা হবে। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে এবং বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসেও দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে অনুরূপ কর্মসূচি পালন করা হবে।